চিঠিপত্র

চাকরির পরীক্ষা কেন বিভাগীয় শহরে নেওয়া হবে না

বেকারদের একটি বড় অংশ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শেষ করে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ের চাকরিতে প্রবেশের চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু সমস্যা হলো চাকরির প্রায় সব পরীক্ষা ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় তা সদ্য বেকারদের জন্য এখন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের এবং তাঁদের কেউ কেউ স্নাতক পর্যায়ের শুরুতেই টিউশনসহ পার্টটাইম বিভিন্ন অফিসে কাজ করে নিজের ব্যয়ভার নিজেই বহন করতেন। স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করামাত্রই পরিবার থেকে আসে অসহনীয় চাপ। সরকারি চাকরি কবে হবে? এমনকি গ্রামের লোকজন এটাও মনে করতেন, বিশ্ববিদ্যালয় পড়লেই চাকরি নিশ্চিত!

অথচ তাঁরা জানতেন না যে সোনার হরিণখ্যাত সরকারি চাকরি পেতে হলে কী পরিমাণ অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামতে হয়। আর এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামার জন্য দরকার প্রচুর অর্থকড়ি। একজন নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সদ্য বেকারের পক্ষে কি এই বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগান দেওয়া আদৌ সম্ভব? উত্তর হলো—‘না।’ এরপর আবার এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার পরীক্ষা ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বেকার যুবকেরা এখন চাকরির পরীক্ষা দেওয়া চরম বিলাসিতা মনে করেন। যেখানে নিজের চলার পাথেয় সংগ্রহ করতে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে ঢাকায় গিয়ে পরীক্ষা দেওয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

শুধু কি তাই, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা বাদে অন্যান্য সব পরীক্ষা ঢাকা সিটি করপোরেশনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়ায় চাকরিপ্রার্থীদের বিভিন্ন সময় হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়। পরীক্ষার আগের রাতে ঢাকায় গিয়ে হোটেলে থাকা, খাওয়াদাওয়া এবং পরীক্ষার কেন্দ্রগুলো ঢাকা সিটির শেষ প্রান্তে হওয়ায় যাতায়াত ভাড়াও অত্যন্ত বেশি বহন করতে হয়। অনেক সময় চাকরিপ্রার্থীরা কেন্দ্রের সঠিক লোকেশন না জানার কারণে সিএনজি, পাঠাও বা উবারের ওপর নির্ভরশীল হতে হয় বড় অঙ্কের অর্থ দিয়ে। তাহলে চাকরি পাওয়া যেখানে জনসাধারণের অধিকার, সেখানে এত পরিমাণ আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য থাকে কীভাবে?

এতে চাকরিপ্রার্থীদের ভোগান্তি যেমন কমবে, তেমনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থানরত শিক্ষিত বেকার যুবকদের দুর্দশাও ঘুচবে। স্বাচ্ছন্দ্যে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোয় অংশ নিতে পারবে প্রান্তিক পর্যায়ের শিক্ষিত নারীরা। চাকরির পরীক্ষা দিতে বেগ পোহাতে হবে না কাউকে।

যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে ২৪–এর গণ–অভ্যুত্থান সংঘটিত হলো জনগণের আশা–আকাঙ্ক্ষার বাস্তব প্রতিফলন করবে বলে।

বিশেষ করে, ঢাকাকেন্দ্রিক চাকরির পরীক্ষা হওয়ায় দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের নারীদের চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয়। আর্থিক বিষয়াদির সঙ্গে তাঁদের নিরাপত্তার বিষয়টিও সংশ্লিষ্ট। নারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে অনেক অভিভাবক তাঁদের ঢাকা পাঠাতে নারাজ হন। আবার প্রায় সময় পাঠাতে বাধ্য হন, তখন তাঁদের সহযোগী হিসেবে একজনকে অবশ্যই পাঠাতে হয়। তাহলে একজনের খরচের হিসাবের দ্বিগুণ ব্যয় করতে হয় তাঁদের।

আমরা নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী, কিন্তু দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য নারীকে আমরা আর্থিক সমস্যা ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে তাঁদের আকর্ষণীয় চাকরির প্রতিযোগিতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখছি। এটি অবশ্যই নারীর ক্ষমতায়ন প্রসারের প্রতিবন্ধকতা। এসব প্রতিবন্ধকতার কারণে জেলা পর্যায়ের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া নারী শিক্ষার্থীদের অনেকেই ঢাকাকেন্দ্রিক চাকরির পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন না।

দেশের একমাত্র প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক রাজধানী ঢাকা। আয়তনে ঢাকা-চট্টগ্রামের তুলনায় অধিক ছোট। এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার কশাঘাতে ঢাকামুখী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে ঢাকার বাসিন্দাদের মধ্যে অসন্তুষ্টি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। নগর ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের অভাবে বাসযোগ্যতার মাপকাঠিতে ঢাকা দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে। সেখানে সব পরীক্ষা ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ায় বাইরের জেলা থেকে প্রতি সপ্তাহেই লাখখানেক চাকরিপ্রার্থী ঢাকায় আসছেন।

এতে ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা একেবারেই স্থবির হয়ে পড়ছে। দেখা দিচ্ছে আবাসনসংকট, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ নানাবিধ সমস্যা। তাই ঢাকাকে রক্ষায় সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও উন্নয়নকাজের কার্যকর বিকেন্দ্রীকরণের বিকল্প নেই। রাষ্ট্র সংস্কারের উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণের জন্য স্থানীয় সরকার শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে দেশের সব বিভাগীয় শহরে বিভাগীয় সদর দপ্তর স্থাপনের মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কার্যকর ভূমিকা রাখা এখন জনসাধারণের প্রাণের দাবি হয়ে উঠেছে।

এতে চাকরিপ্রার্থীদের ভোগান্তি যেমন কমবে, তেমনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থানরত শিক্ষিত বেকার যুবকদের দুর্দশাও ঘুচবে। স্বাচ্ছন্দ্যে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোয় অংশ নিতে পারবে প্রান্তিক পর্যায়ের শিক্ষিত নারীরা। চাকরির পরীক্ষা দিতে বেগ পোহাতে হবে না কাউকে।

  • রনি সরকার শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ।
    হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর।