উত্তরবঙ্গের বাঁচামরা দেখার কি কেউ নেই

নদী বয়ে চলে উজান থেকে ভাটির দিকে। প্রাকৃতিক এই নিয়মকে রাজনৈতিকভাবে বাধাগ্রস্ত করে চলেছে বাংলাদেশের উজানের দেশ ভারত। শুধু নৈতিকভাবে নয়, আন্তর্জাতিক সব বিধিবিধানকেও তোয়াক্কা করছে না তারা। একাধিক দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীকে আন্তর্জাতিক নদী বলা হয়ে থাকে। সেই বিবেচনায় ভারত থেকে বয়ে আসা ৫৪টি নদীই আন্তর্জাতিক নদী। কিন্তু ভারত সেগুলোর ওপর এক বা একাধিক বাঁধ দিয়ে পানির প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করেছে।

উজানে পানি প্রত্যাহারের কারণে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদীর মরণদশা হয়। আর বর্ষায় উজানের পানিতে নদীর তীরে বন্যা ও ভাঙনে নিঃস্ব হচ্ছে মানুষেরা। তিস্তাপারের রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার মানুষের দীর্ঘদিনের এ দুর্ভোগ শেষ হবে কবে? কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী বা সিলেটের বন্যা মানুষের মনে সাড়া জাগাতে পারলেও পারেনি রংপুরের লালমনিরহাটের বন্যার্তদের আর্তনাদ। উত্তরবঙ্গ বাংলাদেশে প্রবেশ করবে কবে? উত্তরবঙ্গের বাঁচামরা দেখার কেউ নেই! নাকি উত্তরের মানুষ খেটে খায় এ জন্যই অবজ্ঞা!

তিস্তার উজানে ভারত গজলডোবা বাঁধ নির্মাণ করেছে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো, ভারতীয় অংশে সেচের সম্প্রসারণ। এই বাঁধ দিয়ে প্রথম পর্যায়েই প্রায় ১০ লাখ হেক্টর, অর্থাৎ ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় সেচ দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। সে জন্য ২১০ কিলোমিটার দীর্ঘ খাল করা হয়েছে। এসব খাল একদিকে পশ্চিম-দক্ষিণে অগ্রসর পশ্চিমবঙ্গের মালদহ এবং মুর্শিদাবাদ জেলা পর্যন্ত পৌঁছেছে, অন্যদিকে পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহার জেলা পর্যন্ত গেছে। অর্থাৎ গজলডোবা বাঁধ একটি বিস্তৃত পরিধিতে সেচ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে নির্মিত হয়েছে।

এই বাঁধের মাধ্যমে ভারত কর্তৃক তিস্তার পানি অপসারণের কোনো উচ্চসীমা নির্ধারিত নেই। ফলে ভাটির দেশের কথা কোনোভাবেই বিবেচনায় না নিয়ে নতুন নতুন খাল খননের মাধ্যমে ভারত তিস্তা নদীর পানি অপসারণের ক্ষমতা বাড়িয়েই চলেছে। আর বাংলাদেশ অঞ্চলে তিস্তা হারাচ্ছে তার বেঁচে থাকার মতো পানি।

শুষ্ক মৌসুমে এই নদ-নদীগুলোর জলের জন্য চাতক পাখির মতো সীমান্তের ওপারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। কিন্তু বর্ষায় অতিরিক্ত পানি হলে বিনা নোটিশে গজলডোবায় কপাট খুলে দিলে তিস্তাপারের রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েন। জলকপাট খুললেই সবকিছু ধুয়েমুছে নিয়ে যায়। অনেকে ঘরবাড়ি ও ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যান।  

তিস্তা মহাপরিকল্পনা কি কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকবে? অভিন্ন নদী হিসেবে ভারতের সঙ্গে ন্যায্য হিস্যার ভিত্তিতে তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন করতে হবে। তিস্তা নদীতে সারা বছর পানির প্রবাহ ঠিক রাখতে জলাধার নির্মাণ, তিস্তা নদীর শাখা-প্রশাখা ও উপশাখাগুলোর সঙ্গে নদীর পূর্বেকার সংযোগ স্থাপন ও নৌ চলাচল পুনরায় চালু করতে হবে। বন্যা এবং নদীভাঙনের শিকার ভূমি-গৃহহীন ও মৎস্যজীবী মানুষের পুনর্বাসন, তিস্তা নদী ও এর তীরবর্তী কৃষকদের স্বার্থ সুরক্ষায় কৃষক সমবায় ও কৃষিভিত্তিক শিল্পউদ্যোগ গড়ে তুলতে হবে।

জলকপাটগুলোকে প্রকৃতিবিরোধী বলছেন নদীজন ও গবেষকেরা। গজলডোবা থেকে ডালিয়া পর্যন্ত বিপুল এলাকা খোদ ভারতেই বালুকাময়। পানিশূন্য তিস্তা। আবার যতটুকু পানি আসে সেটিও ক্যানেল দিয়ে ঠেলে সেচ প্রকল্পে নিয়ে যাওয়ায় তিস্তা ব্যারাজের দক্ষিণে চিলমারী পর্যন্ত ভীষণ খরায় থাকে তিস্তা। বর্ষা মৌসুমে কী হয় তাতো আমরা দেখছিই। এক বছরে চারবার বন্যা দেখল রংপুরবাসী। এ রকমই তো প্রতি বছর হয়ে আসছে।

১০ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রংপুর ভ্রমণ করেন। এ সময় তিনি রংপুর জেলাকে এক নম্বর করার প্রতিশ্রুতি দেন যা নিশ্চয়ই প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু কবে এই প্রতিশ্রুতি পালন হবে? অধীর অপেক্ষায় উন্নয়ন বৈষম্যে তলানিতে পরা রংপুরবাসী।

  • মো. আনোয়ার হোসেন
    শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।