আমার মা একজন চা শ্রমিক। আমার মা আবার দল-মত বুঝে না। বুঝে শুধু পরিবারের হালটা টানবে কী করে? ছেলেমেয়েকে খাতা কলম দিতে পারবে কী না। দোকানিকে কী বলে বুঝ দেবে।
আজকাল মাকে নীরব থাকতে দেখি। দু-চোখে যেন অজানা বেদনা। জিজ্ঞেস করতেই বলে, ‘নিজেই বুঝি না, তকে কী বলব, বল বাবা।’
রাতে পাটিতে খেতে বসে আবার জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘কী বলব বাবা, দেশে এত কিছু পাল্টাচ্ছে, কিন্তু হামদের মজুরি নাই বাড়ছে, হাসপাতালের নাপা ছাড়া ভালো ওষুধ নাই মিলছে। হামার বাপ-দাদা চৌদ্দ সিঁড়ি, এখানেই থাকছি, কিন্তু হামদের জায়গাটাও আমার হামদের নামে নাই।’
আমি দেখছি, চারপাশে দল আর দল, মিছিল আর মিটিংয়ের ধুম। কিন্তু আমার কোথাও স্থায়ী ঠাঁই নেই। আমি যে ভূমিহীন। শুধু ভূমিহীনই নয়, আমার পূর্বপুরুষের নামেও ছিল না কোনো জমি। আমার দাদা ছিলেন চা শ্রমিক, আমার বাবা ছিলেন একজন চা শ্রমিক, এখন আমার মাও চা শ্রমিক। সেই কষ্টের জীবনটাই আমাদের চিরসঙ্গী। বাবার হাত ধরে যে পথে চলেছি, সেই পথও আজ বন্ধ। বাবাও আর নেই। এখন আমি একা। ভীষণ একা।
এখন যে কেউ চাইলে আমাদের তাড়িয়ে দিতে পারে, কারণ আমাদের কোনো দল নেই, কোনো ক্ষমতার জোর নেই। শুধু দাসত্ব আর বঞ্চনাই পেয়েছি আমরা।
যে সমাজে আমরা বেঁচে আছি, সেখানে দলবাজির উৎসব, অথচ আমার জন্য কোনো কিছুই নেই। দলের নামে অন্যরা কেবল নিজেদের স্বার্থ দেখছে, মিছিলের আড়ালে লুকিয়ে আছে তাদের ক্ষমতার লালসা। আমার বাবা, আমার পরিবার, আমরা কেবল শ্রম দিয়েছি, ঘাম ঝরিয়েছি, কিন্তু পেয়েছি কী?
এই দেশে, এই সমাজে, যেখানে সবাই নিজের শক্তি নিয়ে গর্ব করে, সেখানে আমার মতো একজন চা শ্রমিকের সন্তান কীভাবে মাথা তুলে দাঁড়াবে? আমার কষ্ট, আমার যন্ত্রণা, আমার সংগ্রাম কেউ দেখছে না। আমি একজন চা শ্রমিকের সন্তান—আমার কোনো দল নেই, আমার কোনো জমি নেই, আমার কোনো স্থায়ী ঠাঁই নেই। আমি শুধু বেঁচে আছি, খুঁজে চলেছি একটু আশ্রয়, একটু মানবিকতা, যেখানে আমি মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে পারব।
বিশাল নুনিয়া
ছাত্র, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর