ফুল ফোটার আগেই ঝরে না পড়ুক

এক কিশোরীকে গাছের সদ্য জেগে ওঠা একটি ফুলের কুঁড়ি বলা যায়। ফুলের কুঁড়িটি যেমন ধীরে ধীরে পাপড়ি মেলতে শুরু করে বিকশিত হয়ে তার সৌন্দর্য ও সুগন্ধি ছড়ায়, একটি মেয়েও তেমনি কিশোরী থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ভেতরে লালিত স্বপ্নগুলো মেলে ধরতে চায়। কিন্তু আমাদের দেশের মেয়েদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। অনেক সময় দেখা যায়, কিশোরী অবস্থায় একটি মেয়েকে বিয়ে দিয়ে তার সেই স্বপ্ন সদ্য জেগে ওঠা ফুলের কুঁড়ি থাকা অবস্থায় ধ্বংস করে দেওয়া হয়। বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয় না। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই সে বাল্যবিবাহের শিকার হয়ে ঝরে যায়।

বাল্যবিবাহ একটি জাতির জন্য অভিশাপ। বর্তমানে এটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ নিরোধক আইন ২০১৭ অনুযায়ী, ছেলেদের ২১ বছরের আগে এবং মেয়েদের ১৮ বছরের আগে বিয়ে হলে, তাকে বাল্যবিবাহ হিসেবে গণ্য করা হয়। এই বাল্যবিবাহের কারণে সমাজে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয় যেমন মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, অপুষ্টিজনিত বিভিন্ন রোগ, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, দাম্পত্য জীবনে কলহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, আত্মহত্যা, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেমন নাইজার, চাদ, মালি, ভারত, পাপুয়া নিউগিনি ও মধ্য আফ্রিকার দেশগুলোতে বাল্যবিবাহের হার সবচেয়ে বেশি।

বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০২২ অনুসারে, বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার ৫০ শতাংশের বেশি। করোনা মহামারির কারণে এই প্রভাব বেড়েছে। বাল্যবিবাহের ওপর ইউএনএফপিএর এক জরিপ অনুসারে, দেশে ১৫ থেকে ১৯ বছরের মেয়েদের বিয়ের হার ২০২১ সালে আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেড়েছিল। করোনা মহামারির কারণে এই বয়সী মেয়েদের ২ বছরে বিয়ে হয়েছে ২৭ শতাংশের মতো।

বাল্যবিবাহের পেছনে বহুবিধ কারণ লুকিয়ে রয়েছে। তার মধ্যে দারিদ্র্য, অজ্ঞতা, কুসংস্কার, লিঙ্গবৈষম্য, সামাজিক  চাপ, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা, যুদ্ধবিগ্রহ, বিভিন্ন মহামারির প্রভাবে অভিভাবকেরা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই মেয়েদের বিয়ে দেন। আমাদের সমাজে কন্যাসন্তানদের বোঝা হিসেবে গণ্য করা হয়। তারা সংসারে অর্থনৈতিকভাবে কোনো সাহায্য করতে পারবে না, উল্টো তাদের ভরণপোষণ করতে হবে, এই ধারণা মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়ার অন্যতম কারণ।

বাল্যবিবাহের শিকার একটি মেয়ের সুস্থভাবে সন্তান উৎপাদন করার মতো সক্ষমতা থাকে না। যার ফলে নিজের জীবনের ঝুঁকিসহ অনাগত সন্তানের জীবনের ঝুঁকিও থাকে। অর্থাৎ একই সঙ্গে দুটি প্রাণের ঝুঁকি। অন্যদিকে বাল্যবিবাহের শিকার একটি ছেলে বিভিন্নভাবে অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে। কেননা পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করার কোনো উপায় কম বয়সে খুঁজে না পেয়ে বিভিন্ন অসামাজিক কাজে জড়িয়ে যায়।

সরকারের জাতীয় কর্মপরিকল্পনা অনুসারে, ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ থেকে ১৮ বছরের মেয়েদের বাল্যবিবাহ এক-তৃতীয়াংশ কমানোর লক্ষ্য ছিল এবং ২০৪১ সালের মধ্যে তা পুরোপুরি নির্মূল করার অঙ্গীকার রয়েছে। তা বাস্তবায়নের জন্য সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এখন দেখা যাচ্ছে, বাল্যবিবাহ আরও বেড়ে যাচ্ছে। সরকারের উচিত হবে, গৃহীত উদ্যোগগুলো সফল ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা। সরকারের পাশাপাশি আমাদের সবার উচিত বাল্যবিবাহ নিরোধে এগিয়ে আসা।

হৃদি সরকার
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়