হজের শিক্ষা ও জীবনব্যাপী হজের প্রভাব

মহান আল্লাহর কাছে আরাফাতের ময়দানে হাজিদের প্রার্থনা। পবিত্র মক্কা নগরীর আরাফাত ময়দান
ছবি: রয়টার্স

হজ ও ওমরাহ পবিত্র সফর। এ সফর আবিলতা থেকে পবিত্রতার দিকে, অন্ধকার থেকে আলোর দিকে, অকল্যাণ থেকে কল্যাণের দিকে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতঃপর যে কেউ হজ করা স্থির করে, তার জন্য অশ্লীলতা, কুৎসা, অন্যায় আচরণ, ঝগড়া ও কলহ-বিবাদ বিধেয় নয়।’ (সুরা-২ বাকারা; আয়াত: ১৯৭)

হজের এই শিক্ষা আজীবন লালন ও ধারণ করতে হবে। সর্বদা তর্কবিতর্ক ও ঝগড়া-বিবাদ এড়িয়ে চলতে হবে। নফসকে নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা, নম্রতা, ভদ্রতা ও উদারতা শিক্ষায় দীক্ষিত করতে হবে।

হজের অন্যতম শিক্ষা হলো মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নেই, সাদা-কালোয় প্রভেদ নেই। বর্ণবৈষম্য ও বংশকৌলীন্য এগুলো মানুষের সৃষ্টি। পদ-পদবি ও অবস্থানগত পার্থক্য মানুষের মধ্যে অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করে। হজের মাধ্যমে তা দূরীভূত হয়। হজের পাঁচ দিন এরই প্রশিক্ষণ হয়।

জিলহজ মাসের ৭ তারিখে সব হাজি মিনার তাঁবুতে গণবিছানায় গিয়ে একত্র হন। জিলহজের ৯ তারিখে হাজিরা আরাফাতের ময়দানে গিয়ে ঐক্যের অনন্য দৃষ্টান্ত তৈরি করেন, মিলিত হন আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলনে। এদিন সন্ধ্যা (১০ জিলহজের রাতে) হাজিরা মুজদালিফায় গিয়ে সব কৃত্রিমতার অবসান ঘটিয়ে মানবতার পূর্ণতা ও আদি আসল প্রকৃত মানব রূপ লাভ করেন। সবারই পায়ের নিচে ধূসর ভূমি, মাথার ওপর নীল আকাশ, সবার পরিধেয় কাফনের বস্ত্র, পোশাকে থাকে না কোনো বাহুল্য। গায়ে জামা নেই, মাথায় পাগড়ি-টুপির শোভা নেই, লম্বা চুলের বাহার নেই, সঙ্গে সেবক নেই, সহকারী ও সহযোগী নেই, শক্তি-সামর্থ্য ও জ্ঞান গরিমার প্রকাশ নেই—এ অবস্থায় থাকে শুধুই আল্লাহর ওপর ভরসা। এটিই মানবতার অকৃত্রিম রূপ। এই অনুভব অর্জন হজের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও আসল শিক্ষা।

শয়তানকে পাথর মারার মধ্যে সদা সতর্কতা অবলম্বনের শিক্ষা রয়েছে। কোরআন করিমে সর্বশেষ সুরায় সর্বশেষ আয়াতে দুই প্রকার শয়তানের কথা উল্লেখ আছে—‘শয়তান হলো কিছু জিন ও কিছু মানুষ।’ (সুরা-১১৩ নাস, আয়াত: ৬) এ ছাড়া রয়েছে নফস শয়তান। (সুরা-১২ ইউসুফ, আয়াত: ৫৩)

ত্রিবিধ শয়তানের প্ররোচনা ও তাড়না থেকে নিজেকে রক্ষা করা এবং মনোজগতে শয়তানি শৃঙ্খল বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার ও সব ধরনের শয়তানি ভাব ও প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে একমাত্র বিবেকের অনুসরণে মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলার ইবাদত তথা আনুগত্য করাই হলো শয়তানকে পাথর মারার মূল রহস্য। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয় শয়তান মানুষের প্রকাশ্য দুশমন।’ (সুরা-১২ ইউসুফ, আয়াত: ৫)

হজের অন্যতম শিক্ষা বৃহত্তর মুসলিম ঐক্য। হজের সময় বর্ণ, শ্রেণি, দেশ, জাতি, মত, পথ ও পেশানির্বিশেষে সব দেশের সব মানুষ এক ইমামের পেছনে নামাজ আদায় করেন। এই হলো ঐক্যের অনন্য দৃষ্টান্ত। বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ সহাবস্থান করেন বলে ভাষার দূরত্ব দূর হয়ে মনের নৈকট্য অর্জন হয় এবং প্রকৃত মানবিক অনুভূতি জাগ্রত হয়। মনের সংকীর্ণতা দূর হয়; দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত হয়, চিন্তার বিকাশ সাধিত হয়। একদেশদর্শী মনোভাব দূরীভূত হয়ে বহুদর্শিতা ও দূরদর্শিতা অর্জন হয়, যা বিশ্বশান্তির জন্য অপরিহার্য।

হজ একটি ফরজ ইবাদত। এটি কোনো সার্টিফিকেট কোর্স, পদ-পদবি বা উপাধি নয়। হজ করার পর নিজ থেকেই নামের সঙ্গে ‘হাজি’ বিশেষণ যুক্ত করা শোভন নয়। অন্যরা করলে দোষ নেই। যাঁরা হজকে জীবন পরিবর্তনের সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং হজ-পরবর্তী জীবনে হজের শিক্ষা বজায় রেখে জীবন পরিচালনা করেন, তাঁরাই প্রকৃত হাজি।

হজ তিন প্রকার—হজে মাবরুর, হজে মাকবুল ও হজে মারদুদ। ‘হজে মাবরুর’ মানে হলো সর্বোত্তম হজ, যে হজ সব মানদণ্ডে শতভাগ উত্তীর্ণ। ‘হজে মাকবুল’ হলো কবুল হজ। ‘হজে মারদুদ’ হলো পরিত্যক্ত বা বাতিল হজ। নিয়ত বিশুদ্ধ না হলে বা উদ্দেশ্য সঠিক না থাকলে, হজের অর্থ হালাল না হলে বা বৈধ উপার্জন না হলে, হজের ফরজ, ওয়াজিব তথা আরকান–আহকাম সঠিকভাবে আদায় করা না হলে, হজের সময় নিষিদ্ধ কোনো কর্ম করলে হজ বাতিল হতে পারে। হজের শিক্ষা অর্জন না হলে বা হজের উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হলে হজ নিষ্ফল হিসেবে পরিগণিত হয়।

হজ কবুল হওয়ার এবং তা সঙ্গে আনতে পারার আলামত হলো হজের পরে কাজকর্মে, আমল-আখলাকে, চিন্তাচেতনায় পরিশুদ্ধি অর্জন করা বা পূর্বাপেক্ষা উন্নতি লাভ করা। হজ করার চেয়ে বড় বিষয় হলো জীবনব্যাপী হজ ধারণ করা। এটাই হজের আসল সার্থকতা। 

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

smusmangonee@gmail.com