কর্মস্থলে নিজেদের সন্তানকে কেন পাঠদানে শিক্ষকেরা অনুৎসাহী?

হো চি মিন ভিয়েতনামের স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরোধা ছিলেন। শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, আমরা যদি ১০ বছরের লাভের কথা চিন্তা করি তাহলে গাছ লাগাতে হবে (অর্থাৎ ভূমি কর্ষণ করতে হবে) আর ১০০ বছরের লাভের কথা চিন্তা করি তাহলে মানব কর্ষণ করতে হবে। মানব কর্ষণের ফলেই ভিয়েতনাম উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে অবস্থান করছে। যেমন তাঁদের মাথাপিছু আয় ৩৭৬০ এবং বাংলাদেশের ২৪৬৯ ডলার। আবার বলা হয়ে থাকে, ভিয়েতনামের স্কুলগুলো বিশ্বের সেরা স্কুল। অপরদিকে আমাদের দেশের শিক্ষার মান তলানিতে।

ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ২০২২ সালে একটি প্রতিবেদনে বলেছে, ১৯৬০-এর দশক থেকে ৮৭টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে ৫৬টি দেশের শিক্ষার গুণগত মান হ্রাস পেয়েছে। শিক্ষার গুণগত মান কমে যাওয়া দেশের মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত ও নাইজেরিয়া রয়েছে। আর যেসব দেশে শিক্ষার গুণগত মান বেড়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে পেরু, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম। এর ভেতর ভিয়েতনামের অবস্থা সবচেয়ে ভালো। প্রাথমিক শিক্ষায় বাংলাদেশ ভিয়েতনামের চেয়ে আরও পিছিয়ে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার যে করুণ অবস্থা, এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের প্রতি আলাদা নজর দিতে হবে। কেননা কর্তার ইচ্ছায় যে কর্ম। ভিত্তি শক্তিশালী হলে যেমন পুরো ভবন অনড় হয় তেমনি একজন শিক্ষার্থীর প্রাথমিক পাঠন পদ্ধতি যত যৌক্তিক হবে তাদের মৌলিক বিষয়াবলিও তত শক্তিশালী ও মজবুত হবে।

বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ভিয়েতনামের শিক্ষকদের তুলনায় কি কম? এই প্রশ্নগুলো সাধারণত অকপটে চলে আসে। কয়েক বছর আগে এইচএসসি পাসে মেয়েরা শিক্ষক হয়েছিলেন। সরকার সেই নিয়মের সংস্কার করেছে এবং বর্তমানে ন্যূনতম অনার্স পাস করেছে। এ ছাড়াও বর্তমান সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেভাবে শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে সেখানে মেধাবীরাই সুযোগ পাচ্ছে। তবুও কেন শিক্ষার মান কম, আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি? কারণ হিসেবে সাধারণত অবকাঠামো দুর্বলতা, পোষ্য কোটা, শিক্ষক ঘাটতি, বেতন কম, বাজেট কম, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব ইত্যাদি বিষয়ে জানি। অবশ্য এখানে শিক্ষকদেরও দায় রয়েছে। দায়টি হচ্ছে শিক্ষকেরা নিজেদের উপর আস্থা না রেখে সন্তানদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়াচ্ছেন। ফলে শ্রেণিকক্ষে এসে যতটুকু নিজেকে ঢেলে দেওয়া দরকার, সেখানে অনেক সময় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। শ্রেণিকক্ষে নিজেদের ছেলেমেয়ে থাকলে হয়তো আরও যত্নবান হতেন তাঁরা।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনের (জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়ন ২০২২) তথ্য বলছে, শিক্ষাক্রম অনুযায়ী যেসব যোগ্যতা বা দক্ষতা অর্জন করার কথা, তা অর্জন করতে পারছে না বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী। এর মধ্যে তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী শিক্ষাক্রম অনুযায়ী বাংলায় কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা বা দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। আর তৃতীয় শ্রেণির প্রায় ৬১ শতাংশ ও পঞ্চম শ্রেণির ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিতে শিক্ষাক্রম অনুযায়ী যোগ্যতা অর্জন করতে পারছে না।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার যে করুণ অবস্থা, এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের প্রতি আলাদা নজর দিতে হবে। কেননা কর্তার ইচ্ছায় যে কর্ম। ভিত্তি শক্তিশালী হলে যেমন পুরো ভবন অনড় হয় তেমনি একজন শিক্ষার্থীর প্রাথমিক পাঠন পদ্ধতি যত যৌক্তিক হবে তাদের মৌলিক বিষয়াবলিও তত শক্তিশালী ও মজবুত হবে।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক আছেন ৩ লাখ ৬২ হাজার ৭০৯ জন। বিপুলসংখ্যক শিক্ষক কিন্তু নিজেদের সন্তানদের নিজ কর্মস্থলে মানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ান না। কেন তাঁরা নিজ সন্তানদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াতে চান না? হাতে গোনা খুব কম শিক্ষক রয়েছেন, যারা আর্থিকভাবে একটু অসচ্ছল, শুধু তারাই নিজেদের সন্তানদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন। আর যাদের সামর্থ্য রয়েছে তাঁরা সন্তানদের পড়াচ্ছেন বেসরকারি নামি দামি প্রতিষ্ঠানে।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে কেন তাঁরা সন্তানদের নিজ কর্মস্থলে পড়াতে অনুৎসাহী? যে প্রতিষ্ঠানে তারা চাকরি করেন, সেখানে নিজের সন্তানদের পড়ালে ক্ষতি কোথায়? তার মানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও নিজেদের পাঠদান নিয়ে তাঁরা নিজেরাও সন্তুষ্ট নন। অন্যের সন্তানেরা যেখানে পড়তে পারছে, সেখানে কেন শিক্ষকেরা নিজেদের সন্তানদের পড়াতে রাজি হন না? প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওপর শিক্ষকদের এই আস্থাহীনতা খারাপ বার্তা দেয়। ফলে শিক্ষকদের বেতন ভাতা, সুযোগ-সুবিধা, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি বাড়ানোর পাশাপাশি শিক্ষকেরা যেন নিজেদের সন্তানদের নিজ কর্মস্থলে মানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ান সেই বিষয়টি যদি সরকার নিশ্চিত করতে পারে তাহলে প্রাথমিক স্কুলগুলোতে শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাবে।

মো. মমিনুর রহমান
শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর