ছিন্নমূলের কান্না: উন্নয়নের আড়ালে উপেক্ষিত জীবন

জনশুমারি ও গৃহ গণনা-২০২২–এর তথ্যমতে, সারা দেশে ২২ হাজার ১১৯ জন ছিন্নমূল বা গৃহহীন মানুষ রয়েছে। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণার তথ্যমতে, শুধু ঢাকা শহরেই প্রায় ৫০ হাজার ছিন্নমূল মানুষের বসবাস। অপর দিকে বিভিন্ন সংস্থার মতে, সারা দেশে শুধু পথশিশুর সংখ্যাই ১০ থেকে ১৫ লাখ। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, ছিন্নমূল মানুষদের সঠিক সংখ্যাটি আসলে কত, তা আমাদের জানা নেই। সেটা না জানা থাকলেও সংখ্যাটা যে বেশ বড়, সেটা নিয়ে কোনো সংশয় নেই।

দেশের সরকার আসে সরকার যায়, নতুন বাজেট ঘোষণা করা হয়; কিন্তু এসব ছিন্নমূল মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। তাদের ফুটপাতে রোদে পুড়তে হয়, বৃষ্টিতে ভিজতে হয়, শীতে অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করতে হয়। দুবেলা দুমুঠো পেট পুরে খাওয়ার জন্য হাপিত্যেশ করেও কোনো লাভ হয় না।

পথশিশুরা শিক্ষাদীক্ষা থেকে বহু দূরে, প্রায় সবাই অপুষ্টিতে ভোগে, বিভিন্ন ধরনের নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করে, তাদের মধ্যে নীতি-নৈতিকতা সঞ্চারিত হয় না। কিন্তু রাষ্ট্রের যেন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। রাষ্ট্র শুধু তাদের নিয়েই চিন্তা করে, যাদের ঘরবাড়ি আছে, পরনে পোশাক আছে, দুবেলা দুমুঠো খাবার আছে, যারা অসুস্থ হলে স্বল্পোন্নত বা উন্নত চিকিৎসা নিতে পারে। রাষ্ট্র শুধু তাদেরই জীবনমান উন্নয়নের কথা ভাবে, যাদের ইতিমধ্যেই ‘জীবন মান’ রয়েছে।

কোনো সরকারই ছিন্নমূল মানুষদের নিয়ে চিন্তা করে না। কারণ, হয়তো তারা জানে ছিন্নমূল মানুষেরা তাদের গদিতে টিকিয়ে রাখার বা গদি থেকে নামিয়ে ফেলার কেউ নয়। বিগত বছরগুলোতে সরকার শুধু তাদের নিয়েই মত্ত ছিল, যাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে না পারলে গদিতে পাকাপোক্তভাবে থাকা সম্ভব নয়।

ছিন্নমূল মানুষদের মধ্যে অনেকে প্লাস্টিকের জিনিসপত্র সংগ্রহ, ফুল বিক্রি, হকারি, ভিক্ষা করলেও অনেকে আবার চুরি, পকেটমারি, ডাকাতি, মাদক বিক্রিসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকলেই যে তাদের নিয়ে আমাদের সহানুভূতি থাকা উচিত না, তা নয়। তারা অভাবের তাড়নায় এসব অপকর্ম করে থাকে। এই অপরাধের আরেকটি কারণ হলো মানবেতর জীবনযাপনের ফলে তাদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতাবোধ সৃষ্টি না হওয়া। তারা কোনো অপরাধ করলে অবশ্যই শাস্তি পাবে, কিন্তু আমাদের এ বিষয়টাও মাথায় রাখতে হবে, তারা কেন অপরাধ করছে, তাদের অপরাধ করার পেছনের কারণগুলো আসলে কী।

আমাদের সংবিধান অনুযায়ী, দেশের সব মানুষের মৌলিক চাহিদা ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তবে বিগত কোনো সরকারই সেটা করেনি, বর্তমান সরকারকেও সেরকম কোনো প্রচেষ্টা নিতে দেখছি না।  

অন্তবর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারে জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে। সেটা অবশ্যই প্রশংসনীয়। আমরা জানি, অন্তর্বর্তী সরকারের কাঁধে হিমালয় পর্বতসম দায়িত্ব এবং সময় অতি সংক্ষেপ। তাদের পক্ষে দেশের সব বিষয়ের দিকে নজর দেওয়া সম্ভব নয়। তবে বিগত কোনো সরকার ছিন্নমূল মানুষদের জন্য বিশেষভাবে কখনো চিন্তা করেনি।

অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত সেই জায়গায় পরিবর্তন আনা এবং ছিন্নমূল মানুষদের জন্য অন্ততপক্ষে প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করা। যাতে পরবর্তী দলীয় সরকারও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে এবং ছিন্নমূল মানুষদের দুর্ভোগ প্রশমনে অন্তর্বর্তী সরকারের দেখানো পথেই এগোয়। একবার একটি পথ ধরে চলতে শুরু করলে সেই পথ যদি সরাসরি গন্তব্যে না নিয়েও যায়; তবুও সেই পথই গন্তব্যে যাওয়ার পথ বাতলে দেয়।
আপাতত সারা দেশে ছিন্নমূল মানুষের সঠিক সংখ্যা হিসাব করা এবং সে অনুযায়ী বাসস্থানসহ জীবন ধারণের জন্য মৌলিক উপকরণ প্রদানের পাশাপাশি সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের বিষয়ে কাজ শুরু করা উচিত। পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে ঢাকাসহ অন্যান্য যে বিভাগীয় শহরগুলোতে এতসংখ্যক মানুষের স্থান সংকুলান হবে না, সে ক্ষেত্রে কিছুসংখ্যক মানুষকে শহরে আবাসন ও কাজের ব্যবস্থা করে দিয়ে যেসব গ্রাম কম ঘনবসতিপূর্ণ সেখানে তাদের আবাসন নিশ্চিত করতে হবে।

জীবিকা হিসেবে সেখানে দিনমজুরের কাজ করার সুযোগ রয়েছে, পাশাপাশি তাদের স্বাবলম্বী করার ক্ষেত্রে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের কাজে লাগাতে হবে। সেই কাজগুলো হতে পারে হাঁস-মুরগির খামার, পুকুরে মাছ ও কাঁকড়া চাষ, দরজির কাজ ইত্যাদি। এটি স্বীকার্য যে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিকীকরণ, দেশকে দুর্নীতিমুক্তকরণ, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ও বিভিন্ন সংস্কারের পাশাপাশি ছিন্নমূল মানুষদের জীবনধারণের জন্য মৌলিক উপকরণ প্রদান ও সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণ পুরোপুরি সম্ভব হবে না। তবে অন্তর্বর্তী সরকার এই প্রচেষ্টা গ্রহণ করলে এটি লাখ লাখ ছিন্নমূল মানুষদের ভাগ্য পরিবর্তনের অনুকূলে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হবে।

রবিউল আওয়াল পারভেজ
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়