বন্যাকবলিত জেলায় রয়েছে মারাত্মক ডেঙ্গুঝুঁকি

চলছে ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস মশার প্রজননকাল। জুন মাস থেকে শুরু হয় এর প্রজনন, চলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারাসাইটোলজি বিভাগের একজন অধ্যাপকের গবেষণালব্ধ তথ্যমতে, এডিস ইজিপ্ট এবং এডিস অ্যালবোপিক্টাস নামক দুটি প্রজাতির মশা ডেঙ্গু রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে। এদের মধ্যে এডিস অ্যালবোপিক্টাসকে বলে গ্রাম্য মশা, যা গ্রামে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বদ্ধ স্বচ্ছ পানির উৎস পেলেই বংশবৃদ্ধি করতে সক্ষম। উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে গাছের গর্ত, ভাঙা রাস্তা, ডোবার পানি ইত্যাদি।

সম্প্রতি বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জেলার ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় অর্ধকোটি মানুষ। দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১১টি জেলা বন্যাপ্লাবিত এবং পানিবন্দী পরিবারের সংখ্যা এখন পর্যন্ত ১০ লাখ ৯ হাজার ৫২২। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৫৪ লাখ ৬৪ হাজারের বেশি। সব কটি জেলায় এখনো বন্যার পানি পুরোপুরি নেমে যায়নি। কয়েকটি স্থানে হঠাৎ হঠাৎ হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিও হচ্ছে। ফলে অনেক জায়গায় পানি নেমে গেলেও রয়ে যাচ্ছে জলাবদ্ধতা। দীর্ঘদিন ধরে পানি জমে থাকছে। বন্যার কারণে জমে থাকা এসব পানিই হয়ে উঠতে পারে এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র ।

দেশে ডেঙ্গু ভাইরাস শনাক্ত হয় ১৯৯৯ সালে। বলা বাহুল্য, কয়েক বছর আগেও ডেঙ্গু রোগ শুধু ঢাকা শহরের মধ্যেই সীমিত থাকলেও এখন বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাতেই তা ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিবছর এডিস মশার ঘনত্ব কয়েক গুণ বাড়ে। এডিস মশা ডিম পাড়ে পানিসংলগ্ন ভেজা জায়গাগুলোতে এবং এদের লার্ভা বিকশিত হয় পানিতে। কয়েক মাস আগে শুষ্ক স্থানে পেড়ে রাখা ডিমও পানির সংস্পর্শে এলে তা থেকে নতুন মশার জন্ম হতে পারে; অর্থাৎ একে তো প্রজনন মৌসুম, তার ওপর পানিবন্দী অবস্থা। সুতরাং বন্যাকবলিত জেলার মানুষেরা ভয়াবহ ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছেন।

উল্লেখ্য, এবারের অভূতপূর্ব বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যেমন বেশি, মৃত্যুর সংখ্যাও কম নয়। সরকারি হিসাবে, শনিবার পর্যন্ত ৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। বহু মানুষের ঘরবাড়ি এখন কেবলই ধ্বংসস্তূপ। আকস্মিক এই বন্যায় এক কাপড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন অনেকেই, যাঁরা নিজেদের সর্বস্ব হারিয়ে বিপর্যস্ত। এত সব ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে মানুষ যখন কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছেন না, তখন এই দুর্যোগপূর্ণ মানুষদের জন্য ডেঙ্গু হতে পারে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’-এর মতো।

এ দেশে ডেঙ্গু একটি ব্যয়বহুল চিকিৎসা। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে করা গত বছরের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যাতায়াতসহ মাথাপিছু রোগীদের পেছনে পরিবারের ব্যয় ১৯ হাজার টাকার বেশি। বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে রোগীপ্রতি ৫০ হাজার টাকার ঊর্ধ্বেও খরচের অহরহ উদাহরণ রয়েছে। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিলেও দেখা যায়, রোগীর নিয়মিত টেস্ট আর ওষুধসহ খাওয়ার খরচই প্রায় ১০ হাজার টাকা বা তার বেশি। যেখানে সহায়-সম্বলহীন ঘরছাড়া এসব মানুষ এখন দুবেলা খাওয়ার জন্যও ত্রাণের ওপর নির্ভরশীল, সেখানে এত এত টাকা ব্যয় করা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব। এই মুহূর্তে পরিবারের অন্তত একজন সদস্যের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়াও পুরো পরিবারের জন্য অভিশাপ ডেকে আনবে।

সুতরাং বন্যাকবলিত এসব অঞ্চলে ডেঙ্গুর প্রকোপ যাতে দ্রুত ছড়িয়ে না পড়ে, এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।

যেসব অঞ্চলে এখনো ত্রাণ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সেসব অঞ্চলে ত্রাণসামগ্রীর মধ্যে মশার কয়েল যুক্ত করা যেতে পারে। অনেকে কাপড় দিয়ে বন্যার্ত মানুষদের সাহায্য করেছেন। কাপড়ের পাশাপাশি নতুন বা পুরোনো মশারি দেওয়া যায়। এ সময়ে সরকারি পদক্ষেপও অনেক বেশি অপরিহার্য। ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনমনে সচেতনতা তৈরি করার কোনো বিকল্প নেই। সরকারি উদ্যোগে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। প্রয়োজনে বন্যাকবলিত এসব জেলায় মশা নিয়ে নিয়ন্ত্রণকক্ষ চালু করতে হবে। মশার স্প্রে প্রয়োগ করতে হবে এবং মশার লার্ভা ধ্বংসে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নিতে হবে।

ইতিমধ্যেই আশ্রয়কেন্দ্র থেকে যাঁরা বাসাবাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন, প্রথমেই তাঁদের আশপাশে দীর্ঘদিনের জমে থাকা পানি ফেলে দিতে হবে। কোথাও যেন পানি জমতে না পারে, ব্যবস্থা নিতে হবে। মশার কামড় থেকে বেঁচে থাকতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে।

সর্বোপরি, প্রয়োজন অনুযায়ী যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে একটি দুর্যোগ থেকে রেহাই পেতে না পেতেই আরেকটি দুর্যোগের সম্মুখীন হবে সর্বহারা নিঃস্ব হাজারো পরিবার!

জান্নাতুল ফেরদাউস

শিক্ষার্থী, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়