শ্রদ্ধাঞ্জলি

আমাদের মিতা আপা

মিতা হক
মিতা হক

কলোনির বাসার ছোট্ট বসার ঘরের ডিভানে রাখা হারমোনিয়াম। জানালার শিক গলে বিকেলের নরম আলো তেরছাভাবে পড়ছে কিশোরীটির মুখে। তাতে তাঁর ভ্রুক্ষেপ নেই। সে প্রার্থনার ভঙ্গিতে চোখ বন্ধ করে দরদমাখা গলায় গেয়ে চলেছে ‘মরণ রে, তুহুঁ মম শ্যাম সমান…’ কিংবা ‘দূরে কোথায় দূরে দূরে...’। এটি মেয়েটির নিজের বাড়ি নয়। এটি নিচতলায় প্রতিবেশী পিতৃসম তাঁর এক খালুর ঘর। সেই ঘরে বসে সেই খালুর ‘অনুরোধে ঢেঁকি গিলছে’ সে। মেয়েটির নাম মিতা হক আর তার সেই খালু ভদ্রলোক হলেন আমার বাবা। আমরা সবাই উন্মুখ হয়ে থাকতাম, কখন বাবার ডাকে মিতা হক, মানে আমাদের প্রিয় মিতা আপা নিচে নামবেন।

যে সময়ের কথা বলছি, সে এক অন্য সময়। এখন কাউকে ফোন না করে কেউ কারও বাড়ি যায় না। আধুনিক শিষ্টাচার তা সমর্থন করে না। না জানিয়ে এসে ঘনিষ্ঠ কেউ ইন্টারকমে নিচ থেকে ফোন করলে আমাদের ভ্রু কুঁচকে যায়। পাশের ফ্ল্যাটের মানুষকে চিনি না। যোগাযোগ রাখি না, রাখার প্রয়োজনও বোধ করি না। ‘সামাজিক যোগাযোগ’ আছে না!

অথচ ১০ এপ্রিল রাত থেকে ১১ এপ্রিল ভোরে একের পর এক নিউ কলোনির প্রাক্তন বাসিন্দারা দেশে–বিদেশে যে যেখানে আছেন, খবর পেয়ে একজন আরেকজনকে যখন ফোন করে কাঁদছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল না মাঝে কেটে গেছে এত বছর। দেখা হয়নি কতকাল। ১২ নম্বর বিল্ডিংয়ের লিপু (গাজী আশরাফ হোসেন, বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক) কিংবা ১১ নম্বরের বিপাসার উদ্বেগ, কষ্ট একসুতায় বাঁধা। ৯ নম্বর বিল্ডিংয়ের মিতাকে হারানোর বেদনা।

একটানে আমরা সবাই চলে গেলাম শৈশব–কৈশোরে। কেউ সদ্য মা হারিয়েছেন, কেউ বড় ভাই। সবার এক অভিব্যক্তি, মিতা আপাকে হারিয়ে পরিবারে আবার বড় ধাক্কা খেলাম।

মিতা আপা যখন হারমোনিয়ামের বেলো নিজের হাতে করতে পারতেন না, তখন থেকে আমরা তাঁর গানের ভক্ত। টানা বিশ বছরের বেশি সময় আমরা এক পাড়ায়, এক বিল্ডিংয়ে থেকেছি। শিশুদের সংগঠন খেলাঘরে তাঁর নেতৃত্বে দল বেঁধে গান করেছি। শান্ত নদীটি, পটে আঁকা ছবিটি কিংবা শুভ্র সুনীল আকাশে পাখিরা উড়ছে, উড়তে থাক। ঢাকার আসাদগেট নিউ কলোনির শহীদ মিনার মাঠে মিতা আপার নেতৃত্বে একুশে ফেব্রুয়ারি বা পয়লা বৈশাখের মতো অনুষ্ঠানের আয়োজনের আগে কত যে মহড়া। কোনোটা আমাদের বাড়িতে, কোনোটা মিতা আপার বাড়িতে, কোনোটা অন্য কারও বাড়িতে। মা–বাবাদের পক্ষ থেকে বৈঠকখানা, চা–মুড়ি ফ্রি। তবে মিতা আপা গানের তাল, লয়, বাণী মুখস্থ করার বিষয়ে চুল পরিমাণ আপস করতেন না। বয়সের ছোট–বড় মানতেন না। হোক না তা পাড়ার অনুষ্ঠান। আর এখন তো দেখি চারদিকে ‘স্টেজে মেরে দেব’ সংস্কৃতি।

১৯৭৪ সালে তৎকালীন পূর্ব জার্মানিতে শিশুদের আন্তর্জাতিক গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্পে যোগ দিয়েছিলেন মিতা হক। সামনের সারিতে ডান থেকে চতুর্থ।

খেলাঘর থেকে মিতা আপা গেলেন আন্তর্জাতিক শিশু ক্যাম্পে (সামার ক্যাম্প) যোগ দিতে। তৎকালীন পূর্ব জার্মানিতে ১৯৭৪ সালে। সে কী গর্ব আমাদের! আসাদগেট থেকে দলেবলে কলকণ্ঠ খেলাঘর আসরের অনেকে গেলাম বিমানবন্দরে মিতা আপাকে বিদায় দিতে। তখন বিমানবন্দর ছিল তেজগাঁও। লাল স্কার্ফ উড়িয়ে ছোট মিতাকে আমরা আরও ছোটরা বিদায় জানালাম। এখনকার শিশুদের মতো তখন বিদেশে যাওয়ার এত সুযোগ ছিল না। তা–ও আবার খেলাঘরের মতো দেশব্যাপী সংগঠনে থাকা হাজার হাজার শিশুর মধ্যে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করা। সে দলের নেতৃত্বে ছিলেন পান্না কায়সার। আরও ছিলেন তাহমিন সুলতানা, আমাদের স্বাতী আপা। লেখার আগে স্বাতী আপাকে বললাম, ‘ক্যাম্পের স্মৃতি কিছু মনে পড়ে?’ স্বাতী আপা বললেন, ‘মিতার গানে ক্যাম্পের সবাই মুগ্ধ হতো। “রেল চলে ঝিকঝিক, ঝিকঝিক…”গানটার সঙ্গে বিদেশি বাচ্চারা ঝিকঝিক করে মাতিয়ে ফেলত পুরো ক্যাম্প। তত দিনে কেন্দ্রীয় খেলাঘরের সবার জানা, মিতা হকের সংগীতের পরিপক্বতা তাঁর বয়স থেকে অনেকটা এগিয়ে।

কিন্তু একটা মজার বিষয় হলো, ভালো গান করেন বলে ছুটে ছুটে টেলিভিশনে গিয়ে গান করতেন না তিনি। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় গিয়ে পুরস্কার পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠতেন না। খেলাঘর করতেন আর গানের চর্চা করতেন মনোযোগ দিয়ে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীতের অনুষ্ঠানে একক গান দিয়ে সবার সামনে এসেছিলেন। সে আমলে বাবার ফোক্সভাগেন গাড়ি করে টেলিভিশনে গান করতে গিয়েছিলেন প্রথম। আমরা জানালা ধরে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম। প্রস্তুতি না নিয়ে প্রস্তুতের ভান করেননি। এরপর আমাদের মিতা আপা ধীরে ধীরে হয়ে গেলেন দেশের নামকরা একজন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, শিক্ষক ও সংগঠক।

কত তারকা শিশুশিল্পীকে দেখেছি হারিয়ে যেতে। মিতা আপার সে সুযোগ ছিল। তিনি তারকা না হয়ে শিল্পী হয়েছেন। এর কারণ তাঁর বেড়ে ওঠার শিক্ষা। আমরা জানি ওয়াহিদুল হক ও সন্‌জীদা খাতুন তাঁর পরিবারের গুরুজন। তাঁদের শিক্ষা, সাধনা, রুচি তাঁকে চালিত করেছে। তবে ছোটবেলায় কাছ থেকে দেখেছি মিতা আপার মা–বাবাকে। রেজাউল হক এবং আমেনা বেগম। আমাদের লিলি চাচি। লিলি চাচির মতো এমন ধৈর্যশীল মানুষ কম দেখেছি। সব সময় মুখে হাসি। মিতা আপার জন্মের বেশ কয়েক বছর পর জন্ম নিল তাঁর ভাই রাজন। শিশু রাজন বড় হয়ে শিশু থেকে গেল। শুরু হলো লিলি চাচির সংগ্রাম। মায়ের মৃত্যুর পর রিলেরেসের দায়িত্বের কাঠি তুলে নিয়েছিলেন মিতা আপা। মায়ের মতো বোন।

স্বামী প্রয়াত অভিনেতা খালেদ খান অসুস্থ হলেন যখন, মিতা আপার তখন নানামুখী সংগ্রাম। কিন্তু দেশ নিয়ে, পত্রিকায় পড়া কোনো খবর নিয়ে চিন্তার অন্ত ছিল না তাঁর। ফোন করে কথা বলতেন। সুস্থ খালেদ খানের সঙ্গে দেখা হলে ঘাড় কাত করে হেসে বলতেন, ‘তোমরা তো মিতার বাপের বাড়ির লোক!’

জয়িতা রবীন্দ্রসংগীত গান। মিতা আপার কন্যা। মায়ের যোগ্য উত্তরসূরি হোক, সেটা কামনা করি। তবে আমি বিশ্বাস করি, মিতা আপা বেঁচে থাকবেন তাঁর গানে এবং ছাত্রছাত্রীদের প্রাণে। মিতা আপার এক ছাত্রী নীলা। পেশায় চিকিৎসক। শরীরের অবস্থা জানতাম তাঁর কাছ থেকে বেশি। শেষ খবরটা তাঁর দেওয়া। গুরুর প্রতি শিষ্যের ভালোবাসার ছাপ স্পষ্ট অনুভব করেছি। এমন নীলাদের অন্তরজুড়ে থাকবেন মিতা আপা।

ছোটবেলায় শোনা মিতা আপার কণ্ঠে, ‘আমার ইচ্ছে করে তোদের মতো মনের কথা কই’। মিতা আপা, জীবনে অনেক বড় বড় ঝড়ের মধ্য দিয়ে হেঁটেছেন আপনি। মা–বাবা, ভাইয়ের দায়িত্ব। স্বামীর অসুস্থতা, স্বামীকে হারিয়ে নিজের অসুস্থতার সঙ্গে পাঞ্জা লড়া, এর মধ্যে গান, পরের প্রজন্মের মধ্যে গান ছড়িয়ে দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। এত কিছুর মধ্যে সব কথা কি বলে যাওয়ার ফুরসত পেয়েছেন?

সুমনা শারমীন প্রথম আলোর ফিচার সম্পাদক।