চিঠিপত্র

অস্থির নিত্যপণ্যের বাজার, নিয়ন্ত্রণ কার হাতে

অদ্ভুত আমাদের এ মাতৃভূমি। সরকারি কোনো নিয়মনীতি  ছাড়াই যেন বাজারব্যবস্থা লাগামহীনভাবে এগিয়ে চলেছে। এখানে কোনো অর্থনৈতিক নিয়ম ছাড়াই বাজারদর নিমেষেই ওঠানামা করে। কখনো পরিবহনের দোহাই, কখনো বাজারে দ্রব্যের কম সাপ্লাই, আবার কখনোবা যেকোনো ধর্মীয় উৎসব সামনে রেখে এ দেশের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বাজারকে অস্থির করে তোলেন।

এ ক্ষেত্রে বাজারব্যবস্থা নিয়মিত মনিটরিংয়ের কথা বারবার বলা হলেও লোকবল এবং কিছু ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না।

অন্যদিকে লোকবল–সংকটের কারণে নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা সম্ভব না হওয়ার সুযোগ নেন বেশ কিছু ব্যবসায়ী। তাঁরা বিভিন্ন সময় বাজারের  নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম সিন্ডিকেট করে বাড়িয়ে দেয়। মোটকথা কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই এ দেশের বাজারের দ্রব্যগুলোর দাম ওঠানামা করে হরহামেশাই।

বর্তমানে বাজারে প্রায় সব নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে জনমনে অস্বস্তি বিরাজ করছে। মুরগির মাংস, ডিম, সবজি, চাল, পেঁয়াজ, রসুন, আদা—এই সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় গরিব এবং মধ্যবিত্তদের একটি বিরাট অংশ দুর্ভোগে পড়েছে।

বিশেষ করে আলুর দাম একলাফে ৬০ টাকা হয়ে যাওয়ায় গরিব ও মধ্যবিত্তরা পড়েছে চরম বিপদে। কারণ, পৃথিবীর দেশে দেশে জনপ্রিয় এই সবজি তরকারি হিসেবে সব সময় মানুষ পছন্দ করে। আমাদের দেশে আলুর জনপ্রিয়তা সর্বজনবিদিত।

এ আলু যখন প্রথমে ২০, তারপর ৪০, তারপর ৫০ এবং বর্তমানে ৬০ টাকা দাম হয়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন তুলেছে, বাজার নিয়ন্ত্রণ আসলে কার হাতে। বাজারের জিনিসপত্রের দাম এমন দফায় দফায় বাড়ছে কাদের কারসাজিতে?

বিষয়টি দেখার যাদের দায়িত্ব তারাই–বা কী করছে? অনেকে আবার পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন, এ বাজার অস্থিরতার পেছনে কেউ কারসাজি করছে না তো?

২০ টাকার আলু যখন ৬০ টাকা হয়ে যায়, ১২০ টাকার মুরগি যখন ২০০ টাকা হয়ে যায়, বিভিন্ন নিত্যদ্রব্যের দাম যখন অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে তখন জনগণের মনে এমন প্রশ্ন আসা অস্বাভাবিক নয়। এমন পরিস্থিতিতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের উচিত এমন মূল্য বৃদ্ধির কারণ কী, তা দ্রুত খুঁজে বের করে জনগণকে জানানো। আর এ মূল্য বৃদ্ধি যদি অযৌক্তিক হয় এবং এর পেছনে যদি কোনো সিন্ডিকেট জড়িত থাকে তাহলে তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের হাতে তুলে দেওয়া।

কিন্তু আমরা একটা বিষয় সব সময় লক্ষ করেছি বাজারে যখন জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে প্রথম দিকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কোনো হুঁশ না থাকলেও বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রচারের পর তাদের কিছুটা হুঁশ আসে এবং তারা বিভিন্ন জায়গায় বাজার মনিটরিং করে কিছু ব্যবসায়ীদের আর্থিক দণ্ডও দেয়। তারপর হঠাৎ করে তারা উধাও হয়ে যায়।

এ বিষয়ে তাদের সব সময় একই কথা লোকবলের অভাবে তারা তাদের মনিটরিং ব্যবস্থা সব সময় সব জায়গায় কার্যকর রাখতে পারছে না। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরও কেনই–বা আমরা বাজার মনিটরিংয়ের জন্য পর্যাপ্ত লোকবল নিয়োগ দিতে পারলাম না, এমন প্রশ্ন থেকেই যায়। যেহেতু আমাদের বাজারে ঘাপটি মেরে বসে আছে অসংখ্য অসাধু ব্যবসায়ী, আড়তদার, মজুমদার এবং মধ্যস্বত্বভোগী। তাদের থামানো কি যথাযথ কর্তৃপক্ষের উচিত নয়? আর এর জন্য বাজার মনিটরিং ব্যবস্থাটিকে স্থায়ী রূপ দিলে কারও কি ক্ষতি হবে? বরং লাভ হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সংস্থাটি যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারবে। এতে সরকারও কিছুটা হালকা হবে। বাজার নিয়ে তাদের মাথা ঘামাতে হবে না।

একটি বিষয় অত্যন্ত স্পষ্ট যে আমাদের দেশের বেশির ভাগ ব্যবসায়ী লোভী। এরা বেশি মুনাফা করতে সব সময় অভ্যস্ত। হোক সেটা ক্রেতাসাধারণকে ঠকিয়ে কিংবা পণ্যে কিছু ভেজাল কিছু মিশিয়ে। অতীতেও এটা বারবার প্রমাণিতও হয়েছে ফলে এদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নিয়মিত কোনো স্থায়ী সংস্থা না থাকলে এদের নিয়ন্ত্রণ করাই কঠিন হবে। ফলে সময় এসেছে বাজার নিয়ন্ত্রণে স্থায়ী এবং দক্ষ ও নির্লোভ সংস্থা গঠন করার।

এতেই বাজারে দ্রব্যমূল্য সমূহ নিয়ন্ত্রণ করা অনেকটাই সুবিধা হবে। এতে যদি নতুন আইনও করতে হয় তাহলেও যেন সরকার পিছপা না হয়। প্রয়োজনে কঠিন এবং কার্যকর আইন করার মাধ্যমে বাজার মনিটরিং সংস্থাকে এ বিষয়ে যথাযথ ক্ষমতা দিয়ে বাজারে নামাতে হবে।

বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত মনিটরিং স্থায়ী মনিটরিং সংস্থার মূল কাজ হবে দেশের প্রতিটি বাজার নিয়মিত মনিটরিং করা এবং কোথাও অসংগতি দেখলে এ বিষয়ে তৎক্ষণাৎ নেওয়া। একটি স্থায়ী ‘বাজার মনিটরিং সংস্থা’ গঠন করার মাধ্যমে দেশের বাজারব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণের একটি কার্যকর পন্থা সরকারের হাতে থাকবে, এতে জনগণ লাভবান হবে।

স্থায়ী মনিটরিং সংস্থা গঠন করা হলে পুরো দেশব্যাপী বাজার মনিটরিং সংস্থাটি সঠিকভাবে কাজ করতে পারলে অসাধু ব্যবসায়ীরা সহজে বাজার নিয়ন্ত্রণে নিতে পারবে না। আমরা প্রত্যাশা করব, সরকার খুব দ্রুতই দেশের অস্থির বাজারব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে একটি স্থায়ী বাজার মনিটরিং সংস্থাসহ আরও কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে দেশের বাজারব্যবস্থাকে একটি সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আর এতে দেশের জনগণ লাভবান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারও তাদের দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হবে। আমরা প্রত্যাশা করব, সরকার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবে।

রতন কুমার তুরী
সিনিয়র প্রভাষক, ইতিহাস বিভাগ
রাঙ্গুনিয়া হাসিনা জামাল কলেজ
রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম