চিঠিপত্র

নতুন উপাচার্যের কাছে কেমন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় চান শিক্ষার্থীরা

জুলাই ২৪–এর গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা পেয়েছি এক নতুন বাংলাদেশ। আর নতুন বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরে লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। এই পরিবর্তনের ছোঁয়া থেকে বাদ যাচ্ছে না আমাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও। শিক্ষার্থীদের তালিকাভুক্তি অনুযায়ী পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় হয়েও বাংলাদেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচিত হয়েছে বেকার তৈরির কারখানা হিসেবে। যাঁরাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দায়িত্বে এসেছেন, তাঁরাই এটিকে প্রাইভেট কোচিং সেন্টারের মতো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এতে করে একদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝুলিতে জমা পড়েছে কিছু তিরস্কার আর শিক্ষার্থীদের ঝুলিতে জমা হয়েছে বেকারত্বের অভিশাপ।

এ দেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সব দিক থেকেই বৈষম্যের স্বীকার হতে হয়। এ ছাড়া দেশের সাধারণ মানুষ থেকে সুশীল সমাজ—সবারই রয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। তাঁরা মনে করেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা মানেই মেধাবী শিক্ষার্থী নন।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে যে অভাবগুলো বেশি হতাশায় ভোগায়, তা হলো প্রায় ক্যাম্পাসেই নেই কোনো হার্ড বা সফট স্কিল ডেভেলপ করার মতো ক্লাব। নেই কোনো প্রেজেন্টেশন প্রোগ্রাম কিংবা কমিউনিকেশন ডেভেলপ করার ব্যবস্থা। নেই কোনো এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিজ শেখার ব্যবস্থা। যেখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ৪ বছরে ১৬টি প্রেজেন্টেশন দিয়ে থাকেন, সেখানে আমাদের অনেক শিক্ষার্থী জানেনই না, প্রেজেন্টেশন নামের কোনো প্রোগ্রাম আছে। যদিও বর্তমানে বছরে দুটি করে প্রেজেন্টেশন নেওয়ার কথা আছে, তবে দৃশ্যমান হচ্ছে না কিছুই।

এতে করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভালো বিষয়ে পড়াশোনা করলেও পড়ালেখার বাইরে আর কিছুই শিখতে পারছেন না। যেখানে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইতিমধ্যেই ওপরে উল্লিখিত সমস্যাগুলোর সমাধান করে শিক্ষার্থীদের হাতে–কলমে শিক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে। সেখানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এখনো আমাদের একটা সুন্দর শিক্ষাপদ্ধতি দিতেই ব্যর্থ।

একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থীই দরিদ্র পরিবার থেকে আসা। তাঁদের পারিবারিক মাসিক আয় ১০ হাজার টাকার কম। আর ১০ থেকে ৪০ হাজার টাকা মাসিক আয়, এমন পরিবারের শিক্ষার্থীসংখ্যা ৪৯ শতাংশ। সে হিসাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থীর পারিবারিক মাসিক আয়ের পরিমাণ ৪০ হাজার টাকার কম। ৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর পরিবারের আয় ৪১ থেকে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত। আর ৬০ হাজার টাকার বেশি আয় রয়েছে, এমন পরিবারের শিক্ষার্থী রয়েছেন মাত্র ২ শতাংশ। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তার নিজের গতিতে চলছে।

ইউজিসির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর পেছনে যেখানে সরকার ব্যয় করে কয়েক লক্ষাধিক টাকা, সেখানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পেছনে ব্যয় করা হয় মাত্র ১ হাজার ১৫১ টাকা। শুধু বাজেটেই নয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অবহেলিত চাকরির বাজারেও। কারণ, সবাই ভাবেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মানেই মেধাবী নন। পরীক্ষকেরা জীবনবৃত্তান্তে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দেখে শুরুতেই ধারণা করেন, এই প্রার্থী ততটা অভিজ্ঞ নন।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই ব্যর্থতার দায় এড়িয়ে যেতে পারবেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বরত হর্তাকর্তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই কোনো শিক্ষার্থীবান্ধব নিয়মকানুন। যখন মন চায়, ফরম পূরণের সময় সূচি দেয়; যেমন মন চায়, তেমন সেশন ফি ধরা হয়, পরীক্ষার রুটিন পর্যন্ত বিষয় বিবেচনা করে তৈরি করা হয় না। এ ছাড়া সেশনজট, পরীক্ষার খাতা কাটায় অযত্ন, ভুতুড়ে রেজাল্ট, রেজাল্ট প্রকাশ করতে দীর্ঘ সময় নেওয়া, সমাবর্তন অনুষ্ঠান না করা, শিক্ষকদের আন্তরিকতার অভাবসহ এ রকম শতাধিক অনিয়ম তো আছেই। মূলত যত দিন এসব সমস্যার সমাধান না হবে, তত দিন আমি অন্তত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতি দেখছি না।

তাহলে কীভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এসব সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে? আমাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে প্রথমেই সেশনজট নিরসনে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। একজন শিক্ষার্থীকে যদি চার বছরের অনার্স শেষ করতে ছয় বছর অপেক্ষা করতে হয়, তখন দেখা যায় চাকরির জন্য নির্ধারিত বয়স থেকে তার দুই বছর কমে যায়। এতে করে ভেঙে পড়েন শিক্ষার্থীরা।

দ্বিতীয়ত, গতানুগতিক শিক্ষার বাইরে গিয়ে প্রতিটি ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোর্স চালু করা। যেমন ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থীদের শুধু গতানুগতিক সাহিত্য পড়ানো হলেও নেই কোনো গ্ল্যামার কোর্স, নেই কোনো ভাষা উন্নয়ন কোর্স। এতে দেখা যাবে, একজন শিক্ষার্থী ইংরেজি বিষয়ে অনার্স শেষ করে ৫-১০ লাইন ইংরেজি বলতে পারেন না।

তৃতীয়ত, প্রতিটি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের স্কিল ডেভেলপমেন্টের জন্য বিভিন্ন ধরনের ক্লাব প্রতিষ্ঠিত করা। এর মধ্যে অন্যতম ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব, ডিবেট ক্লাব, কালচারাল ক্লাব, ম্যাথ ক্লাব, রিসার্চ ক্লাব ইত্যাদি। এ ছাড়া আরও যে বিষয়গুলো এই তৃতীয় পার্টে রাখা যায়, তা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পাবলিক স্পিকিংয়ের দক্ষতা উন্নয়ন, লিডারশিপ, প্রেজেন্টেশন স্কিল বৃদ্ধি, কেস স্টাডি শেখানোর ব্যবস্থা করা।

চতুর্থত, যেসব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত, সেগুলো হচ্ছে অভিজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগ, আধুনিক সেমিনার হল তৈরি করা, বড় ক্যাম্পাসগুলোতে বাস সার্ভিস চালু করা, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু করা, উপস্থিতির হার বাড়ানোর ব্যবস্থা করা, ল্যাব ফ্যাসিলিটিজ বাড়ানো এবং রিসার্চের ওপর গুরুত্ব দেওয়া। সর্বশেষ একটি বিষয়কে আলাদাভাবে বলতেই হয়, সেটি হচ্ছে ভুতুড়ে রেজাল্ট প্রকাশ বন্ধ করা। নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। আমাদের ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের খুব সহজ একটি কোর্স হচ্ছে অ্যাডভান্স রিডিং অ্যান্ড রাইটিং। যেটি মোটামুটি সহজেই পাস করা যায়।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমাদের এক রুম থেকে একই সাবজেক্টে ৩০ জনের বেশি শিক্ষার্থী ফেল করেছেন। এ ছাড়া এবারের অনার্স চতুর্থ বর্ষের রেজাল্ট আমাকে আরও বেশি ভাবিয়েছে, তা হলো চতুর্থ বর্ষে এসেও ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থীর ফেল করা। অনেক শিক্ষার্থীকে দেখা যাচ্ছে ব্যক্তিগত ক্ষোভ প্রকাশ করতে।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মাথায় রাখা উচিত, চতুর্থ বর্ষের একজন শিক্ষার্থী ফেল করা মানে তাঁর একটি বছর বরবাদ হওয়া। আমি বলছি না যে ফেল করা শিক্ষার্থীকেও পাস করিয়ে দেওয়া হোক, আমি বলছি অন্তত খাতাগুলোর যথাযথ মূল্যায়ন করা হোক।

নিজের চোখেই দেখেছি, অনেক শিক্ষক ফাইনাল পরীক্ষার খাতা শিক্ষার্থীদের হাতে কাটিয়েছেন। এতে করে খাতার সঠিক মূল্যায়ন নিশ্চিত করা হয় না। এ ছাড়া বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে তাদের শিক্ষার্থীদের নিয়ে নিয়মিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, সেখানে আমাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব বিষয়ে কোনো চিন্তা নেই বললেই চলে।

তাই আমরা চাইব, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবার অন্তত কোচিং সেন্টারের মতো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের চিন্তা থেকে বেরিয়ে শিক্ষার্থীদের মেধা উন্নয়নে এবং তাঁদের স্কিল ডেভেলপমেন্টের দিকে নজর দেবে। এতে ইতিবাচক পরিবর্তন হবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এবং পরিবর্তন হবে দেশের।

মো. রাকিব
শিক্ষার্থী- ইংরেজি বিভাগ, অনার্স তৃতীয় বর্ষ
সরকারি সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম।