অতি সম্প্রতি লেজুড়বৃত্তি রাজনীতির অভিযোগ এনে ছাত্র অধিকার পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বিপুলসংখ্যক নেতা একযোগে পদত্যাগ করেন। তাই দলীয় লেজুড়বৃত্তিক কর্মকাণ্ড তথা বর্তমান ছাত্ররাজনীতি আবারও আলোচনার তুঙ্গে। লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির ছোবলে বিপন্ন সাধারণ শিক্ষার্থীজীবন। এর উত্থান ও উত্তাপের দায় কি আদৌ এড়াতে পারে মূল রাজনৈতিক দলগুলো? নির্বাচন কমিশন খাতা–কলমে ছাত্রসংগঠনকে মূল দলের অঙ্গসংগঠন হিসেবে বাদ দিতে পারলেও কার্যত তা বাদ যায়নি। এর জন্য দায়ী বড় দুটি রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারকেরা।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ২৫ ধারার (২)(ক)–তে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগকে নিজ নিজ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পরিচালিত হবে বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু তারা ছাত্রলীগকে অঙ্গসংগঠন থেকে বাদ দিলেও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হিসেবে রেখে দিয়েছে এবং স্বীকার করে।
একইভাবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) গঠনতন্ত্রের ধারা ১০ পড়লেই দেখা যায়, কীভাবে সুচতুরভাবে অঙ্গসংগঠন থেকে বাদ দিয়ে ছাত্রদলকে নীতি, আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচিতে বিশ্বাসী হিসেবে সহযোগী সংগঠন হিসেবে রেখে দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের প্রতিষ্ঠার ঘোষণাপত্র, গঠনতন্ত্রের প্রস্তাবনা ও অনুচ্ছেদ ৮ (লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য)–এর ১ নম্বর ধারায় দলীয় দাসত্ব ও লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির বাইরে স্বাধীন ধারায় ছাত্ররাজনীতি চর্চার মাধ্যমে ছাত্রদের যৌক্তিক দাবি ও ন্যায়সংগত অধিকার আদায়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করার কথা বলা হয়েছে।
অথচ চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, বদলি বাণিজ্য, ক্ষমতার লড়াই, হল দখলসহ অপরাধের সব শাখায়ই রয়েছে ছাত্রনেতাদের অবাধ বিচরণ। অপরাধের বৃত্তে বন্দী এখন ছাত্ররাজনীতি। স্বার্থ নিয়ে অন্তঃকলহ আর সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছেন তাঁরা। আর এর শিকার হচ্ছেন একের পর এক শিক্ষার্থী। ঘটছে ইতিহাসের জঘন্যতম কিছু হত্যাকাণ্ড। প্রতিটি সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই সরকার–সমর্থক ছাত্রসংগঠন এসবে জড়িয়ে পড়ছে। এভাবে লাশের মিছিল বেড়েই চলেছে।
এ রকম উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের গঠনতন্ত্রে ছাত্রসংগঠনকে অঙ্গসংগঠন থেকে বাদ দিয়ে সহযোগী সংগঠন হিসেবে রাখলেও আগের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। দলীয় স্বার্থে ছাত্রদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করতে তাদের লেজ হিসেবে রেখে দিয়েছে। ফলে যতই সুষ্ঠু রাজনীতির চেষ্টা করা হোক না কেন, তা বৃথা।
তাহলে এ থেকে উত্তরণ কীভাবে? তাহলে ভিন্নধারা বা নতুন ধারার রাজনীতিই কি পারে লেজুড়বৃত্তি রাজনীতির থাবা থেকে বাঁচাতে? চলুন দেখি। বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত ও মূল দুটি দল হলো ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল। আছে কিছু বাম ছাত্রসংগঠন। এর বাইরে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সংগঠন ছাত্র অধিকার পরিষদে কিছুটা আশা আলো জ্বেলেছিল নতুন ধারার রাজনীতি সামনে এনে। তারা বারবার বলে এসেছে ছাত্র অধিকার পরিষদ ভিন্নধারার রাজনৈতিক সংগঠন এবং তাদের অবস্থান সব ধরনের লেজুড়বৃত্তি রাজনীতির বিপক্ষে। কিন্তু কার্যত কি তা-ই ছিল? সম্প্রতি দলটির গঠনতন্ত্রের প্রস্তাবনা ও অনুচ্ছেদ ৮–এর ১ নম্বর ধারা লঙ্ঘন করে কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কর্তৃক গণ অধিকার পরিষদের লেজুড়বৃত্তি করার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা গণপদত্যাগ করে। অর্থাৎ বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতিতে ভিন্ন বা নতুন ধারা বলতে কিছু নেই, লেজুড়বৃত্তি ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতে থাকবে, যদি না আশু কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া যায়।
আজকের এই কলুষিত লেজুড়বৃত্তি ছাত্ররাজনীতি এক দিনে তৈরি হয়নি। এর বর্তমান অবস্থা অনেক প্রেক্ষাপট, ঘটনা এবং অভ্যুত্থানের সমষ্টি। দুর্বৃত্তায়িত ও লেজুড়বৃত্তির কারণেই ছাত্ররাজনীতির এ হাল। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে এগিয়ে আসতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনির্ধারকদের। প্রতিটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ গঠন করে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখা যেতে পারে। এতে শিক্ষার্থীরা সুষ্ঠু ধারার রাজনীতি চর্চা করে শিখবে। প্রতিটি ক্যাম্পাস থেকে দাবি উঠুক ‘ছাত্র সংসদ চাই।’
তামান্না আক্তার
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়