২০২২ সালের জানুয়ারির একটি ঘটনা মনে পড়ছে। সে সময় চার সদস্যের একটি ভারতীয় পরিবার অবৈধভাবে কানাডা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার চেষ্টা করতে গিয়ে প্রাণ হারায়।
২০২২ সালের জানুয়ারির একটি ঘটনা মনে পড়ছে। সে সময় চার সদস্যের একটি ভারতীয় পরিবার অবৈধভাবে কানাডা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার চেষ্টা করতে গিয়ে প্রাণ হারায়।

মতামত

ভারতের এত লোক কেন যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ পথে ঢুকছে

যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন লাখ লাখ অবৈধ অভিবাসীকে তাঁর দেশ থেকে বের করে দেবেন বলে হুংকার দেন, তখন হয়তো সেই অভিবাসী হিসেবে ভারতীয়দের কথা প্রথমে মনে আসে না। কিন্তু যে অস্বস্তিকর বাস্তবতা এখন ভারতীয়রা উপলব্ধি করছেন, তা হলো, আমাদের দেশের বহু মানুষ একটু স্বচ্ছন্দ জীবনের খোঁজে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাচ্ছেন।

২০২২ সালের জানুয়ারির একটি ঘটনা মনে পড়ছে। সে সময় চার সদস্যের একটি ভারতীয় পরিবার অবৈধভাবে কানাডা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার চেষ্টা করতে গিয়ে প্রাণ হারায়। তারা যুক্তরাষ্ট্র সীমান্ত থেকে মাত্র ৪০ ফুট দূরে তুষারের মধ্যে পড়ে জমে গিয়ে মারা যায়।

ভারতের অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধ রাজ্য গুজরাটের একটি বড় শহরের একটি বাড়ির মালিক হয়েও দুই সন্তান নিয়ে শিক্ষিত দম্পতি এই বেপরোয়া যাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন। এমন একটি স্বচ্ছল পরিবার এভাবে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে যাওয়ার ঘটনা অনেককে অবাক করতে পারে।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, এটি কোনো বিরল গল্প নয়। যে কাফেলায় পরিবারটির সদস্যরা ছিলেন, সে কাফেলায় তাঁদেরই মতো গুজরাটের আরও সাতজন ছিলেন।

গুজরাট হলো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রাজ্য। তিনি প্রায় ১৩ বছর সেখানে মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। এ সময় গুজরাটে মোদির অর্থনৈতিক নেতৃত্বের সাফল্য সবার চোখে পড়েছিল। মূলত সে কারণেই তাঁকে জাতীয় সরকারের নেতৃত্বে আনা হয়েছিল।

কিন্তু মোদির সেই গুজরাটের লোকজন এখন এমন দশায় পড়েছেন যে উন্নত বিশ্বে পাড়ি দেওয়ার জন্য সব ধরনের ঝুঁকি নিচ্ছেন। প্রবৃদ্ধি নিয়ে যে ভাষ্য বা বয়ান সমাজে প্রচলিত আছে, গুজরাটের এ বাস্তবতা সেটিকে স্পষ্টতই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

শুধু গুজরাট নয়, ‘ভারতের শস্যভান্ডার’খ্যাত পাঞ্জাব থেকেও ক্রমবর্ধমানভাবে মানুষ ভারতের বাইরে একটি ভালো জীবনের খোঁজে চলে যাচ্ছেন।

পাঞ্জাব একটি উর্বর কৃষিভিত্তিক রাজ্য হলেও সেখানে বেকারত্বের হার জাতীয় গড় বেকারত্বের চেয়ে বেশি। এ রাজ্যের খামারগুলো ভারতের খাদ্যের একটি বড় অংশ উৎপাদন করলেও সেগুলো তরুণদের কর্মসংস্থানের অভাব মেটাতে পারছে না।

দেশে কাজের সুযোগ না পেয়ে পাঞ্জাবের অনেক তরুণ ‘ডাঙ্কি রুট’ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। ‘ডাঙ্কি রুট’ একটি স্ল্যাং বা মুখের ভাষা। মূলত অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে পৌঁছানোর দীর্ঘ ও কষ্টকর যাত্রা বোঝাতে অবৈধ ভারতীয় অভিবাসীরা এই স্ল্যাং ব্যবহার করেন। শব্দটি অবৈধ অভিবাসনের গল্প নিয়ে নির্মিত বলিউডের ছবি ডাঙ্কি থেকে এসেছে।

অনেক ভারতীয় অভিবাসী যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য দালালদের প্রায় এক লাখ ডলার পর্যন্ত দিয়ে থাকেন। দালালেরা তাঁদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কিছু সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তাব্যবস্থা শিথিল থাকে, তাই সেগুলো দিয়ে সহজে ঢোকা যাবে। কেউ কেউ প্রথমে সেন্ট্রাল বা সাউথ আমেরিকার দেশে বৈধভাবে যান। কেউ আবার কানাডাকে নিরাপদ বিকল্প মনে করেন। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা সীমান্ত বড় এবং সেখানে পাহারাও থাকে কম।

তবে দেখা গেছে, তুষার আর বরফের মধ্যে অন্ধকার রাতে সীমান্ত পার হওয়া খুব বিপজ্জনক। বিশেষ করে যাঁরা এত ঠান্ডায় অভ্যস্ত নন, তাঁদের জন্য এই পথ পাড়ি দেওয়া হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে যাত্রা করার শামিল।

২০২০ সালের অক্টোবর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রটেকশনের কর্মকর্তারা কানাডা বা মেক্সিকো থেকে অবৈধভাবে সীমান্ত পার হওয়ার চেষ্টা করা প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার ভারতীয় অভিবাসীকে আটক করেছেন। তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন তরুণ। তবে সম্প্রতি মার্কিন সীমান্তে আটক হওয়া লোকজনের মধ্যে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এখন সপরিবার অবৈধ পথে পাড়ি দেওয়া লোকের সংখ্যা ১৬ থেকে ১৮ শতাংশে পৌঁছেছে।

তার মানে, যাচ্ছে—এটি শুধু হতাশাগ্রস্ত তরুণদের বিষয় নয়; মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোও আজকের ভারতে নিজেদের ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে না।

এটি ঠিক, কিছু ভারতীয় অভিবাসী শেষ পর্যন্ত বিপজ্জনক পথ পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাতে পারেন। পিউ রিসার্চ সেন্টারের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ৭ লাখ ২৫ হাজার বৈধ কাগজপত্রহীন ভারতীয় অভিবাসী এসেছেন। মেক্সিকো ও এল সালভাদরের পর তাঁরাই তৃতীয় বৃহত্তম গ্রুপ।

তবে যুক্তরাষ্ট্রে এই অবৈধ অভিবাসীদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত নয়। মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের (ডিএইচএস) বর্ডার ও ইমিগ্রেশন পলিসির সহকারী সচিব রইস বার্নস্টাইন মারে সম্প্রতি উল্লেখ করেছেন, গত কয়েক বছরে ভারতীয় নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে ‘নিয়মিতভাবে দেশে ফেরত পাঠানোর’ সংখ্যা বেড়েছে। শুধু গত অর্থবছরেই (যা সেপ্টেম্বরে শেষ হয়) ১ হাজার ১০০ ভারতীয়কে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

এ প্রবণতা থামছে না। অক্টোবরে মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটির একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, ভারতীয় নাগরিকদের নিয়ে একটি ‘বড় আকারের বিশেষ চার্টার ফ্লাইট’ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে পাঠানো হয়েছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রে থাকার বৈধ কোনো কাগজ দেখাতে পারেননি।

পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, এ ধরনের আরও ফ্লাইট ভারতে ফেরার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আর এখনো তো ট্রাম্প গদিতেই বসেননি।

ভারত সরকার যুক্তরাষ্ট্রের এই অভিবাসী ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল বলেছেন, এর লক্ষ্য হলো বৈধভাবে অভিবাসনের আরও সুযোগ সৃষ্টি করা।

তবে ভারতীয় নেতাদের উচিত নিজেদের প্রশ্ন করা, কেন এত মানুষ তাঁদের দেশ ছাড়তে চান?

বেশির ভাগ ভারতীয় অর্থনৈতিক সুযোগের খোঁজে যাচ্ছেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন, যদি তাঁরা কোনোরকমে একবার যুক্তরাষ্ট্রের কোনো শহরে পৌঁছাতে পারেন, তাহলে তাঁরা ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাবেন এবং জুতসই একটা কাজ বাগিয়ে নিতে পারবেন। ভারতের অনেক শিখ যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে দাবি করছেন, ভারত সরকার তাঁদের খালিস্তান আন্দোলনকারী বলে জেলে পুরে দিতে পারে; এ কারণে তাঁদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে হবে।

ভারত সরকারের দিক থেকে বলা হয়েছে, এসব কথা বলে মূলত এই লোকেরা মার্কিন নাগরিকত্ব বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে থাকেন।

তবে ভারতকে আবার আশা ও সম্ভাবনার দেশ হতে হবে। দুঃখজনকভাবে মোদি সরকারের প্রচারের পরও ভারতের অর্থনৈতিক সাফল্য আসেনি। বেকারত্ব বেড়েছে। জীবনযাত্রার মানে পতন ঘটেছে।

যদি এখানে একটি শক্তিশালী অর্থনীতি, সমান সুযোগ, যুবকদের জন্য যথেষ্ট কাজের সুযোগ এবং সবার অধিকার নিশ্চিত করা একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলেই হয়তো ভারতীয়দের ভারত ছাড়া রোধ করা যাবে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  • শশী থারুর ভারতের কংগ্রেস পার্টির এমপি ও দেশটির সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী