বছর বছর বন্যায় ভাসছে কুড়িগ্রাম
বছর বছর বন্যায় ভাসছে কুড়িগ্রাম

চিঠিপত্র

কুড়িগ্রামের বন্যা নিয়ে কারও কেন মাথাব্যথা নেই

কুড়িগ্রাম অসংখ্য নদ-নদীর তীরে অবস্থিত ছোট্ট একটি গ্রাম যেন। এখানে দারিদ্র্য, ক্ষুধা-পিপাসা, দুঃখ-শোকে কাটে অগণিত প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের নিত্যদিন। কুড়িগ্রাম জেলার মধ্য দিয়ে ভারতের প্রায় ১৪টি নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এ ছাড়া আরও দুটি আন্তসীমান্ত নদী এ জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি পানি বহনকারী বিপুলা ব্রহ্মপুত্র নদও কুড়িগ্রাম দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এসব নদীর কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে কুড়িগ্রাম জেলাটি।

প্রতি বর্ষা মৌসুমেই এ জেলায় ব্যাপকতর বন্যা হয়। এক সপ্তাহের ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নদ-নদীর পানি ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। জেলার প্রধান নদ-নদীগুলোর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমার নদের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চলসহ অসংখ্য গ্রাম আর স্কুলগুলো। প্রথম আলো প্রতিবেদন অনুযায়ী, বন্যায় প্লাবিত ৩৭টি বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ হয়েছে। সেই সঙ্গে দেখা দিয়েছে নদীভাঙনও।

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের শতাধিক হেক্টর ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। বন্যা ও নদী ভাঙনে দিশেহারা হতদরিদ্র মানুষগুলোর চিত্র যদি আজকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বেঁচে থাকতেন তাহলে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে হয়তো কুড়িগ্রামের গল্পগুলোই ফুটে উঠত। কালবৈশাখীর প্রকোপ থামতে না থামতেই বর্ষার পানি ঘরে ঢুকছে। তারপর আসবে শীতের নির্মম আঘাত। কুড়িগ্রামে জন্মের অভ্যর্থনাই যেন চিরন্তন গম্ভীর, উৎসবহীন ও বিষণ্ন।

উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলাকে একসময় মানুষ চিনত মঙ্গাপীড়িত এলাকা হিসেবে। এর মধ্যে  কুড়িগ্রাম অন্যতম, যার প্রধান কারণ হচ্ছে বন্যা ও নদীভাঙন। বন্যা ও নদীভাঙন কুড়িগ্রামের জন্য বর্তমানে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নদীগুলো ক্রমান্বয়ে হারাচ্ছে নাব্যতা। বর্ষাকালে খালে, বিলে কোনোখানেই যেন পানির ঠাঁই নেই। সবখানে দখলদারদের বাণিজ্যিক থাবা। আর এই বাণিজ্যিক থাবা আসে মূলত স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে। নদীর নাব্যতা বৃদ্ধিকরণে নেই কোনো দৃশ্যত পদক্ষেপ, নেই কোনো বিশেষ বরাদ্দ।

এবারের বাজেটে উত্তরাঞ্চলের জন্য বিশেষ কোনো বরাদ্দ যে ছিল না, তা আমাদের সবারই জানা। প্রতি অর্থবছরে আর্থসামাজিক অবকাঠামো ও জনগুরুত্বপূর্ণ রাস্তাঘাট, সেতু ও কালভার্ট সংস্কারের জন্য সরকার প্রতি জেলায় নিয়মিত বরাদ্দ দিয়ে থাকে। কিন্তু কুড়িগ্রামের জন্য এই বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই নগণ্য। বিশেষ করে, উলিপুর উপজেলায় গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির(এডিপি) আওতায় বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের ৩১ কোটি ৭ লাখ ২৪ হাজার ১৭৬ টাকা ফেরত গেছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনিয়ম, দুর্নীতি, দায়িত্বে অবহেলা, দর-কষাকষি, ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের ভাগাভাগির দ্বন্দ্বে। (সূত্র: দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকা, প্রকাশিত ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২)

আমাদের জনপ্রতিনিধিরা কি নিজস্ব স্বার্থের জন্যই রাজনীতি করেন? প্রতি অর্থবছরে কুড়িগ্রামের জন্য যতটুকু বরাদ্দ আসছে, তা সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের সঠিক তদারকির অভাবেই হয়তো সদ্ব্যবহার হচ্ছে না। তাহলে আমাদের কুড়িগ্রাম কেন সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারছে না? আমরা কি এ দেশের নাগরিক নই? আমরা কি নাগরিক দায়িত্ব পালন করি না?

এ জেলার মানুষ কি এতই অবহেলিত যে প্রতিবছর বন্যার সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হবে আমাদের? বন্যায় মানুষ দিশেহারা হয়ে যখন নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে, তখন আমাদের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ আরাম-আয়েশে বিভাগীয় ও রাজধানী শহরে বসবাস করছে। একদিকে খাদ্যের চরম সংকটে ভোগা এসব মানুষ যখন জীবনযুদ্ধে নিমজ্জিত, তখন সরকারের শীর্ষ মহল থেকে শুরু করে স্থানীয় সংসদ সদস্য পর্যন্ত এসব অবহেলিত মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান না। এমনকি ত্রাণ পর্যন্ত পান না আমাদের এলাকার লোকজন।

সিলেটের বন্যার দিকে সবার যেভাবে মনোযোগ থাকে, কুড়িগ্রামের বেলায় তা দেখা যায় না। সরকার থেকে বরাদ্দ ও ত্রাণ সহায়তাও দেওয়া হয় না পর্যাপ্তভাবে। এতসব বৈষম্য রেখে কীভাবে আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব? দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে, কিন্তু তারপরও কুড়িগ্রাম কেন দারিদ্র্যসীমার নিচে?  

জলবায়ু পরিবর্তন জনিত দুর্যোগ মোকাবিলা কুড়িগ্রামসহ পুরো দেশের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুপরিকল্পনা গ্রহণ করে এখনই এসব দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হবে। এ অঞ্চলের জন্য বিশেষ বরাদ্দ ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। বাঁধ সংস্কার, নদীভাঙন রোধ, নদী খনন, নদীর নাব্যতা বৃদ্ধিসহ দারিদ্র্য দূরীকরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শুধু বন্যা ও নদীভাঙন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হলে কুড়িগ্রাম জেলায় আর মঙ্গা ও দারিদ্র্যের প্রকোপ থাকবে না।

রনি সরকার
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর।