একটি দেশ কত উন্নত, তার একটা বড় প্রমাণ মেলে সে দেশের গণপরিবহনব্যবস্থার দিকে তাকালে। ঢাকা বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় যানজটের শহর।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে ঢাকা বিভাগে, যেখানে ১১৩টি দুর্ঘটনায় ১২১ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় ২৩টি দুর্ঘটনায় ১৮ জন নিহত ও ১১ জন আহত হয়েছেন।
ঢাকার যানবাহনগুলো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে না। প্রতিনিয়ত রাজধানীতে বাসগুলো যাত্রী ওঠানোর জন্য একপ্রকার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। অন্য বাসের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি, ঘষাঘষি চলে। এর কারণে বাসের লুকিং গ্লাস ভেঙে যায়, রং উঠে যায়।
অনেক সময় জানালার গ্লাস পর্যন্ত ভেঙে যায়। এ ছাড়া চালকেরা রাস্তায় বাস এলোমেলাভাবে রাখেন, যাতে পেছন থেকে কোনো বাস যেতে না পারে। তখন কোনো কারণ ছাড়াই সৃষ্টি হয় যানজট। এর কারণে ঘটে বিভিন্ন ধরনের ছোট–বড় দুর্ঘটনা। এর কারণ হিসেবে অদক্ষ চালক ও তাঁর সহকারীকে দায়ী করেছেন বাসমালিকদের অনেকেই।
আশির দশক থেকে ঢাকার গণপরিবহনের মূল ভরসা বাস। ঢাকা ও এর আশপাশের মানুষ দিনে দুই কোটির বেশিবার যাতায়াত করেন। ওই দুই কোটি যাতায়াতের ৬৪ শতাংশ হয় বাসে। ঢাকায় ছয় হাজারের বেশি বাস ও মিনিবাস চলাচল করে। এসব বাসের মালিক দুই হাজারের বেশি। মালিকদের একটি বড় অংশ রাজনৈতিক নেতা–কর্মী বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হাতে রয়েছে।
যার ফলে তাঁদের ওপর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে বাসগুলো ইচ্ছেমতো পরিচালনা হয়ে থাকে। ২০১৭ সালে ঢাকার পরিবহনব্যবস্থাকে সুন্দরভাবে সাজানোর জন্য ছয়টি কোম্পানির মাধ্যমে চার হাজার বাস নামানোর পরিকল্পনা দিয়েছিলেন ঢাকা উত্তরের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। কিন্তু তা বেশ কিছু জটিলতার কারণে আশার আলো দেখেনি।
এরপর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানোর আশা নিয়ে ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত ৫০টি বাস নিয়ে চালু করা হয় নগর পরিবহন নামে বাস সার্ভিস।
২০২২ সালে অক্টোবরে ২২ নম্বর রুটে চালু করা হয় ঘাটারচর থেকে ডেমরা (স্টাফ কোয়ার্টার) পর্যন্ত বাস সার্ভিস। এটি চালু করার পর কয়েক মাস ভালো সার্ভিস দিলেও এখন এর নাজেহাল অবস্থা হয়েছে। অন্য দেশগুলোর গণপরিবহনব্যবস্থার দিকে তাকালে দেখা যায়, কীভাবে শহরের মানুষদের ভালো রাখা যায়, ভোগান্তি দূর করা যায়—এ নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে। অন্যদিকে আমাদের দেশে ভোগান্তির শেষ নেই। বলা যায়, ঢাকার গণপরিবহনব্যবস্থা অন্যান্য দেশের তুলনায় একদম তলানিতে অবস্থান করছে। মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর থেকে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত অনেকটা স্বস্তিদায়ক হলেও মেট্রোরেলের নিচের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি।
সম্প্রতি গুলশান ট্রাফিক বিভাগ একটি উপযোগী উদ্যোগ নিয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, মহাখালী, কাকলী, খিলক্ষেত, আবদুল্লাহপুর এলাকায় বাস গেটলক সিস্টেমে চলাচল করবে। বাসগুলো যাত্রী নামানো ও ওঠানোর সময় নির্দিষ্ট স্থান বা বলয়ের মধ্যে থাকবে। অন্য স্থানে যাত্রী ওঠানোর জন্য যত্রতত্র বাস থামানো যাবে না। যেসব যানবাহন এই নিয়ম অমান্য করবে, তাদের ওপর কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এ উদ্যোগ যদি সঠিকভাবে কার্যকর হয়, তাহলে যাত্রীদের দুর্ভোগ অনেকাংশে কমে আসবে।
বাস নির্দিষ্ট বলয়ের মধ্যে থামবে, তখন রাস্তায় অযথা যানজট সৃষ্টি হবে না। যাত্রী ও পথচারীরা নিরাপদ থাকতে পারবেন। রাস্তায় শৃঙ্খলা আনার জন্য এই গেটলক সিস্টেম ঢাকার অন্যান্য স্থানেও চালু করার প্রয়োজন রয়েছে। এই ব্যবস্থা নাগরিকদের সাময়িকভাবে কিছুটা স্বস্তি দিলেও কর্তৃপক্ষকে দীর্ঘমেয়াদি স্বস্তির জন্য ঢাকা মহানগরীর পরিবহনব্যবস্থাকে সুন্দর ও সুশৃঙ্খল করার জন্য ঢাকা সিটি করপোরেশন, বিআরটিএসহ অন্য যেসব প্রতিষ্ঠান আছে, তাদের সমন্বিত পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ প্রয়োজন। তার পাশাপাশি যাত্রী হিসেবে আমাদেরও সচেতন হতে হবে। আমরা নির্দিষ্ট স্থান ব্যতীত হাত উঠিয়ে বাসে উঠব না। সাধারণর জনগণ হিসেবে আমাদের যেসব ভূমিকা রয়েছে, তা সঠিকভাবে পালনের চেষ্টা করব।
মুহাম্মদ সুলতান মাহমুদ
শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ।