বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে ইইউর সদর দপ্তর
বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে ইইউর সদর দপ্তর

মতামত

কট্টর ডানপন্থীরা যেভাবে ইইউর মূলধারা হয়ে উঠছে

ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরেকটি দেশ নেদারল্যান্ডস সম্প্রতি ডানপন্থার দিকে তীব্রভাবে ঝুঁকে পড়েছে। ২০২৩ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর ছয় মাস ধরে আলোচনার করে কট্টর ডানপন্থী দল পার্টি ফর ফ্রিডম সরকার গঠনের জন্য তিনটি মধ্য ডানপন্থী দলের সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে। পার্টি ফর ফ্রিডমের নেতা গির্ট ওয়াইল্ডার্স ইসলামফোবিক (ইসলামবিদ্বেষী) দৃষ্টিভঙ্গির জন্য কুখ্যাত।

নেদারল্যান্ডস ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যদের মধ্যে সেই দেশগুলোকে অনুসরণ করছে, যেখানে কট্টর ডানপন্থী দলগুলো ক্ষমতায় রয়েছে কিংবা তারা ক্ষমতাসীন জোটের অংশীদার। এ রকম আরও কয়েকটি দেশ হলো ইতালি, সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও হাঙ্গেরি। (গত ৬ থেকে ৯ জুন অনুষ্ঠিত ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে কট্টর ডানপন্থী দলগুলো বড় সাফল্য পেয়েছে)।

ইউরোপের ডানপন্থী দলগুলোর মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাপকভাবে মতভিন্নতা রয়েছে। ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি ইউক্রেনের কট্টর সমর্থক। অন্যদিকে জার্মানি ও ফ্রান্সের একাধিক ডানপন্থী দলকে মস্কোর প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এসব মতভিন্নতা সত্ত্বেও ইউরোপের এসব ডানপন্থী দলগুলোর মধ্যে একটা ঐক্য লক্ষ করা গেছে। এই দলগুলো তাহলে কিসের ভিত্তিতে এক হয়েছে?

এটা হলো একটি জাতিকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে ইউরোপকে একটি ‘দুর্গ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি যারা ধারণ করে তারা মনে করে, শ্বেতাঙ্গ-খ্রিষ্টান জনগণ ভিন্নধর্মী, বিশেষ করে অশ্বেতাঙ্গ মানুষদের ওপর সহজাতভাবে বিশেষাধিকার পাওয়ার অধিকারী। তাদের মধ্যে অভিবাসন ও ইসলামের প্রতি শত্রুতা এবং বিভিন্ন মাত্রায় সামাজিক রক্ষণশীলতা লক্ষ করা যায়।

বৈদেশিক নীতির পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিকে ফিলিস্তিনের প্রতি শত্রুতাসহ ইসরায়েলের প্রতি দৃঢ় সমর্থন হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এ ছাড়া ফিলিস্তিনের প্রতি সহানুভূতিশীল কাতার, তুরস্ক, ইরান কিংবা মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো রাজনৈতিক ইসলাম—এই দৃষ্টিভঙ্গিতে সবাইকে একই পাল্লায় মাপা হয়। অন্যদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরবের প্রতি সমর্থন ও নমনীয়তা লক্ষ করা যায়।

ইউরোপীয় পার্লামেন্টে কট্টর ডানপন্থীদের প্রভাব ক্রমবর্ধমানভাবে বাড়ছে এবং তারা এখন মূলধারায় পরিণত হয়েছে। এটা হয়েছে মধ্য ডানপন্থীদের সঙ্গে গোপনে তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের মাধ্যমে।

কম সুস্পষ্ট কিন্তু আরও গভীরভাবে ফলপ্রসূ উপায়ে কয়েক বছর ধরে কট্টর ডানপন্থী অ্যাজেন্ডা দ্বারা ইইউকে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। ইইউর পরিবর্তিত অভিবাসননীতি, বিশেষ করে অশ্বেতাঙ্গ অভিবাসীদের প্রত্যাখ্যান করার বিষয়টি দ্বারা এটা প্রকাশিত হয়েছে।

এর মধ্যে অবশ্যই উল্লেখ করার মতো একটি বিষয় হলো, অভিবাসীদের ইউরোপীয় ইউনিয়নে আসতে বাধা দেওয়ার জন্য উত্তর আফ্রিকার ‘ক্লায়েন্ট’ রাষ্ট্রগুলোকে ঘুষ দেওয়া। লাইটহাউস রিপোর্টের সাম্প্রতিক তদন্তে বর্ণনা করা হয়েছে, কীভাবে ‘অভিবাসন ব্যবস্থাপনা’ চুক্তির আড়ালে সাব-সাহারান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ইইউ তহবিল ব্যবহার করা হয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নে কট্টর ডানপন্থীদের উত্থান ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ইইউর নীতি ও কৌশলে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। এটি ইসরায়েলের ডানপন্থী সরকার এবং আরব বিশ্বের কর্তৃত্ববাদী শাসকদেরই খুশি করবে।

এই কৌশল ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনৈতিক অঙ্গনজুড়ে রক্ষণশীল এবং উদারপন্থী—উভয় মতাদর্শের দলগুলোর সমর্থন পায়। এই ডানপন্থী অ্যাজেন্ডাকে মূলধারায় নিয়ে আসার ঘটনার ব্যাপ্তি অনেক বড়। ফলে চাকরি, সামাজিক অধিকারসহ ইইউর অর্থায়নে পরিচালিত চুক্তিগুলোর কার্যকারিতা, স্বচ্ছতা ও মানবাধিকার-সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে ইইউ কমিশনার নিকোলাস স্মিট ভন ডার লেয়েনকে খোলাখুলিভাবে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তবে ইউরোপে এখন যে রকম রাজনৈতিক হাওয়া বইছে, তাতে এ ধরনের নীতির পুনর্বিবেচনা হওয়ার সম্ভাবনা কম।

নেদারল্যান্ডসে উইল্ডার্সের জয় উল্টো পথে চলার ইঙ্গিত দেয়। তাদের রাজনৈতিক জোট যে চুক্তিটি করেছে, তাতে ‘সর্বকালের সবচেয়ে কঠোর’ অভিবাসননীতি চালু করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এটা এমন পদক্ষেপের পূর্বাভাস দেয়, যা সেখানে থাকা মুসলিম জনসংখ্যাকে বিচ্ছিন্ন করবে। এ ছাড়া এই চুক্তিতে ইসরায়েলে ডাচ দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তর করার বিষয়ে বিবেচনা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এটা স্পষ্টভাবে ফিলিস্তিনের প্রতি শত্রুতা।

কিছুদিন আগপর্যন্ত ওয়াইল্ডার্সকে ব্রাসেলসে একজন উদ্ভট ও অগুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ হিসেবে দেখা হতো, কিন্তু এখন সেটার পরিবর্তন হতে পারে। তিনি একদা ইউক্রেন নিয়ে সন্দেহবাদী ছিলেন। কিন্তু নতুন সরকার গঠনে চুক্তির অংশ হিসেবে তিনি ইউক্রেনের জন্য অব্যাহত সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

ডাচ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ক্যাস মুড্ডে যেমন এক্স (পূর্বের টুইটারে) উল্লেখ করেছেন: মেলোনির মতো ওয়াইল্ডার্স শিখে গেছেন যে ইউক্রেনের জন্য সমর্থন ইইউর মধ্যে ‘গ্রহণযোগ্যতার’ জন্য নতুন লিটমাস পরীক্ষা হয়ে উঠেছে। এতে সম্মত হন এবং নিজের দেশে উদার গণতন্ত্রকে দুর্বল করার সুযোগ নিন।

ইউরোপীয় ইউনিয়নে কট্টর ডানপন্থীদের উত্থান ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ইইউর নীতি ও কৌশলে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। এটি ইসরায়েলের ডানপন্থী সরকার এবং আরব বিশ্বের কর্তৃত্ববাদী শাসকদেরই খুশি করবে।

  • এল্ডার মামেদভ লাটভিয়ার সাবেক কূটনীতিক
    মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত।