বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনা কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। প্রতিটি ঘটনা শুধু একটি পরিবার বা শিক্ষাঙ্গনের জন্য শোকের কারণ নয়, এটি আমাদের শিক্ষা ও মানসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার বড় ধরনের ফাঁকফোকরগুলোর দিকেও ইঙ্গিত করে। আত্মহত্যা নিছক একটি ঘটনা নয়; এটি দীর্ঘমেয়াদি মানসিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত প্রকাশ। এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি কেন হচ্ছে, কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এমন চরমপন্থা অবলম্বন করছেন, এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও তাঁদের চারপাশের পরিবেশ গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে নানা কারণে মানসিক চাপ বাড়ছে এবং এটি কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায় নয়। পারিবারিক চাপ, সমাজের প্রত্যাশা, কর্মজীবনের অনিশ্চয়তা ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের জটিলতা শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা বিপর্যস্ত করে তুলছে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার বেশ কয়েকটি সমস্যা রয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতিতে ভূমিকা রাখছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পর থেকেই শিক্ষার্থীরা একটি প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে নিজেদের টিকিয়ে রাখার চাপে থাকেন। উচ্চ নম্বর পেতে হবে, ভালো ফলাফল করতে হবে, চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে—এই দুশ্চিন্তাগুলো তাঁদের মানসিক চাপের অন্যতম প্রধান কারণ। অধিকাংশ শিক্ষার্থী নিজেদের শখ বা ব্যক্তিগত আগ্রহে সময় দিতে পারেন না, বরং তাঁরা একটি নির্ধারিত লক্ষ্য পূরণের দৌড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ফলস্বরূপ মানসিক বিশ্রামের সময় কমে যায় এবং বিষণ্নতা বা হতাশার মতো সমস্যা দেখা দেয়।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সহযোগিতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেই। যদিও কিছু প্রতিষ্ঠানে কাউন্সেলিং সেবা চালু রয়েছে, তা পর্যাপ্ত নয় এবং শিক্ষার্থীরা প্রায়ই মানসিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমস্যাগুলো লজ্জার কারণে প্রকাশ করতে চান না। এই সংকোচের কারণে তাঁরা প্রয়োজনীয় সাহায্য থেকে বঞ্চিত হন।
শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপের একটি বড় অংশ আসে পারিবারিক ও সামাজিক প্রত্যাশা থেকে। বিশেষ করে বাংলাদেশে পরিবার ও সমাজ শিক্ষার্থীদের ওপর উচ্চ প্রত্যাশা আরোপ করে। তাঁদের অনেক সময় এই চাপ সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে, বিশেষত যদি তাঁরা একাধিক ক্ষেত্রে ব্যর্থতার সম্মুখীন হন। এ ধরনের চাপ শিক্ষার্থীদের মানসিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করে এবং তাঁরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা শেষে কর্মজীবনে প্রবেশের জন্য প্রস্তুতি নেন, কিন্তু দেশের কর্মসংস্থানের বর্তমান পরিস্থিতি তাঁদের মধ্যে অনিশ্চয়তা ও হতাশা তৈরি করছে। চাকরির বাজারে প্রচণ্ড প্রতিযোগিতা ও মেধা অনুযায়ী কাজের সুযোগের অভাব তাঁদের আত্মবিশ্বাস ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে শঙ্কিত করে তোলে। অনেকেই নিজেদের অযোগ্য বলে ভাবতে শুরু করেন, যা তাঁদের আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ন করে এবং মানসিক ভারসাম্যহীনতার দিকে ঠেলে দেয়।
শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা ঠিক রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। মানসিক সেবা সহজলভ্য করা, সচেতনতা কর্মসূচি চালানো ও শিক্ষার্থীদের জন্য সহানুভূতিশীল ও সহায়ক পরিবেশ গড়ে তোলা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পেশাদার কাউন্সিলর ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা উচিত, যাঁরা শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ মোকাবিলায় কার্যকর পরামর্শ দিতে পারবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক অবনতির কারণ বহুমুখী ও জটিল। শিক্ষার্থীরা উচ্চ প্রত্যাশা, সামাজিক চাপ ও ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে মানসিক সমস্যায় পড়ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়, পরিবার ও সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ সমস্যাগুলোর সমাধান করা সম্ভব। মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিয়ে, শিক্ষার্থীদের সঠিক সময়ে সহযোগিতা প্রদান করলে আত্মহত্যার মতো মর্মান্তিক ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যের চর্চা জরুরি ভিত্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার, যাতে শিক্ষার্থীরা তাঁদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে সাফল্য অর্জন করতে পারেন।
হৃদয় পান্ডে
শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা কলেজ