গাছ লাগানোর মধ্যে যে আনন্দ আছে, নিজের লাগানো গাছে নতুন পাতা বের হলে, প্রথম ফুল এলে, প্রথম ফল ধরলে, ফল বড় হলে, সে ফল নিজে খেলে বা অন্যকে খেতে দেওয়ার মধ্যে যে অনেক আনন্দ, তা এই নতুন প্রজন্ম জানেই না।
গাছ লাগানোর মধ্যে যে আনন্দ আছে, নিজের লাগানো গাছে নতুন পাতা বের হলে, প্রথম ফুল এলে, প্রথম ফল ধরলে, ফল বড় হলে, সে ফল নিজে খেলে বা অন্যকে খেতে দেওয়ার মধ্যে যে অনেক আনন্দ, তা এই নতুন প্রজন্ম জানেই না।

সব শিক্ষার্থীর হাতে একটি করে গাছের চারা উপহার দিন

বর্তমান সরকারের কয়েকটি যুগান্তকারী উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশের সব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ। ২০১০ সাল থেকে প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থী প্রতিবছর ১ জানুয়ারি বছরের প্রথম দিন খালি হাতে বিদ্যালয়ে গিয়ে নতুন বই হাতে নিয়ে মনের আনন্দে বাড়ি ফেরে। সেদিন দেশের সব বিদ্যালয়ে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়, যার নাম দেওয়া হয়েছে বই উৎসব। এর মাধ্যমে বিদ্যালয়গুলোতে একাধারে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, শিক্ষার্থী ঝরে পরা কমেছে এবং সর্বোপরি আমাদের শিক্ষার হার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের এ উদ্যোগ বহির্বিশ্বেও বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে।
সারা বিশ্বের মানুষ যেসব সমস্যা নিয়ে চিন্তিত, তার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন অগ্রগণ্য।

বিশ্ব উষ্ণায়ন প্রায় প্রতিবছর আগের রেকর্ড ভঙ্গ করছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে আমরা কোন পরিবেশে রেখে যাচ্ছি, তা অবশ্যই ভাবনার বিষয়। অথচ আমরা প্রত্যেকে আমাদের সন্তানদের সুখের জন্য কত কিছুই না করতে চেষ্টা করি।

বিশ্ব উষ্ণায়নের অনেক কারণের মধ্যে ব্যাপক বৃক্ষনিধন অন্যতম। মানবসভ্যতা উন্নত হচ্ছে, জনসংখ্যা বাড়ছে, নগরায়ণ বৃদ্ধি পাচ্ছে; যার ফলস্বরূপ বাসাবাড়ি, রাস্তাঘাট, স্কুল–কলেজ, অফিস আদালত, মসজিদ মাদ্রাসা প্রভৃতি সবকিছুর সংখ্যা ও আকার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সবকিছু করতে গিয়ে কাটা পড়ছে গাছ। শহর, উপশহর এমনকি গ্রামেও আগের সেই বড় বড় গাছ খুব একটা চোখে পড়ে না। নতুন যেসব গাছ লাগানো হচ্ছে, তা-ও পর্যাপ্ত নয়।

এভাবে আমাদের চারপাশ প্রায় গাছশূন্য হয়ে পড়ছে, যার ফলে আমরা বিভিন্ন পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছি। মাসখানেক আগে আমাদের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রচণ্ড রকমের তাপপ্রবাহ এবং দুটি নিম্নচাপ এরই উদাহরণ।

গাছ আমাদেরকে অক্সিজেন দেয়, কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে, পশুপাখিকে আশ্রয় দেয়, পরিবেশ ঠান্ডা রাখে, প্রাকৃতিক সুরক্ষা দেয়, পারিপার্শ্বিক শোভা বৃদ্ধি করে—এ রকম বিভিন্ন সুফল দিয়ে থাকে, যা আমরা চিন্তাই করি না অথচ আমাদের ভালোভাবে বাঁচার জন্য অনেক প্রয়োজনীয়।

কারও দেওয়া একটি গাছ তার স্মৃতিচিহ্ন বহন করে। বিদ্যালয়ের দশ ক্লাসে যদি একজন শিক্ষার্থী দশটি গাছের চারা বিনা মূল্যে পেয়ে তার বাসায় বা জমিতে লাগিয়ে থাকে, যা তার স্কুলজীবনের একেক ক্লাসের স্মৃতি বহন করবে—এটি তার পিতামাতার কাছে যেমন আবেগের বিষয় হবে, ঠিক তেমনি তার পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও হবে আবেগের। যে আবেগ গাছটিকে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে এবং আমাদের পরিবেশে অবদান রাখতে সহায়তা করবে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কথা চিন্তা করে আমাদের শিক্ষাক্রমে অনেক পরিবর্তন আনা হচ্ছে, যা অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। সে অনুযায়ী আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদেরকে উপযোগী করে তোলার কাজ চলছে। এর সঙ্গে আরও একটি বিষয় যুক্ত করলে ভালো হয়, তা হলো আমাদের বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীদের হাতে প্রতিবছর যেন অন্তত একটি করে গাছের চারা বিনা মূল্যে দেওয়া হয়, যা তারা বাসায় নিয়ে রোপণ করবে। এতে তাদের মানসপট এবং আমাদের চারপাশের পরিবেশে অবশ্যই কিছু পরিবর্তন আসবে, যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা করবে।

আমাদের বর্তমান প্রজন্মের শিশুরা জন্মের পরে কয়েক মাস যেতে না যেতেই স্মার্টফোনে স্ক্রল করে বিভিন্ন ভিডিও, গেম, এরপরে আসে ফেসবুক প্রভৃতি জিনিস দেখে দেখে বড় হয়। তারা গাছের সঙ্গে মোটেও পরিচিত নয়। গাছ লাগানোর মধ্যে যে আনন্দ আছে, নিজের লাগানো গাছে নতুন পাতা বের হলে, প্রথম ফুল এলে, প্রথম ফল ধরলে, ফল বড় হলে, সে ফল নিজে খেলে বা অন্যকে খেতে দেওয়ার মধ্যে যে অনেক আনন্দ, তা এই নতুন প্রজন্ম জানেই না।

তাদেরকে সে বিষয়টি জানানোও আমাদের কর্তব্য। এতে তারা গাছের প্রতি যত্নবান হবে। শুধু গাছ কাটবে না, রোপণও করবে। আমাদের বাঁচার জন্য যেমন অক্সিজেন প্রয়োজন, ঠিক তেমনি আমাদের চারপাশে অক্সিজেন তৈরির প্রাকৃতিক ফ্যাক্টরি গাছেরও প্রয়োজন। বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য দায়ী কার্বন অপসারণে গাছ ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

কারও দেওয়া একটি গাছ তার স্মৃতিচিহ্ন বহন করে। বিদ্যালয়ের দশ ক্লাসে যদি একজন শিক্ষার্থী দশটি গাছের চারা বিনা মূল্যে পেয়ে তার বাসায় বা জমিতে লাগিয়ে থাকে, যা তার স্কুলজীবনের একেক ক্লাসের স্মৃতি বহন করবে—এটি তার পিতামাতার কাছে যেমন আবেগের বিষয় হবে, ঠিক তেমনি তার পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও হবে আবেগের। যে আবেগ গাছটিকে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে এবং আমাদের পরিবেশে অবদান রাখতে সহায়তা করবে।

আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২০২২ সাল থেকে ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর হাতে একটি করে গাছের চারা উপহার দিয়ে আসছি এবং শিক্ষার্থীদের কাছে খোঁজ নিলে শুনি তাদের অধিকাংশের গাছগুলো বেঁচে আছে এবং অনেকের গাছই ফল দেওয়া শুরু করেছে, যা তাদের কাছে অনেক আনন্দের বিষয়। আবার অনেকে এ-ও বলেছে, আমার গাছ লাগিয়ে সে এত আনন্দ পেয়েছে যে নিজে আরও কয়েকটি গাছের চারা কিনে রোপণ করেছে, এখানেই আমার সার্থকতা।

আমার চেষ্টায় গাজীপুর জেলার ডিসি মহোদয়ের মাধ্যমে ২০২৩ সালে কয়েক হাজার গাছের চারা জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিতরণ করা হয়েছে, যা এ বছরও চলমান।
প্রতিবছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এদিন বিশ্বব্যাপী পরিবেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়ে থাকে। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুখের কথা চিন্তা করে ৫ জুন দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিবেশের বিপর্যয় এবং এতে আমাদের করণীয় বিষয়ের ওপর আলোচনা করে সব শিক্ষার্থীর হাতে একটি করে গাছের চারা হতে পারে উৎকৃষ্ট উপহার।

মো. আমিনুল ইসলাম
সহযোগী অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, গাজীপুর সরকারি মহিলা কলেজ