বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর একটির প্রেসিডেন্ট তিনি। ঘৃণ্য এক স্বৈরশাসক। তারপরও তিনি আমাদের নজর কাড়েন। কারণ, সাঁজোয়া ট্রেনে চড়ে তিনি যখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করতে যান, তখন অনেকেই তাঁর সঙ্গে মিল খুঁজে পান চটকদার খলনায়ক জেমস বন্ডের।
উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং–উনের জন্য এই সফর জয়সূচক। পুতিনের জন্যও এটা একটা সুযোগ, তবে অপমানও বটে। এশিয়া ও গোটা বিশ্বের জন্য এটা সিনেমার পার্শ্ব প্রদর্শনীর মতো। এই সফরের গুরুত্ব নিহিত আছে অন্য কোথাও।
প্রেসিডেন্ট কিমের ছোটখাটো এই জয় মেনে নেওয়া যায়। উত্তর কোরিয়া টাকার ব্যাপারে বরাবরই বেপরোয়া। অতীতে তারা টাকা জাল বা সাইবার হামলা, কিংবা দাসত্বমূলক কাজে শ্রম সরবরাহ, অবৈধ ওষুধ উৎপাদনসহ নানা কিছু করে বৈদেশিক মুদ্রা কামিয়েছে।
এই বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে তারা সমরাস্ত্র ও ব্যালিস্টিক মিসাইল কর্মসূচিকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। তাই রাশিয়া প্রতিবেশী উত্তর কোরিয়ার সমরাস্ত্র কিনতে চাইছে এবং এর জন্য এমনকি কৌশলগত সহযোগিতা দিতে চাইছে—কিমের মতো একজন বিক্রেতার কাছে এ তো স্বপ্নের মতো ক্রেতা।
এতে ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধে ব্যাপক কোনো পরিবর্তন হবে, এমনটা বলা যায় না। যদিও খুবই প্রাথমিক পর্যায়ের অস্ত্রশস্ত্র এগুলো, অন্তত যুদ্ধক্ষেত্রে বাড়তি কিছু অস্ত্রের জোগান তো হবে। উত্তর কোরিয়ার অস্ত্রশস্ত্রের উৎপাদন খুবই কম এবং যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি বদলে দেওয়ার মতো নয়। এই বৈঠক এটাই প্রমাণ করে যে রাশিয়ার নিজস্ব অস্ত্রশস্ত্রের উৎপাদন এবং জোগান এতটা কমেছে যে পুতিনকে এখন কিম জং–উনকেও তোয়াজ করতে হচ্ছে।
পুতিন এমন একজন নেতা, যিনি গত কয়েক বছরে যা কিছু করেছেন, তার উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়া এখনো সুপার পাওয়ার এবং দেশটিকে ভয় ও সম্ভ্রমের চোখে দেখতে হবে— এই বার্তা দেওয়া। তাঁর এমন বৈঠক রীতিমতো অপমানজনক। কিম-পুতিনের আলিঙ্গন মনে করায় যে সমরাস্ত্রের জন্য রাশিয়ার কাছে এখনো বিকল্প আছে। কিন্তু বিকল্পগুলোও দুর্বল, যেমন উত্তর কোরিয়া ও ইরান।
কিম-পুতিন-ব্লোফেল্ডের এই সাক্ষাৎকারের আরেকটি দিক হলো, এ বৈঠকে চীনের নেতা সি চিন পিংকে যুক্ত করা হয়নি এবং চীন রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহের আহ্বান বরাবরই এড়িয়ে চলেছে। ইউক্রেনে গত ফেব্রুয়ারিতে পুতিনের আগ্রাসনের পর চীন-রাশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়ে। কিন্তু এর মধ্যে সামরিক পণ্য কেনাবেচার কোনো ব্যাপার ছিল না।
এটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ২০২২–এ পুতিনের ইউক্রেন দখলের মাত্র তিন সপ্তাহ আগে রাশিয়ার নেতারা বেইজিংয়ে যান এবং একটি দীর্ঘ যৌথ বিবৃতি দেন। ওই বিবৃতিতে তাঁরা অবারিত অংশীদারত্বের প্রতিশ্রুতি দেন। ওই বিবৃতিতে তাঁরা পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে তাঁদের অবস্থান ঘোষণা করেন এবং পশ্চিমা নীতি ও বৈশ্বিক সুশাসন প্রতিষ্ঠায় যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, সেগুলোর প্রভাব নিঃশেষ (তাঁদের চোখে) করে দেওয়ার পক্ষে কথা বলেন।
তবে এই যে যৌথ বিবৃতিতে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে নাক না গলানো কিংবা জোরজবরদস্তির বিরুদ্ধে কথা বলা হলো, তার কিছুদিন বাদেই রাশিয়া ইউক্রেনে হস্তক্ষেপ করে। এর অর্থ দাঁড়ায়, চীন ও রাশিয়া যে দেশগুলোকে নিজেদের বলে দাবি করে, সেসব দেশে হস্তক্ষেপ করার অধিকার তাদের আছে। ইউক্রেনের জন্য দেশটির নাম রাশিয়া আর চীনের জন্য তাইওয়ান।
সেদিক থেকে দেখতে গেলে চীনের জন্য ইউক্রেন ছিল প্রক্সি ওয়ারের মতো (দুটি দেশ বা দুটি পক্ষের মধ্যে যুদ্ধে যখন একটি পক্ষ উসকানি দেয়, কিন্তু কোনো প্রকাশ্য শত্রুতা থাকে না)। কিন্তু তারপরও চীন এখনো এই যুদ্ধে সরাসরি জড়ায়নি। রাশিয়ার সঙ্গে দেশটির অংশীদারত্ব এখনো সীমার ভেতরেই আছে। সমরাস্ত্র বা যুদ্ধের রসদ জোগানো পর্যন্ত গড়ায়নি।
১৯৫০-৬০ সালের দিকে চীনের বদলি হিসেবে ধরা হতো উত্তর কোরিয়াকে। এমনও হতে পারত যে কিমের রাশিয়া সফরের পেছনে চীনের হাত থাকার ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা যেত। তবে কয়েক দশক ধরে উত্তর কোরিয়া ও চীনের মধ্যে সেই আগের সম্পর্ক আর নেই। চেয়ারম্যান মাও সে–তুং যে সম্পর্ককে বলতেন ঠোঁট আর দাঁতের মধ্যকার সম্পর্ক।
প্রকৃতপক্ষে, এই দুই দেশের সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, কখনো কখনো শত্রুভাবাপন্ন মনে হয়। যেকোনো বিবেচনায় যদি উত্তর কোরিয়া এখন রাশিয়ায় চীনা অস্ত্র সরবরাহের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার হতো, তাহলে মার্কিন গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিতে পারত না।
এর চেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটেছে নয়াদিল্লিতে। ভারত জি-২০ সম্মেলন আয়োজন করে বিশ্বের বড় বড় দেশ, ধনী-দরিদ্রদের এক মঞ্চে এনেছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দিল্লি থেকে গেছেন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কমিউনিস্ট শাসিত দেশ ভিয়েতনাম সফরে।
চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং জি-২০ সম্মেলনে অংশ নেননি। হয়তো তিনি তাঁর মনের মতো হয়—এমন সব আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যাচ্ছেন, হয়তোবা চীনা অর্থনীতি এখন সংকটের মুখোমুখি, সে কারণে তিনি এ ধরনের সম্মেলন এড়িয়ে চলছেন। চীনা রাজনীতিকেরা সম্প্রতি জাপানি সাংবাদিকদের কাছে এই তথ্য ফাঁস করে দিয়েছেন যে সি দেশের ভেতরে কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতাদের কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছেন অর্থনীতির এই অবস্থা নিয়ে।
বেপরোয়া রাশিয়া, সংকটে পড়া চীনের পাশে ভারত জি-২০ সম্মেলন করে নিজেদের অনেকটা এগিয়ে নিয়েছে। আর মার্কিন কূটনীতির ফল ফলছে চীনের একেবারে নাকের ডগায়। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ভিয়েতনাম সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দেশটির সঙ্গে তারা যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। এখন চীনের প্রভাববলয়ে থাকা দেশগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক সম্পর্কোন্নয়নের জায়গা থেকে বাইডেন গেলেন ভিয়েতনামে।
বাইডেন যা যা করেছেন, তা–ও একজন বিক্রেতার স্বপ্ন বলে বিবেচনা করা যায়। দুই দেশই নিজেদের মধ্যে আকর্ষণীয় চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
বিল এমোট ইকোনমিস্টের সাবেক এডিটর-ইন-চিফ।
এ লেখাটি লেখকের সাবস্ট্যাক গ্লোবাল ভিউতে প্রকাশিত। এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া।