সুগন্ধার বাতাসে লাশের গন্ধ। স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে আছে চারদিক। শনিবার মেয়ের বিয়ে দিতে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন আবদুল হাকিম সঙ্গে স্ত্রী পাখি বেগম ও আড়াই বছরের ছোট ছেলে নাসরুল্লাহকে নিয়ে। একটু আনন্দ নিয়ে বাড়ি যাচ্ছেন। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েই আবার ঢাকায় ফিরবেন। বিয়েবাড়িতে চলছিল আনন্দের মাতম। কিন্তু কে জানত রাতের মধ্যেই বিয়ের সব আনন্দ মাটি হয়ে যাবে। শুক্রবার সকালে মেয়ে শুনতে পান লঞ্চ দুর্ঘটনার খবর। শেষবারের মতো বাবার লাশটুকুও চিহ্নিত করতে পারেননি। বারবার লাশগুলোর পাশে গিয়ে আহাজারি করে বলছিলেন, ‘আমার বাবা–মায়ের মুখটা একটু দেখান আপনারা। তাঁদের নিয়া বাড়িতে মাটি দিব।’
সুগন্ধা নদীতে লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মৃত ব্যক্তিদের পরিবারের কথা কারও মাথায় থাকবে না। দু-চার দিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমগুলোতে সংবাদ আসবে। তারপর আর তেমন কোনো সংবাদ আসবে না। তাদের কেউ মনে রাখবে না। অনেক পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তিও চলে গেছেন। তাঁরা হয়তো জানতেনও না তাঁদের মৃত্যু এতটা মর্মান্তিকভাবেই হবে।
ছোট্ট ভাইয়ের বায়না, ঢাকায় থাকা বড় ভাইয়ের মোটরসাইকেলে করে ঘুরবে। শুনেছে ভাই নাকি নতুন মোটরসাইকেল কিনেছেন। বেসরকারি চাকরি করে বেতন তেমন ভালো পান না। নিজের জমানো টাকার সঙ্গে ব্যাংক লোন নিয়ে কেনা হয় মোটরসাইকেলটি। শুক্র-শনিবার ছুটির দিন থাকায় বৃহস্পতিবার বিকেলে অফিস থেকে বের হয়ে কোনো রকমে তড়িঘড়ি করে লঞ্চে ওঠে। ছোট ভাই আর পরিবারের সদস্যদের দেখানো হলো না মোটরসাইকেলটি। বাড়িতে পৌঁছালে ভাইকে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে ঘুরতেন এলাকায় সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। সুগন্ধায় পোড়া লাশের গন্ধে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। স্বজনদের আহাজারিতে নদীও কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে।
সুগন্ধা নদীতে লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মৃত ব্যক্তিদের পরিবারের কথা কারও মাথায় থাকবে না। দু-চার দিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমগুলোতে সংবাদ আসবে। তারপর আর তেমন কোনো সংবাদ আসবে না। তাদের কেউ মনে রাখবে না। অনেক পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তিও চলে গেছেন। তাঁরা হয়তো জানতেনও না তাঁদের মৃত্যু এতটা মর্মান্তিকভাবেই হবে।
ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, পুড়ে ছাই হয়ে ও পানিতে ডুবে মারা যেতে হলো ৪২ ব্যক্তিকে। জীবনে চলার পথে ঘাত-প্রতিঘাত থাকবেই। কিন্তু এমন ঘাত-প্রতিঘাত কারও কাম্য নয়। লঞ্চ দুর্ঘটনায় অনেকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাবেন। স্বাভাবিক জীবনে আর ফিরে আসতে পারবেন না। বাবা হয়তো তাঁর আদরের ছেলেটাকে আর বুকে টেনে নিতে পারবেন না। তাঁর হাত অকেজো হয়ে পড়েছে। অনেক বাবা তাঁর আদরের সন্তান নিয়ে একসঙ্গে আর হাঁটতে পারবেন না। কারণ, পা দুটো পুড়ে অচল হয়ে গেছে। আবার ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’—প্রবাদও সত্য হয়ে যায়। সুস্থ–সবল লোকগুলো আগুনে পুড়ে মারা গেলেও জীবিত ফিরে আসে অন্ধ লোক।
ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে আহত ও দগ্ধ হয়েছেন শতাধিক। বিভিন্ন হাসপাতালে তাঁদের চিকিৎসা চলছে। বরগুনা সার্কিট হাউস মাঠে জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে অজ্ঞাতনামা ৩০ জনের গণজানাজাও অনুষ্ঠিত হয়। বরগুনার পোটকাখালীতে তাঁদের দাফন হয় বেওয়ারিশ হিসেবে। তাঁদের সঙ্গে দেখা হলো না পরিবার বা প্রিয়জনের। ফিরে যাওয়া হলো না তাঁদের নিজের ঘরে, নিজের গ্রামে। আহা, জীবন!
তুহিন ভূইয়া
শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ