চিঠিপত্র

দিনাজপুরের পাঁপড়-কন্যাদের কথা

দিনাজপুরের পাঁপড়ের সুনাম ছড়িয়েছে দেশ ছেড়ে বিদেশেও
ছবি: লেখকবৃন্দ

গত কয়েক দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশে নারী উদ্যোক্তা এবং শ্রমিকদের অবদান অনস্বীকার্য। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প ছাড়াও কৃষি, পোশাক কিংবা অন্যান্য শিল্প বিকাশে নারী শ্রমিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়নের মূলধারার কর্মক্ষেত্রে নারীর অবদান বাড়ছে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ১ কোটি ৮৬ লাখ ৪৬ হাজার নারী শিল্প, কৃষি ও সেবা সহ অন্যান্য খাতে কাজ করছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর ২০২০ সালের এক গবেষণায় বলা হয়, মোট দেশজ উৎপাদনে নারীর অবদান প্রায় ২০ শতাংশ। এর সাথে সংসারের কাজ এবং বাইরের কাজের মূল্য ধরলে তাদের অবদান বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৪৮ শতাংশ।

দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন ও বেকারত্ব নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প। স্বল্প বিনিয়োগে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান এবং আয়ের সুযোগ থাকায় বিভিন্ন জেলায় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প গড়ে উঠেছে। যার মধ্যে দিনাজপুরের পাঁপর শিল্পের কথা না বললেই নয়। কালো জিরা, সয়াবিন তেল, গরম মসলা জাতীয় উপাদান ও বিভিন্ন রকম ডাল বিশেষ করে মুগ ডাল, মাসকলাই ডাল ও খেসারির ডাল একত্রিত করে মেশিনের মাধ্যমে গুঁড়ো করে সয়াবিন তেল মিশিয়ে খামির তৈরি করে তা থেকে লম্বা লম্বা তৈরি হয় গুঁটি, আবার সেই গুঁটি বেলন দিয়ে বেলে রোদে শুকিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় চলে যায় পাঁপড়।

ঐতিহ্যবাহী দিনাজপুর জেলায় প্রাচীনকাল থেকেই পাঁপড় একটি সম্ভাবনাময় ক্ষুদ্র শিল্প। আমাদের গবেষণায় তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে জানা যায় যে, ঘরে কিংবা একত্রিত হয়ে পাঁপড় তৈরি করে নারীরা। তাঁদের স্বাবলম্বী হওয়ার দুয়ার খুলে দিয়েছে এই শিল্প। শহরের চকবাজার, নতুনপাড়া, গুঞ্জাবাড়ির মাঠ, বাসুনিয়াপট্টি, চুড়িপট্টি, রাজবাড়ি, ফকিরপাড়া, বড় বন্দরের অলিগলিতে প্রায় ঘরেই পাঁপড় তৈরি এবং পাঁপড় তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে।

তথ্য দাতাদের মতে বর্তমানে দিনাজপুর শহরে পাঁপড় উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি আনুমানিক ১২ হাজার নারী শ্রমিক জড়িত। পাঁপড় তৈরিতে দিনাজপুরে ছোট ছোট কারখানা গড়ে উঠেছে। পাঁপড় তৈরিতে যুক্ত হয়ে অনেক নারীদের সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায় যে, একজন নারী শ্রমিক প্রতিদিন গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি গড়ে ২০০ টাকা আয় করেন। সন্তানের লেখাপড়ার পাশাপাশি নিজের হাত খরচসহ সংসার পরিচালনা খরচের জোগান এই কাজ থেকেই হয় অনেক নারীর। গবেষণায় তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে শহরের বটতলী, যগনবাবুর মাঠ থেকে চকবাজার পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে নিজ বাসায় কিংবা কারখানায় নারীদের পাঁপড় তৈরির দৃশ্য চোখে পড়ে। শহরের বিভিন্ন মহল্লায় সারি সারি পাঁপড়ের দোকান। এসব দোকানে নারীদের তৈরিকৃত পাঁপড় বিক্রি করতে দেখা যায়।

পাঁপড় বেলতে থাকা ফরিদা বেগম ও মোছা. আরমিনা বেগম জানায়, আমরা সংসারের কাজের ফাঁকে পাঁপড় বেলি। এতে সংসারের দায়িত্ব পালনও হয় আর কিছু অতিরিক্ত টাকা আয় হয়। আবার অনেক সময় এ আয়ের ওপরই সংসার চলে।

দিনাজপুরের পাঁপড়ের সারা দেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে চাহিদা আছে। ফলে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো দিনাজপুরে উৎপাদিত পাঁপড় রপ্তানির উদ্যোগ নিয়েছিল। পাঁপড় শ্রমিক ও উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণও প্রদান করে। ২০১৬ সালে একবার পাঁপড় লন্ডনে রপ্তানি হয়েছিল। কিন্তু কর্ম পরিবেশ ও মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়।

প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত পাঁপড় শ্রমিক রিনা আক্তার বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে পাঁপড় তৈরি করছি। সরকারি সহযোগিতায় আমাদের বেশ কয়েক জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এই শিল্পে কাজ করতে আমাকে অতিরিক্ত খরচ করতে হয় না। নিজে স্বাবলম্বী সহ পরিবারে সহযোগিতা করতে পারছি। আমাদের যদি সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা সহযোগিতা করে তাহলে আমার নিজেরাই এক বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারব। সেখানে স্বাস্থ্য সম্মত পাঁপড় তৈরি করে দেশ-বিদেশে রপ্তানি করতে পারব।

দিনাজপুরের পাঁপড় শিল্প শুধু নারী শ্রম নয় উপযুক্ত সহযোগিতা পেলে নারী উদ্যোক্তা তৈরিতেও সক্ষম । আমরা মনে করি, এ ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকগণ পাঁপড় তৈরির সাথে সম্পর্কিত নারী সমাজকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় অন্তর্ভুক্ত করলে তাদের সামাজিক নিরাপত্তাসহ, স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এতে দিনাজপুরের পাঁপড় শিল্পটির জন্য উন্মোচিত হতে পেতে পারে নতুন সম্ভাবনার দ্বার।

মো. আব্দুর রশিদ সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,দিনাজপুর।
আজিজুর রহমান শিক্ষার্থী ও গবেষণা সহায়ক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,দিনাজপুর।