সদ্য প্রয়াত সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান ঝালকাঠির নলছিটিতে জন্মগ্রহণ করেন এবং বরিশালের ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। তিনি বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব শাখার উপপরিচালকও হতে পারতেন। আমাদের সৌভাগ্য, তা না হয়ে তিনি লোভ-লালসামুক্ত যশস্বী সাংবাদিক হয়েছিলেন।
তাঁর প্রয়াণে সাবেক বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘...জনাব মিজানুর রহমান খান বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও আইনের শাসনের সপক্ষের নির্ভীক সৈনিক ছিলেন। তাঁর আইনগত ব্যুৎপত্তির জন্য তিনি সর্বমহলে বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। তাঁর আত্মা চিরশান্তি লাভ করুন।’ এএফপির ব্যুরোপ্রধান শফিকুল আলম লিখেছেন, ‘আপনার পাণ্ডিত্য ছিল অতুলনীয়। আপনি আইন ও আদালত বিষয় নিয়ে লেখা সর্বশ্রেষ্ঠ সাংবাদিক। আপনার সৌজন্য ও বিনয় ছিল কিংবদন্তিতুল্য।...আপনার মৃত্যু বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জন্য এক বিশাল ক্ষতি।’ সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে কোনো সাংবাদিকের জানাজা হয় ব্যক্তিগতভাবে, আমি এটা প্রথম জানলাম।
সহপাঠী, বন্ধু ও সাবেক রাষ্ট্রদূত সাইফুল আমিন খানের সঙ্গে, সম্ভবত ২০০৬ সালে, মিজান আমাদের কারওয়ান বাজারের ইডকল অফিসে আসেন। প্রথম দর্শনে যা আমাকে আকৃষ্ট করে তা হলো, তাঁর চেহারায় গ্রামীণ ছাপ, খানিকটা উচ্চকণ্ঠ, উজ্জ্বল চোখ ও মুখে খানিকটা দুষ্টুমি মাখানো হাসি। তারপর থেকে আমি তাঁর ‘সরল গরল’ কলামের নিয়মিত পাঠক হয়ে যাই এবং মৃত্যুর আগপর্যন্ত আমাদের সম্পর্ক ও যোগাযোগ অব্যাহত থাকে।
তিনি দুবার আমার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। এ ছাড়া আমাদের একটি যৌথ লেখা তাঁর নামে প্রথম আলোয় বের হয়। ‘রাজনীতি কম’ শিরোনামের একটি লেখা তাঁকে পাঠিয়ে বলি, যেহেতু রাজনীতি আমার লেখার বিষয় নয়, আপনি এ বিষয়ে লিখতে পারেন। কুম্ভীলকবৃত্তি না করে কীভাবে অন্যের লেখা ব্যবহার করা যায়, তাঁর প্রকৃষ্ট উদাহরণ এ নিবন্ধ পাঠকেরা পড়ে দেখতে পারেন।
মিজানের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল তাঁর অনুসন্ধিৎসা ও বিষয়–সম্পর্কিত জ্ঞান। কলাম লিখতে গিয়ে কোনো বিষয় জানতে ফোন করতেন। একদিন জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, ‘রেগুলেটরি ক্যাপচার’ বিষয়টা কী? আমি তাঁকে উদাহরণ দিয়ে বললাম, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ দেখার জন্য এসইসি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এসইসি যদি তা না করে, কেবল কোম্পানিগুলো ও শেয়ার মার্কেটের অন্য কুশীলবদের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তা হবে ‘রেগুলেটরি ক্যাপচার’। তিনি শুনে বললেন, বিষয়টা তো খুবই সহজ। তাহলে এসব এত খিটখিটে ভাষায় লেখা কেন? আমি হেসে বললাম, সহজ ও বোধগম্য করে লেখা হলে আপনি আমাকে রাত ১১টায় ফোন করতেন না! একবার বই লিখতে গিয়ে হাইকোর্টের একটি রায় আমার পড়ার প্রয়োজন হয়। বিষয়বস্তু বলতেই তিনি রায় প্রদানকারী বিচারকদ্বয়ের নাম বললেন এবং পরদিনই রায়ের কপি আমাকে পাঠালেন।
আস্তে আস্তে আমাদের সম্পর্ক ব্যক্তিগত রূপ ধারণ করতে থাকে। আমার মতো অসামাজিক লোকও তাঁর জন্য অর্গল খুলতে বাধ্য হই। একদিন অফিসে এসে বললেন, তাঁর এলাকায় বিদ্যুৎ-সংযোগ প্রয়োজন। আমি তত দিনে অবসর নিয়েছি। বললাম, আপনি প্রথম আলোর জাঁদরেল সাংবাদিক। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানকে বললেই কাজ হবে। তিনি বললেন, ‘না, আপনি ওনাকে বলেন।’ বললেন, আমি যেন তাঁর অফিসের পরিচয় না দিই। বলবেন, আপনার বন্ধু বা ছোট ভাই। তাঁর কথামতো আমি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানকে ফোনে বলি, মিজান গিয়ে দেখা করেন এবং কাজটি হয়। ব্যক্তিগত কাজে অফিসের পরিচয় ব্যবহারে তাঁর অনীহা ছিল লক্ষণীয়। তিনি ধামরাইর শৈলানে আমাদের কুটিরে গেলে জায়গাটা তাঁর খুব পছন্দ হয়। সেখানে দুস্থদের জন্য প্রবীণ নিবাস নির্মাণের আমাদের পরিকল্পনার কথা শুনে বলেন, শেষ বয়সে তিনি সেখানেই থাকবেন! তিনি ছিলেন দেশের হাতে গোনা ‘অবিক্রীত’ সাংবাদিকদের একজন।
তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে কোর্স পড়ানোর ইচ্ছা পোষণ করতেন। আমি তাঁর ইচ্ছার কথা কয়েকজন ভাইস চ্যান্সেলরকে জানিয়েছি। তাঁরা আমাকে বলেছেন মিজানের আইন বিষয়ে গভীর জ্ঞান সম্পর্কে তাঁদের কোনো সন্দেহ নেই। তাই তাঁরা তাঁকে অতিথি বক্তা করতে পারেন। কিন্তু আইন বিষয়ে মিজানের ডিগ্রি না থাকায় ইউজিসির শর্ত মেনে তাঁকে কোর্স পড়াতে দিতে পারবেন না। মিজান ছিলেন আইন বিষয়ে স্বশিক্ষিত। অথচ আইন বিষয়ে উচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিধারী অনেকেই তাঁর শরণাপন্ন হতেন তাঁর বিশেষ জ্ঞানের জন্য।
মিজানের অসুস্থতার খবর জানার পর থেকেই পালাক্রমে তাঁর স্ত্রী, ভাই মসিউর ও প্রথম আলোয় তাঁর সহকর্মীদের কাছে তাঁর শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিতে থাকি। হাসপাতাল তাঁর জন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছিল, তিনি বাসায় ফিরে যেতে চাইছিলেন। গত চার দিন আগে, তাঁর স্ত্রী আমাকে ফোনে বলেন, ‘ভাই, আমি তো আপনাকে ভালো সংবাদ দিতে চাই। কিন্তু আমার কাছে তো কোনো ভালো সংবাদ নেই।’ আমি বুঝতে পারি, ফোনে বারবার চিকিৎসার অগ্রগতির খবর জানতে চেয়ে আমি তাঁর স্ত্রীর কষ্ট আরও বাড়াচ্ছি। তাই ফোন করা বন্ধ করি। এরপরই মৃত্যুসংবাদ এল। তিনি দীর্ঘ এক মাসের অধিক সময় দুই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। প্রতিদিনই জানতে পারি, তাঁর অবস্থার উন্নতি হয়নি। তিনি আশঙ্কামুক্ত নন। তাঁকে বাঁচানো যায়নি।
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ