মতামত

স্বাস্থ্য ও সুস্থতায় প্রয়োজন খেলার মাঠ

ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। আধুনিকতার সঙ্গে ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটিয়ে একটি জনবহুল নগরী হিসেবে গড়ে ওঠেছে ঢাকা। দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে ঢাকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শহরের উন্নয়ন এবং দ্রুত নগরায়ণের ফলে খেলার মাঠের অভাব একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। খেলার মাঠ কেবল ক্রীড়া ও বিনোদনের স্থান নয়; এটি শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখার, সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলার এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেসব কারণে প্রয়োজন আমাদের খেলার মাঠ যেমন,

১. স্বাস্থ্য ও সুস্থতা: শারীরিক স্বাস্থ্য রক্ষায় খেলাধুলার ভূমিকা অপরিসীম। নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ যেমন খেলা, মানুষকে হৃদ্‌রোগ, ডায়াবেটিস এবং স্থূলতার মতো রোগ থেকে রক্ষা করে। ঢাকায় শিশুদের জন্য খেলার মাঠের অভাব তাদের শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করছে। মাঠে খেলাধুলার সুযোগ না পেলে শিশুরা গৃহবন্দী হয়ে পড়ে, যা তাদের শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত খেলাধুলা শিশুদের শারীরিক স্বাস্থ্য ও বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখে। খেলার মাঠের অভাবে শিশুদের মধ্যে শারীরিক অসুস্থতা, মানসিক চাপ এবং উদ্বেগের মতো সমস্যা বাড়ছে।

২. সামাজিক সম্পর্ক: ব্যস্ততম এই ঢাকায় সামাজিক সম্পর্কের অবস্থা শোচনীয়। খেলার মাঠগুলো কেবল খেলার জন্য নয় বরং সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করার স্থানও। বন্ধুদের সঙ্গে খেলা, স্থানীয় টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ এবং সমাজের সঙ্গে মেলামেশা তরুণদের মধ্যে সেতুবন্ধন গড়ে তোলে। মাঠের অভাবে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে একাকিত্ব এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে, যা সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। এ ছাড়া খেলার মাঠ সামাজিক ন্যায় এবং সমতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। মাঠে বিভিন্ন পটভূমির মানুষ একত্রিত হয় এবং তারা একে অপরের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে, যা সমাজের একতা বাড়ায়।

৩. মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব: মানসিক সুস্থতা শারীরিক সুস্থতার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে খেলাধুলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খেলাধুলার মাধ্যমে মানসিক চাপ কমে, আত্মবিশ্বাস বাড়ে এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা উন্নত হয়। ঢাকার বর্তমান পরিস্থিতিতে যুবকদের মানসিক চাপের মাত্রা বাড়ছে। বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। যদি তাদের জন্য পর্যাপ্ত খেলার মাঠের ব্যবস্থা করা না হয়, তবে এটি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। খেলা, বিশেষ করে দলভিত্তিক খেলা মানুষের মধ্যে সহযোগিতা এবং সম্প্রীতির অনুভূতি তৈরি করে, যা মানসিক সুস্থতার জন্য অপরিহার্য।

৪. ক্রীড়া প্রতিভার বিকাশ: ঢাকা শহরে অনেক সম্ভাবনাময় ক্রীড়াবিদ রয়েছে, যারা যথাযথ সুযোগ না পাওয়ার কারণে নিজেদের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারছে না। খেলার মাঠের অভাবে প্রতিযোগিতামূলক খেলার সুযোগ মিলছে না, যা ভবিষ্যতের ক্রীড়া তারকাদের তৈরি হতে বাধা দিচ্ছে। দেশের ক্রীড়া ক্ষেত্রে প্রতিভাবান খেলোয়াড় তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। আন্তর্জাতিক স্তরে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য আরও বেশি খেলোয়াড় তৈরি করা প্রয়োজন এবং এর জন্য মাঠের গুরুত্ব অপরিসীম।

৫. সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য : ক্রীড়া কেবল শারীরিক কার্যকলাপ নয়; এটি আমাদের সংস্কৃতির একটি অংশ। খেলার মাঠে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন স্থানীয় টুর্নামেন্ট এবং উৎসবগুলো সমাজের ঐক্য ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। ঢাকায় পর্যাপ্ত খেলার মাঠ না থাকায় এই সংস্কৃতির বিকাশও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। স্থানীয় ক্রীড়া অনুষ্ঠান এবং ঐতিহ্যগুলো যুবকদের মধ্যে সংস্কৃতির মূল্যবোধ জাগ্রত করতে সাহায্য করে। মাঠের অভাবে এই ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

৬. অবকাঠামোগত উন্নয়ন: ঢাকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন শুধুমাত্র ভবন ও সড়ক নির্মাণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবে শহরের সুষম উন্নয়নে খেলার মাঠের নির্মাণও অত্যন্ত জরুরি। প্রতিটি আবাসিক এলাকা এবং পাড়া-মহল্লায় খেলার মাঠ তৈরি করলে নাগরিক জীবনের মান বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়াও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাঠগুলোর উন্নয়ন করা হলে এগুলো আরও কার্যকরী হতে পারে। পর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং সুবিধাসম্পন্ন খেলার মাঠ শহরের উন্নয়নকে সমর্থন করবে।

উক্ত পরিস্থিতিতে কী কী সমাধান এবং উদ্যোগ নিতে হবে তা বিশ্লেষক ও নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে। ঢাকা শহরের খেলার মাঠের অভাব মেটাতে সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনের উচিত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নগর-পরিকল্পনার অংশ হিসেবে খেলার মাঠ নির্মাণে বরাদ্দ রাখা এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও যদি পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে খেলার মাঠ নির্মাণে সহযোগিতা করে, তবে এটি একটি সমন্বিত উদ্যোগ হতে পারে। স্থানীয় কমিউনিটির মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে খেলাধুলার গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা দেওয়া উচিত। শহরের সুষম উন্নয়ন এবং তরুণ প্রজন্মের সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য খেলার মাঠের গুরুত্বকে সকলের কাছে তুলে ধরা দরকার।

রাকিব হাসান

সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ