আমাদের দেশে বায়ুদূষণের কারণে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে সুনির্দিষ্ট জরিপ কিংবা পরিসংখ্যান নেই।
আমাদের দেশে বায়ুদূষণের কারণে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে সুনির্দিষ্ট জরিপ কিংবা পরিসংখ্যান নেই।

চিঠিপত্র

ঢাকার বায়ু সুস্থ হবে কবে?

গত কয়েক বছর ধরে বায়ু দূষণে ভুগছে দেশের রাজধানী। দেশের গণমাধ্যমের নিয়মিত শিরোনাম হচ্ছে ঢাকার বাতাস ঝুঁকিপূর্ণ বা খুবই অস্বাস্থ্যকর। গবেষকেরা বলছে, রাজধানী এখন বসবাসের অনুপযোগী। এ ছাড়াও সমানুপাতিকভাবে পরিবেশের সঙ্গে মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে।

বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আইকিউ এয়ারের সূচকে গেল বছর ঢাকা একাধিকবার ৩০০’র বেশি একিউআই স্কোর নিয়ে সর্বোচ্চ দূষিতের তালিকায় রাজধানীর নাম ছিল।

চলতি বছরের প্রথম এবং দ্বিতীয় দিন একিউআই স্কোর ছিল যথাক্রমে ২৪৪ ও ২৫৬। কোনো স্থানের একিউআই স্কোর যদি ২০১ থেকে ৩০০ এর মধ্যে থাকে, তবে তা খুবই অস্বাস্থ্যকর। একিউআই স্কোর যত বেশি হবে, মান তত খারাপ। খুবই অস্বাস্থ্যকর এর মন্তব্য হচ্ছে, বায়ুমান অস্বাস্থ্যকর ও এই ধরনের বায়ুতে বেশিক্ষণ থাকলে মারাত্মক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে।

আইকিউএয়ারের মানদণ্ড অনুযায়ী, কোনো শহরের বা স্থানের স্কোর ৫০ বা তার কম হলে বায়ুর মান ভালো বলে ধরা হয়।

৫১ থেকে ১০০ হলে, তা ‘মাঝারি’ বা ‘গ্রহণযোগ্য’, ১০১ থেকে ১৫০ স্কোরকে ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর’ ও ১৫১ থেকে ২০০ স্কোর হলে ‘অস্বাস্থ্যকর’, ২০১ থেকে ৩০০ হলে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’হিসেবে ধরা হয় ওই শহর বা স্থানকে। স্কোর ৩০১-এর বেশি হলে বায়ুর মানকে ‘দুর্যোগপূর্ণ’ বা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’বলে বিবেচিত হয়।

দেশের ১৬ কোটি ৪৮ লাখ মানুষ সারা বছর দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত মান, বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা (পিএম ২.৫) ৫ মাইক্রোগ্রামের চেয়ে বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত বায়ুদূষণ-বিষয়ক এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ু দূষণের কারণে দেশের মানুষের গড় আয়ু বছরে ৮ বছর ৮ মাস কমে যাচ্ছে।

মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান হেলথ এফেক্ট ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশন জানিয়েছে, বিশ্বব্যাপী বায়ু দূষণের কারণে ২০২২ সালে বিশ্বে মোট ৬.৭ মিলিয়ন মানুষ মারা গেছে। এদের মধ্যে একই বছর বিশ্বে প্রায় ৫ লাখ শিশুর মৃত্যু হয়েছে।

বিশ্বব্যাপী মানুষের মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর একটি হচ্ছে বায়ু দূষণ।  স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) বিশ্লেষণ বলছে, ২০২৩ সালে বায়ুমান সূচকে দেশের রাজধানীর গড় স্কোর ছিল ১৭১, যা ২০২২ সালে ছিল ১৬৩।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ৮ বছরের চেয়ে গড়ে গেল বছরে ১০ ভাগেরও বেশি বায়ু দূষণ বৃদ্ধি পেয়েছে রাজধানীতে, যা বড় শঙ্কার বিষয়। ঢাকা বায়ু দূষণে বিশ্বের প্রথম সারিতে স্থান করে নেওয়ার পেছনে সুনির্দিষ্ট কিছু কারণকে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। সেগুলো, নির্মাণকাজ, ইটভাটা ও শিল্পকারখানা, যানবাহন এবং বর্জ্য পোড়ানো ইত্যাদি।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার পাশেই নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ধামরাই, সাভার, টঙ্গী, যাত্রাবাড়ী, লালবাগ ও হাজারীবাগে শিল্প-কারখানার কারণে মাত্রাতিরিক্ত হারে বায়ুদূষণ হচ্ছে।

বায়ুদূষণের ফলে শুধু যে মানুষ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তা নয়, অকাতরে জীবনও হারাচ্ছে। বায়ুদূষণের ফলে যেসব রোগের কারণে মানুষের অকালে প্রাণ ঝরে যাচ্ছে- শ্বাসকষ্টজনিত রোগ, ফুসফুসে দীর্ঘস্থায়ী রোগ, ফুসফুস ক্যানসার, হৃদ্‌রোগ, হাঁপানি, অ্যালার্জি ও স্ট্রোক। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মতে, বিশ্বের ৯২ শতাংশ মানুষ বিষাক্ত বায়ু গ্রহণ করে। এর ফলে প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে প্রায় ৪২ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে।

আমাদের দেশে বায়ুদূষণের কারণে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে সুনির্দিষ্ট জরিপ কিংবা পরিসংখ্যান নেই। তবে গবেষক, চিকিৎসক, পর্যবেক্ষকদের মতে, বহু রোগ ও মৃত্যুর কারণ হিসেবে রয়েছে দেশের ভয়াবহ বায়ুদূষণ। চিকিৎসক, গবেষক ও পরিবেশবিদেরা ভয়াবহ বায়ুদূষণের কারণে মানুষের স্বাস্থ্যহানি, বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়া, মৃত্যুর পরিসংখ্যান কতটা ভয়াবহ, তা নিয়ে একটা প্রতিবেদন ত্বরিত প্রয়োজন।

এসব রোগ থেকে আমাদের মুক্তি পাওয়ার জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানি অতিরিক্ত ব্যবহারে সচেতন হতে হবে, কালো ধোঁয়া উৎপাদন কমাতে হবে, বেশি বেশি গাছ লাগাতে হবে অর্থাৎ বৃক্ষনিধন বন্ধ করে সারা দেশে বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণে পদক্ষেপ নিতে হবে, যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা ও মলমূত্র ত্যাগ করা থেকে বিরত থাকতে হবে, ধূমপান ও তামাক সেবন থেকে বিরত থাকতে হবে। নির্মাণকাজে যাতে ধুলাবালি সৃষ্টি না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে।

বায়ুদূষণ হ্রাস ও প্রতিরোধে সরকারের পক্ষ থেকে নানান আইন ও বিধি তৈরির পদক্ষেপের কথা বলা হচ্ছে। তবে আমাদের সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগের বিশেষ প্রয়োজন। বিভিন্ন ধরনের অসচেতনতা ও অনিয়মের ফলে পরিবেশ আজ নানামুখী বিপর্যয়ের শিকার। নিজেদের স্বার্থেই এই ভয়ংকর বিপদ মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে বায়ুদূষণ হবে আমাদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ। পরিবেশ রক্ষায় শুধু সরকার বা পরিবেশ সংগঠনই নয়, নাগরিক অর্থাৎ আমাদের সচেতন হতে হবে।

  • শাফিউল কায়েস সাবেক শিক্ষার্থী, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ