চিঠিপত্র

মেধাবী শিক্ষার্থীদের দেশত্যাগ আর আমাদের দায়বদ্ধতা

অনেক তরুণকে দেখেছি বিদেশগামী হতে। কেউ উচ্চ শিক্ষার জন্য সেখানে পাড়ি দিচ্ছেন কেউ বা আবার নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়ে পরিবারের স্বপ্ন পূরণে সংসারের হাল ধরতে। হ্যাঁ, আমি প্রকৃতপক্ষে এই স্বপ্নগুলোরই কথা বলছি। যে স্বপ্ন এখন শিখাই কেবল বিদেশে পাড়ি দেওয়ার। হোক তা আয়ের জন্য নতুবা উচ্চ শিক্ষার জন্য।

একটা সময়ে যেখানে তরুণেরা বসে গল্প করতেন নানা সামাজিক, রাজনৈতিক আর দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে। সেখানে এখন সব চাপিয়ে উঠে আসে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার বিষয়টা। কেন তাদের মধ্যে এসব বিষয় ঘুর পাক খাচ্ছে? কেনই বা শিক্ষার্থীর এত বড় একটা অংশ বিদেশগামী হওয়ার প্রবণতায় ঝুঁকছে? কোন বিষয়গুলোই এর পেছনে দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে?

বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের যেন পছন্দের তালিকায় শীর্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিগত এক বছরে বাংলাদেশ থেকে মার্কিন মুল্লুকে পাড়ি দিয়েছেন মোট ৮ হাজার ৫২৪ জন শিক্ষার্থী। এ ছাড়া ২০২২ সালে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ৮ হাজার ৬৬৫ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। যা বিদেশে উচ্চশিক্ষার গন্তব্য নিয়ে জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর "গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি-লেভেল স্টুডেন্টস" শীর্ষক প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত ইউনেসকোর প্রতিবেদনের তথ্যতেও বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন মোট ৫২ হাজার ৭৯৯ জন শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের কাছে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও তাদের উচ্চশিক্ষার পছন্দের দেশের তালিকায় আছে যুক্তরাজ্য, কানাডা, মালয়েশিয়া এবং জার্মানির মতো দেশগুলোকে। যথাক্রমে এসব দেশে পাড়ি জমিয়েছে মোট শিক্ষার্থীর অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষার্থী। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যে ৬ হাজার ৫৮৬ কানাডায় ৫ হাজার ৮৩৫, মালয়েশিয়ায় ৫ হাজার ৭১৪ এবং জার্মানিতে ৫ হাজার ৪৬ জন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশ ছেড়েছেন।

অনেকে আবার পড়াশোনার জন্য নয় বরং পরিবারের অভাবের তাড়নায়ও পাড়ি দিচ্ছেন। সংসারের হাল ধরার তাগিদে ছুটছেন নানা দেশে। হিসাব কষলে দেখা যায় এদের অধিকাংশই মেধাবী আর পরিশ্রমী। দেশে পড়াশোনা শেষ হলেও সেই অনুসারে তাঁরা চাকরি পাচ্ছেন না কিংবা তাতে তাঁদের টিকে থাকতে পারাটা দুঃসহ হয়ে উঠছে। ফলে তাঁরা ঝুঁকছে দেশের বাইরে।

চলতি বছরের (জানুয়ারি-মার্চ) এ তিন মাসে দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার। এর আগে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বেকারের সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ ২০ হাজার। মার্চে তা দাঁড়িয়েছে ২৫ লাখ ৯০ হাজার। এসব সমীকরণ যখন একজন শিক্ষার্থীর কানে বাজে কিংবা চোখে পড়ে তখন তারা নিমেষেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। আর কেবলই দেশ ছেড়ে যাওয়ার চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়েন।

তাঁদের এই যে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া যেন আমাদের কাছেই দায়বদ্ধতার একটি বিরাট অংশ। এমনটা কেন হবে প্রশ্নে নিশ্চয়ই বলতে চাই, যারা মেধাবী তাঁরা যদি এভাবে দেশ ছাড়তে থাকেন, তাহলে দেশটাকে কারা এগিয়ে নেবেন? ভবিষ্যতে কারা নেতৃত্ব দেবেন? মেধাবী শিক্ষার্থীর এত বড় অংশ যদি ভিন্ন দেশে পাড়ি দেন তাহলে একটি দেশ কীভাবে সামনের দিনগুলোতে কঠিন, কঠোর প্রতিযোগিতায় নাম লেখাবে?

আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে কিন্তু অভাব কাটেনি, গড় আয়ু বেড়েছে কিন্তু দুশ্চিন্তা দূর হয়নি। মেধাবী তরুণদের বিদেশগামী মনোভাব আটকানোর জন্য কিছুই করা হয়নি। পড়াশোনা করলেও যে ঠিকভাবে একটি কাজ জুটবে তার নিশ্চয়তা নেই বলে যে চিন্তা তাদের মাথায় ঢুকেছে তার কোনো স্থায়ী সমাধান তাদের কাছে জানা নেই বললে চলে। ফলে দেশের বিরাট অংশ বিদেশগামী হয়ে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখাটা দূরের কথা দেশের শিক্ষা খাতের অবদান থেকেও যেন বিচ্যুত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে যেন দেশ মেধাশূন্য হবে। এতে দায়বদ্ধ থাকব কেবল আমরাই!

তৌহিদ-উল বারী
শিক্ষার্থী
বাকলিয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম