চিঠিপত্র

ভিন্ন জেলায় চাকরি করা এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের কী অপরাধ

নিত্যপণ্যের দাম ক্রমে বেড়েই চলেছে। লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না কোনোভাবেই। বৈশ্বিক মন্দা, মুদ্রাস্ফীতি ও আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে দফায় দফায় দাম বাড়ানো হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের। দুই থেকে দশ গুণ পর্যন্ত দাম বেড়েছে অনেক পণ্যের। নিম্ন আয়ের মানুষের কী পরিস্থিতি, সে কথা বলে বোঝানোর সাধ্য আমার নেই। বরং মাসে ৫০ হাজার টাকা উপার্জন করা একজন ব্যক্তির সংসারের খরচ জোগাতেও চলে টানাপোড়েন।

কয়েক মাস আগের কথা। যখন দ্রব্যমূল্য এত চড়া ছিল না, অর্থাৎ ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর প্রথম আলো পত্রিকায় ‘পঞ্চাশ হাজার টাকা বেতনেও চালানো যাচ্ছে না সংসার’ ও ২০২২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি দেশ রূপান্তর পত্রিকায় ‘মাস চলে না  পঞ্চাশ হাজারেও’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তখনকার তুলনায় এখন দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। তাহলে এখন কী করে সংসার চালানো যায়? ব্যয় বেড়ে গেছে বহুগুণ, কিন্তু আয় বাড়েনি একটুও। বরং আয় কমে গেছে অনেকেরই।

মাধ্যমিক পর্যায়ের একজন এমপিওভুক্ত সহকারী শিক্ষক সাকল্যে প্রারম্ভিক বেতন পান মাত্র ১২ হাজার ৭৫০ টাকা। একটু উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন, ৫০ হাজার টাকাতেও যেখানে সংসার চালানো যায় না, সেখানে একজন শিক্ষক কীভাবে এত অল্প বেতনে সংসার চালাবেন? ধরেই নিলাম যে শিক্ষকতা যেহেতু পেশা নয় ব্রত, তাই শিক্ষকদের আমিষের প্রয়োজন নেই, শিক্ষকদের জন্য বিলাসিতাও নয়। তাই নিজ বাড়িতে বাস করে যাঁরা শিক্ষকতা করছেন, তাঁরা না হয় কচুপাতা, লাউপাতা, ডাল, ভর্তা দিয়ে মোটা চালের ভাত খেয়ে কোনোমতে জীবন বাঁচাবেন। কিন্তু যাঁরা নিজ বাড়ি থেকে ভিন্ন জেলায় ১০০ থেকে ৯০০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে শিক্ষকতা নামের ব্রত পালন করছেন, তাঁদের বেলায় কী উত্তর হতে পারে? তাঁদের কি খাবারের প্রয়োজন নেই? যদি থাকে, তবে সেটি কীভাবে?

আমি বাড়ি থেকে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার দূরে একটি দাখিল মাদ্রাসায় সহকারী শিক্ষক পদে সুপারিশ পেয়ে যোগদান করি।। এত দূরে নিয়োগ পেলেও নামমাত্র ১ হাজার টাকা বাড়িভাড়া পাই। অন্যান্য চাকরিতে বদলির ব্যবস্থা আছে। এমনকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিজ উপজেলাতেই নিয়োগ দেওয়া হয়, তবু তাঁদের বদলির ব্যবস্থা আছে। অথচ এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলির ব্যবস্থা নেই। কী নির্মম পরিহাস আমাদের সঙ্গে!

উল্লেখ্য যে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়োগ সুপারিশের ক্ষমতা এনটিআরসিএর হাতে যাওয়ার পর এখন পর্যন্ত তিনটি গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে হাজার হাজার শিক্ষক দেশের এক জেলা থেকে অন্য জেলায় গিয়ে চাকরি করছেন। আমিও তাঁদের মধ্যে একজন। আমি তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে চট্টগ্রাম জেলার দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের একটি দাখিল মাদ্রাসায় সহকারী শিক্ষক পদে সুপারিশ পেয়ে যোগদান করি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে। আমার প্রতিষ্ঠান থেকে আমার বাড়ির দূরত্ব প্রায় ৭০০ কিলোমিটার। এত দূরে নিয়োগ পেলেও নামমাত্র ১ হাজার টাকা বাড়িভাড়া আর ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা ছাড়া দুর্গম ও দ্বীপাঞ্চল হিসেবে ঝুঁকি ভাতাটাও পাই না। প্রতিষ্ঠান থেকেও কোনো সম্মানী দেওয়া হয় না। কেটেকুটে সাকল্য বেতন আমার ১২ হাজার ৭৫০ টাকাই। যোগদান করার পর ইতিমধ্যেই বাসভাড়া বেড়েছে দুইবার। আবার আমাকে সাগর পাড়ি দিতে হয় নৌযানে। সে নৌযানের ভাড়াও বেড়েছে তিনবার। আগে আমার একার বাড়ি যাওয়া-আসার জন্য ব্যয় হতো কমপক্ষে চার হাজার টাকা। এখন তা বেড়ে পাঁচ হাজারের ওপর লাগবে। ভোজ্য তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর হোটেলে নাশতা ও ফাস্ট ফুড-জাতীয় খাবারের দামও বেড়েছে। এখন আবার জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে কল্পনাতীতভাবে।

ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোতে নিম্ন আয়ের মানুষেরা রান্নায় তেলের ব্যবহার কমাতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু জ্বালানি তেলের ব্যবহার কমানোর উপায় নেই। তাই পণ্য পরিবহন ব্যয় বাড়ছে, কারখানার উৎপাদন খরচ বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রয়োজনীয় সব নিত্যপণ্যের দাম। এত কিছুর দাম বাড়লেও আমাদের বেতন কিন্তু একবারও বাড়েনি। এই স্বল্প বেতনে মাসে কিংবা দুই মাসে একবার বাড়ি যাওয়া-আসা, বাড়িভাড়া, খাবার, মোবাইল ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় খরচ বাবদ যে টাকা লাগে, তা কোনো কিছুতেই বেতনের সঙ্গে সামঞ্জস্য হচ্ছে না। এখানে কিছুতেই অঙ্ক মেলাতে পারি না। সরকার বাহাদুর, রাষ্ট্রনেতা, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক, সুশীল সমাজের কাছে আমার প্রশ্ন, আপনারা কি অঙ্ক কষে মিলিয়ে দিতে পারবেন আমার আয় ও ব্যয়ের হিসাব?
অন্য সব চাকরিতেই বদলির ব্যবস্থা আছে। এমনকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিজ উপজেলাতেই নিয়োগ দেওয়া হয়, তবু তাঁদের বদলির ব্যবস্থা আছে। অথচ এখানে বদলির ব্যবস্থাটুকুও নেই। কী নির্মম পরিহাস আমাদের পেশার সঙ্গে! কী দারুণ উপহাস আমাদের শিক্ষার সঙ্গে!

বলা যায়, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ওপর এক প্রকার অন্যায় হচ্ছে। আমাদের কী অপরাধ? নাকি আমরা নিরুপায় হয়ে এ পেশায় এসেছি, এটাই আমাদের অপরাধ? রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা কি এ কথা ভেবে দেখবেন না?

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে টিকে থাকার জন্য বেতন বাড়ানো প্রয়োজন। দেশের এত উন্নয়ন হচ্ছে। মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে এখন গাড়ি চলছে। কর্ণফুলী টানেলের কাজ প্রায় শেষ, মেট্রোরেল চূড়ান্ত উদ্বোধনের অপেক্ষায়, এক্সপ্রেস ওয়ে হচ্ছে, বড় বড় ফ্লাইওভার হচ্ছে। আরও কত কী! দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় উল্লিখিত পদক্ষেপ অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু মানুষের অস্তিত্বের চেয়ে বেশি নয়, কেননা অস্তিত্ব সারসত্তার পূর্বগামী।

সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ বলেছিলেন, ‘ধান দিয়া কী অইব জান যদি না থাকে।’ সবকিছুর আগে মানুষের বেঁচে থাকা। মানুষ যদি বেঁচেই না থাকল, তবে এত সব উন্নয়ন দিয়ে কী হবে? উন্নয়নের ফলইবা ভোগ করবে কে? তাই রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব তাঁর নাগরিককে বাঁচতে দেওয়া। সরকারের ভাষ্যমতে, বেতন বৃদ্ধির সঙ্গে সরকারের সক্ষমতার বিষয়টি জড়িত। যদি আর্থিক সক্ষমতা না থাকে, তবে মেনে নিলাম। কিন্তু সরকার বাহাদুর অন্তত দূরবর্তী বদলিপ্রত্যাশী এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাজেটবিহীন ঐচ্ছিক বদলির ব্যবস্থা চালু করতে তো আর্থিক সক্ষমতার প্রশ্ন থাকবে না। তাই সরকার বাহাদুর, রাষ্ট্রযন্ত্র, নীতিনির্ধারক ও সংশ্লিষ্ট যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের উচিত বেঁচে থাকার জন্য অন্তত বাজেটবিহীন ঐচ্ছিক বদলির সুযোগ প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কেননা, স্বল্প বেতনে নিত্যপণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে ভিন্ন জেলায় চাকরি করা এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা দিশাহারা।

মুহাম্মদ আলী
এমপিওভুক্ত সহকারী শিক্ষক
পূর্ব সন্দ্বীপ ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা
সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম।
(নিজ জলা: কুড়িগ্রাম)
aalinu21bangla@gmail.com