জাকাত ইসলামের মূল পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম। জাকাত শব্দের আভিধানিক অর্থ পবিত্রতা ও প্রবৃদ্ধি। জাকাত প্রদানের মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র, জাকাতদাতার আত্মা শুদ্ধ হয় এবং জাকাত প্রদানে সম্পদে বরকত হয়, তাই এই নামকরণ।
কোনো মুসলিম নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে সেদিন থেকে এক চান্দ্রবছর (৩৫৪-৩৫৫ দিন) পূর্ণ হলে তাকে জাকাত প্রদান করতে হয়। এরপর তিনি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক থাকলে প্রতি চান্দ্রবছরে একবার জাকাত প্রদান করতে হয়।
জাকাত প্রদান না করলে হালাল বা বৈধ সম্পদও হারাম মিশ্রিত হয়ে যায়। হালাল উপার্জন, হালাল সম্পদ ও হালাল খাদ্য ছাড়া নামাজ, রোজা, হজ কোনো ইবাদতই কবুল হয় না।
নিসাব হলো সাড়ে সাত ভরি সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা অথবা এর কোনো একটির সমমূল্যের নগদ টাকা বা ব্যবসার পণ্য।
বিনিময়যোগ্য বৈদেশিক মুদ্রা, ট্রাভেলার্স চেক, ব্যাংক চেক, ব্যাংক ড্রাফট, পে-অর্ডার, পোস্টাল অর্ডার, মানিঅর্ডার, শেয়ার সার্টিফিকেট, কোম্পানি শেয়ার, ডিও লেটার, সঞ্চয়পত্র, সিকিউরিটি মানি, জামানত, প্রাইজ বন্ড, ট্রেজারি বন্ড ইত্যাদি এসব হিসাব করতে হবে।
ব্যাংকে বা অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রাখা আমানত; যেমন বিমা, কারেন্ট অ্যাকাউন্ট, সঞ্চয়ী অ্যাকাউন্ট, মেয়াদি সঞ্চয়, কিস্তিতে জমা, এফডিআর, এমটিডিআর, ফিক্সড ডিপোজিট, পোস্টাল সঞ্চয়ী, বিশেষ সঞ্চয়, পেনশন স্কিম ও অফিশিয়াল প্রভিডেন্ট ফান্ড, স্বেচ্ছা প্রভিডেন্ট ফান্ড, ডিভিডেন্ট, সমবায় সমিতির (এসব জাকাত হিসাব তারিখে নগদায়ন করলে যা পাওয়া যাবে) ফেরত পাওয়ার যোগ্য প্রদত্ত ঋণ, ব্যবসার পণ্য ও মূল্যবান শোপিস বা মূল্যবান পাথর, হিরা-জহরত, মণি-মাণিক্য, মুক্তা ইত্যাদি (এসবের বর্তমান বাজারমূল্য অর্থাৎ বর্তমানে নতুন কিনলে যে দাম); শেয়ার সার্টিফিকেটের নামিক মূল্য ও বাজারদর এর মধ্যে যেটি বেশি, সেটি হিসাব করতে হবে।
ব্যবসায়িক নার্সারি, হর্টিকালচার, বীজ উৎপাদন খামার, কৃষিখামার, বনজ বৃক্ষ খামার, ফলদ বৃক্ষ খামার, ঔষধি গাছের খামার, চা-বাগান, রবারবাগান, তুলাবাগান, রেশম বাগান, আগরগাছের বাগান, অর্কিড নার্সারি ও ফুলবাগান, মুরগির খামার, মাছের খামার ইত্যাদি এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত সামগ্রী। এসবের বর্তমান বাজারে বিক্রয়মূল্য হিসাবে ধরতে হবে।
নিসাব পরিমাণ ও তদূর্ধ্ব সম্পদের মালিক তার জাকাতযোগ্য সব সম্পদের জাকাত প্রতিবছর আড়াই শতাংশ (৪০ ভাগের এক ভাগ) হারে প্রদান করতে হয়।
চান্দ্রবর্ষ ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিনে হয়, যেহেতু সৌরবর্ষ ৩৬৫ দিনে বা ৩৬৬ দিনে হয়, তাই সৌরবর্ষ অপেক্ষা চান্দ্রবর্ষ ১০ বা ১১ দিন কম। সৌরবর্ষ হিসেবে জাকাত প্রদান করতে চাইলে শতকরা ২.৫%-এর পরিবর্তে ২.৫৮% দিতে হবে, অর্থাৎ মূল জাকাতের সঙ্গে অতিরিক্ত ১১ দিনের হিসাব যোগ করতে হবে। অনুরূপ কারও জাকাত সমাপনী হিসাব তারিখ রমজানে না হলে তিনি অতিরিক্ত সময়ের জাকাত সমন্বয় করে জাকাত হিসাব তারিখ রমজানে নিয়ে আসতে পারেন।
সোনা, রুপা, নগদ টাকা ও ব্যবসাপণ্য এই তিন খাতে জাকাত বর্ষপূর্তি বা জাকাত হিসাব সমাপনী দিনে যত সম্পদ থাকবে, তার পুরোটারই জাকাত দিতে হবে। জাকাত বর্ষের মধ্যে যেকোনো সময় অর্থাগম ঘটলে, বছর শেষে মোট সম্পদের সঙ্গে তারও জাকাত প্রদান করতে হবে।
প্রতিবছর একই তারিখে ও একই সময়ে জাকাতের হিসাব করতে হয়। যেমন ১ রমজান সন্ধ্যা ৬টা। এই সময়ের এক সেকেন্ড আগে যে সম্পদ আসবে, তা এ বছরের জাকাত হিসাবের অন্তর্ভুক্ত হবে। এই সময়ের এক সেকেন্ড পরে যে সম্পদ আসবে, তা পরবর্তী বছরের জাকাতের হিসাবে যাবে।
জমি, বাড়ি ও গাড়ি যা বিক্রির জন্য রাখা হয়নি, তা জাকাত হিসাবের অন্তর্ভুক্ত হবে না। গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট ও জমি যেগুলো বিক্রির জন্য রাখা হয়েছে, সেগুলোর বর্তমান বিক্রয়মূল্য (বাজারদর) জাকাতের হিসাবে আসবে এবং এর মূল্য হিসাব করে প্রতিবছর জাকাত দিতে হবে।
জাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে তাৎক্ষণিক পরিশোধযোগ্য ঋণ এবং কিস্তিতে পরিশোধযোগ্য ঋণের চলমান কিস্তির পরিমাণ অর্থ বাদ রেখে অবশিষ্ট সম্পদের জাকাত দিতে হবে। যেসব ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ করে থাকেন, কখনো দেখা যায় তাঁদের সম্পদ অপেক্ষা ঋণের পরিমাণ বেশি। এ অবস্থায়ও তাঁদের ঋণ ধর্তব্য হবে না; বরং তাঁর ওই তিন খাতের সমুদয় সম্পদেরই জাকাত প্রদান করতে হবে।
● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
smusmangonee@gmail.com