বর্তমান প্রশাসনিক কাঠামোতে নদী সুরক্ষা কি সম্ভব

নদী রক্ষার জন্য আইন, সংবিধান ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা খুব পরিষ্কার। কিন্তু নদী রক্ষার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের নদী-সম্পর্কিত ধারণা ও কর্মকাণ্ড আমাদের ভাবিয়ে তোলে। দেশের নদীগুলোর দখল-দূষণসহ নানামাত্রিক সর্বনাশ হচ্ছে বর্তমান প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যেই। এই প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে নদী রক্ষা করা কতটুকু সম্ভব? ১৪ মার্চ ছিল আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস, সে উপলক্ষে লিখেছেন তুহিন ওয়াদুদ

আমাদের দেশের প্রতিটি নদী অরক্ষিত। প্রকাশ্যে এগুলো অবৈধভাবে দখল ও দূষণের শিকার হচ্ছে। দখল-দূষণ ছাড়াও নদী-হত্যার আরও অনেক রকম প্রচেষ্টা চলছে। যাঁরা নদী দখল করছেন, তাঁরা নিরাপদে আছেন। কেবল নিরাপদে আছেন বললে ভুল হবে; তাঁরাই বরং আইনগতভাবে নদীর মালিকানা দাবি করে আদালতে যাচ্ছেন।

কাদের হাতে নদ-নদীর ভবিষ্যৎ 

নদীগুলো সুরক্ষিত করার জন্য আইন ও সংবিধানের নির্দেশনা খুব পরিষ্কার। তারপরও যাঁরা নদী সুরক্ষার দায়িত্বে আছেন, তাঁদের নদী-সম্পর্কিত ধারণা ও কর্মকাণ্ড আমাদের ভাবিয়ে তোলে। সরেজমিন নদীর কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, নদীর সবচেয়ে বড় সর্বনাশ করেছেন সরকারিভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।

সম্প্রতি নদী রক্ষায় দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানালেন, জেলা প্রশাসক চাইলেই নাকি নদী, খাল, বিল ও জলাশয়ের শ্রেণি পরিবর্তন করতে পারেন। আরেকজন কর্মকর্তার কাছে জেনেছি, নদীর জমি যদি একবার কারও নামে রেকর্ড করা হয় বা খারিজ হয় এবং তিনি যদি খাজনা দেন, তাহলে ওই নদীর জমির মালিক সরকার থাকে না।

নদীবিষয়ক অনেক কর্মকর্তা মনে করেন, নদী, খাল, বিল ও জলাশয়ের ভেতরে গুচ্ছগ্রাম করা বৈধ। কেউ বলেন ১২ বছর, কেউ বলেন ৬০ বছর ভোগ করলেই নদীর মালিকানা ব্যক্তি লাভ করবেন। কী সব উদ্ভট অবাস্তব কথা!

নদী, খাল, বিল ও জলাশয়ের শ্রেণি পরিবর্তনের আইনগত ভিত্তি নেই, বিক্রিরও সুযোগ নেই। তাহলে সেই নদীর মালিক ব্যক্তি হওয়ার সুযোগ থাকে কীভাবে? যদি কারও ব্যক্তিগত জমির ওপর দিয়ে নদী প্রবাহিত হয়, সেটিও নদী। জেলা প্রশাসক দিয়ারা জরিপের মাধ্যমে নদী ঘোষণা করবেন। কোনো জমিতে প্রাকৃতিক প্রবাহ বিদ্যমান থাকলে, আইন সেই ব্যক্তিগত জমি নদী ঘোষণার সুযোগ রেখেছে।

পরিহাস হলো, নদীবিষয়ক সাধারণ ধারণা ছাড়াই অনেকে নদীবিষয়ক কর্মকর্তা হয়েছেন। তাঁদের হাতেই আমাদের নদ-নদীর ভবিষ্যৎ। 

বিদ্যমান প্রশাসনিক কাঠামো

আমাদের দেশের নদীগুলোর দখল-দূষণসহ নানামাত্রিক সর্বনাশ হচ্ছে বর্তমান প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যেই। এখনো আমাদের দেশের নদী দেখভাল করার দায়িত্বশীল অনেকে জানেন না নদীর মালিক ব্যক্তি হতে পারেন না। অনেকেই জানেন না, নদী উদ্ধারের পর্যায়ক্রমিক ধাপগুলো কী কী। একটি নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এনে হাজির করেন অনেকেই। যদিও বা কেউ নদী উদ্ধার করতে চান, তাঁর আশপাশের অন্য অনেক কর্মকর্তা তাঁকে যথাযথ সহায়তা দেন না।

■ নদী, খাল, বিল ও জলাশয়ের শ্রেণি পরিবর্তনের আইনগত ভিত্তি নেই, বিক্রিরও সুযোগ নেই।

■ নদীগুলোর দখল-দূষণসহ নানামাত্রিক সর্বনাশ হচ্ছে বর্তমান প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যেই।

■ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন একটি বড় প্রতিষ্ঠান হলেও এই কমিশন স্বাধীন নয়।

■ বিদ্যমান প্রশাসনিক কাঠামোতে নদীর দখলদারদের শাস্তির বিধান থাকলেও তার প্রয়োগ করার প্রবণতা নেই।

এ ছাড়া দখলকৃত নদীর জমির মূল্যমানের ওপর নির্ভর করে প্রলোভনের নানা টোপ। সার্ভেয়ার, উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা, এসি ল্যান্ড (সহকারী কমিশনার, ভূমি), ইউএনও (উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা), জেলা প্রশাসক, স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিক, ক্ষেত্রবিশেষে গণমাধ্যমের কর্মীরাও অবৈধ দখলদারের কাছে আর্থিক কিংবা অন্য কোনো সুবিধা নিতে পারেন। তাহলে তাঁরাও নদীর প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়ান।

আর যদি সবাই মিলে অবৈধ দখলদারের পক্ষ নেন, তাহলে সেই নদীর বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব। বিদ্যমান প্রশাসনিক কাঠামোতে এসবের আইনগত সুবিধা দেওয়ার সুযোগ না থাকলেও নানা জটিলতা সৃষ্টির প্রধানতম কাজটি করেন নদী রক্ষায় দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাই।

নদী কিংবা নদীর অভ্যন্তরে থাকা অনেক বিল নদীর প্রবাহেরই অংশ। কার্যত নদী, খাল, বিল, জলাশয় কিংবা জলপথ যা-ই হোক না কেন, তা ব্যক্তির নামে লিখে দেওয়ার আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। একবার একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমাকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের ‘খাস জমি-১ শাখা’র ২০১২ সালের একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। ওই নির্বাহী কর্মকর্তার বক্তব্য ওই চিঠি মোতাবেক নদীর জমির শ্রেণি পরিবর্তন করার সুযোগ আছে।

পার্বত্য তিন জেলা ব্যতীত অন্যান্য জেলা প্রশাসকদের দেওয়া সেই চিঠিতে লেখা ছিল, ‘ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে যে ১ নম্বর খাস খতিয়ানে রেকর্ডভুক্ত জনসাধারণের ব্যবহার্য নদী, খাল, বিল, রাস্তা, ঘাট, নালা, পয়ঃপ্রণালি, পুকুর, বাঁধ, কবরস্থান, শ্মশানঘাট, পার্ক, খেলার মাঠ, গোপাট, ডোবা, জলাশয় ইত্যাদি প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট জমির শ্রেণি পরিবর্তনপূর্বক দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত প্রস্তাব ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হচ্ছে।’ এই চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ‘এসব জমির শ্রেণি পরিবর্তন করার সুযোগ নেই। তবে প্রাকৃতিকভাবে এ ধরনের জমির শ্রেণি পরিবর্তন হয়ে থাকলে, তা সরেজমিন পরিদর্শনপূর্বক যৌক্তিক ক্ষেত্রে বিধিমতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।’

চিঠির শেষ অনুচ্ছেদে এসব জমির বন্দোবস্ত প্রস্তাব প্রেরণ করতে নিষেধ করা হয়। এই চিঠিকে ওই নির্বাহী কর্মকর্তা নদী, খাল ও বিলের শ্রেণি পরিবর্তন করার সুযোগ আছে বলে দাবি করেছিলেন। আমি যখন তাঁর কাছে জানতে চাই, মন্ত্রণালয় যে ‘বিধিমতে’ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেছে, সেই ‘বিধি’ আসলে কী। তখন আর তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। কারণ, কোনো বিধিতে নদী, খাল ও বিলের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের সুযোগ নেই। মূলত নদী সুরক্ষায় দায়িত্বশীল অনেকেই ভ্রান্ত ধারণার মধ্যে আছেন।

বর্তমানে নদী সুরক্ষার জন্য উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা, সহকারী ভূমি কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব), জেলা প্রশাসকসহ অনেক কর্মকর্তা আছেন। নদীর সুরক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ড, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, এমনকি আইন মন্ত্রণালয়ও আছে। আন্তসীমান্ত নদীর প্রশ্নে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও যুক্ত। এত কর্মকর্তা, দপ্তর, কমিশন ও মন্ত্রণালয় থাকার পরও নদীগুলো আজ অরক্ষিত।

বিদ্যমান প্রশাসনিক কাঠামোতে নদীর সুরক্ষা সম্ভব নয়। কেবল আইন ও সংবিধানের নির্দেশনার বাস্তবায়নটুকু করলেই নদীর কোনো ক্ষতি হতো না। কিন্তু নদী সুরক্ষায় ব্যর্থতার চিত্রই আমাদের চোখের সামনে বারবার ভেসে আসে। গণমাধ্যমেও আমরা প্রতিনিয়ত এই চিত্র দেখি।

বিদ্যমান প্রশাসনিক কাঠামোতে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন একটি বড় প্রতিষ্ঠান। দুঃখজনক হলেও সত্য যে এই কমিশন স্বাধীন নয়। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে এটি পরিচালিত হয়। কেবল ১২টি বিষয়ে সুপারিশ করার ক্ষমতা আছে এই কমিশনের। উচ্চ আদালত এই কমিশনকে নদীর অভিভাবক ঘোষণা করেছে। আইন সংশোধন করে কমিশনকে শক্তিশালী করার নির্দেশনা দিয়েছে উচ্চ আদালত। কিন্তু এই নির্দেশনাও এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।

বিদ্যমান প্রশাসনিক কাঠামোতে নদীর দখলদারদের শাস্তির বিধান থাকলেও প্রয়োগ করার প্রবণতা নেই। যারা নদী দখল করেছে, তারা রাষ্ট্রের সম্পত্তি অবৈধভাবে করায়ত্ত করেছে। রাষ্ট্রের সম্পত্তি যারা ক্ষতি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক আইন প্রয়োগ করার কথা থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই।

নদী সুরক্ষায় জেলা প্রশাসক উপযুক্ত কি না, ভাবা প্রয়োজন। একজন জেলা প্রশাসকের পক্ষে অনেক কারণেই নদীর সুরক্ষা সম্ভব নয়। সাধারণত জেলা প্রশাসকেরা নদী উদ্ধার করতে চান না। এর প্রধান কারণ, যাঁরা নদী দখল করেন, তাঁরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। তাই জেলা প্রশাসকেরা অবৈধ দখল উচ্ছেদে কতটা আগ্রহী থাকেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

তা ছাড়া কেবল জেলা প্রশাসক চাইলেই নদী উদ্ধার করা যায় না। এসি ল্যান্ড, ইউএনও, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকসহ (রাজস্ব) অনেকে জেলা প্রশাসককে পর্যাপ্ত সহায়তা না দিলে এ ধরনের কাজ সম্ভব নয়। ফলে আন্তরিক হলেই যে জেলা প্রশাসক নদী উদ্ধার করতে পারবেন, তা বলা যায় না। জেলা প্রশাসকেরা একটি জেলায় এত বেশি কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন যে কাজের চাপেই তাঁদের পক্ষে নদী উদ্ধার করা অসম্ভব।

নদী সুরক্ষায় একজন এসি ল্যান্ডের কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মাঠপর্যায়ে বিসিএস ক্যাডারের সবচেয়ে জুনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে এত বড় দায়িত্ব পালন করা কঠিন। আইন পক্ষে থাকলেও একজন ছোট কর্মকর্তার পক্ষে নদীর জমির সুরক্ষা অনেক সময় সম্ভব হয় না।

নদী সুরক্ষায় জবাবদিহির ভীষণ অভাব। অনেক কর্মকর্তা নদীর জমি ব্যক্তির নামে লিখে দেন। খারিজ করেন, খাজনা নেন। এমনকি বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা মিলে সেই জমি ব্যক্তির নামে নতুন করে রেকর্ডভুক্ত করারও কাজ করেন। এরপর যখন উদ্ধারের জন্য সামাজিক চাপ তৈরি হয়, তখন তাঁরা সহজে আর তা উদ্ধার করেন না।

বর্তমান প্রশাসনিক কাঠামোর দুর্বলতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকার কারণে আমাদের দেশ আন্তর্জাতিক নদীগুলোর স্বীকৃতি পাচ্ছে না। বলা হচ্ছে, আন্তসীমান্ত নদীর সংখ্যা মাত্র ৫৭টি। বাস্তবে এই সংখ্যা দুই শতাধিক। অথচ সব আন্তসীমান্ত নদীর আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে স্বীকৃতি নেই।

কী করতে হবে

আমাদের জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে। কমিশনের নিজস্ব শক্তি-জনবল থাকলে কমিশনও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে। এর পাশাপাশি নদী সুরক্ষার জন্য জেলাভিত্তিক কিংবা বিভাগভিত্তিক কেবল নদী নিয়ে কাজ করবে এমন স্বতন্ত্র কার্যালয় গড়ে তোলা প্রয়োজন। নদী সুরক্ষায় সুনির্দিষ্টভাবে সেই কার্যালয় কাজ করবে।

প্রতিটি বিভাগে একটি করে ‘নদী আদালত’ জরুরি। নদীর রায় দেওয়ার জন্য ব্যক্তির সাক্ষ্য-প্রমাণ তেমন প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। দলিলাদি পর্যালোচনা করে দ্রুত রায় প্রদান করাও সম্ভব। নথিপত্র ঠিক থাকলে একটি বা দুটি শুনানির মাধ্যমেই এগুলো সহজে মীমাংসা করা যায়।

নদী রক্ষায় বিদ্যমান প্রশাসনিক কাঠামো পরিবর্তন করতে হবে। এটা না হলে যত আন্দোলন, লড়াই ও সংগ্রাম গড়ে তোলা হোক না কেন, নদী রক্ষা করা সম্ভব নয়।

তুহিন ওয়াদুদ  বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক।