ড. মাহবুবউল্লাহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ। ’৬৯-এর গণ–অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা ছিলেন। ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, সংবিধান সংস্কার, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎসহ আরও কিছু বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও মনজুরুল ইসলাম
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের পতন ঘটেছে। আমরা একটা নতুন পর্বে প্রবেশ করেছি। গত ১৫ বছর ছিল গণতন্ত্রের জন্য একটি কালো অধ্যায়। গণতন্ত্রের পথে কেন আমাদের বারবার হোঁচট খেতে হচ্ছে?
মাহবুবউল্লাহ: আমি বিষয়টাকে একটু অন্যভাবে দেখি। এ অঞ্চলের মানুষ শুধু পাকিস্তান আমলে নয়, ব্রিটিশ আমল থেকেই গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে আসছে। শাসনতন্ত্র বা সংবিধানের দাবি সেই লড়াইয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদের প্রথম নির্বাচন হয়। এরপর ১৯৫৬ সালে এসে পাকিস্তানে একটি সংবিধান কার্যকর হয়। প্রায় ৯ বছর লেগেছিল একটি সংবিধান তৈরি করতে।
মাত্র দুই বছরের মধ্যে আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখল ও সামরিক শাসনের কারণে সেই সংবিধান বাতিল হয়ে যায়। এরপর ১৯৬২ সালে তিনি নিজেই একটি সংবিধান দিলেন, সেটি ছিল মৌলিক গণতন্ত্রের সংবিধান। সেই সংবিধান অনুযায়ী জনগণ প্রত্যক্ষভাবে বা ভোট দিয়ে তা নির্ধারণ করতে পারত না।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর বাহাত্তর সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন ও কার্যকর করা হয়। খুব অল্প সময়ে একটি সুন্দর সংবিধান প্রণয়নের জন্য সে সময় অনেকেই বাহবা দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, ভবিষ্যতে এটা আমাদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। কিন্তু সেই সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় শুরু থেকেই কিছু সমস্যা ছিল। তখন যাঁরা সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন, তাঁদের সেই ম্যান্ডেট ছিল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল।
কিন্তু ’৭২-এর সংবিধানও খুব বেশি দিন অপরিবর্তিত থাকেনি। সংবিধান কার্যকর হওয়ার অল্প সময় পর থেকে তা সংশোধন করা শুরু হয়। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান একদলীয় শাসন কায়েম ও ক্ষমতা চিরস্থায়ী করেছিলেন। শেখ হাসিনারও একই রকম উদ্দেশ্য ছিল। নির্বাচন ছাড়া, জনগণের সম্মতি ছাড়া রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার যে রাজনীতি, তা থেকেই গণতন্ত্রের পতন ও ফ্যাসিবাদের উত্থান হয়।
সংবিধান সংশোধন, পুনর্লিখন বা নতুনভাবে প্রণয়ন নিয়ে বিতর্ক চলছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
মাহবুবউল্লাহ: এখন বাংলাদেশে যে সংবিধান চালু আছে, কেউ বলেনি বা কেউ ঘোষণা দেয়নি যে সেটা বাতিল বা অচল হয়ে গেছে। অনেকগুলো অগণতান্ত্রিক সংশোধনীর কারণে সংবিধানটি নানাভাবে ভারাক্রান্ত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়ে যাওয়ায় এই সংবিধান অনুযায়ী সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনও সম্ভব নয়।
আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, বর্তমান সংবিধান কাটাছেঁড়া করে আর গণতন্ত্রমুখী করা সম্ভব নয়। সংবিধান সংশোধন ও পুনর্লিখন নিয়ে এখন যে বিতর্ক চলছে, সেখানে আমার অবস্থান পুনর্লিখনের পক্ষে। আমি মনে করি, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে সুপারিশ নিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধান পুনর্লিখন করা উচিত। তবে পুনর্লিখনের নামে সময়ক্ষেপণ করা চলবে না।
বর্তমান পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আপনি কী মনে করেন?
মাহবুবউল্লাহ: নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থাকবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় এখনো আসেনি। দেশের রাজনীতি পরিবর্তিত হচ্ছে। অনেক নতুন নতুন প্রশ্ন সামনে আসছে।
রাজনীতি ও নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ নিয়ে দুই ধরনের মতই আছে। আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করতে দেওয়ার পক্ষে যেমন সমর্থন আছে, তেমনই অনেকে দলটিকে নিষিদ্ধ বা রাজনীতির বাইরে রাখার পক্ষেও বলছেন। তবে একটা দল বা মত সমাজে-রাষ্ট্রে বিদ্যমান থাকলে তাকে বলপ্রয়োগ করে বা আইনের মাধ্যমে রাজনীতি বা নির্বাচন থেকে বাইরে রাখার বিষয়টি কার্যকর হবে বলে মনে হয় না।
তাহলে উপায় কী?
মাহবুবউল্লাহ: আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগুলো খুবই গুরুতর। বিরোধীদের দমন-পীড়ন, গুম, খুন, গণহত্যা এবং ফ্যাসিবাদী শাসনের অভিযোগ উঠেছে। এগুলোর বিচার হতে হবে। তবে দলটির যেসব নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে এ রকম কোনো অভিযোগ নেই, তাঁদের রাজনীতি করতে না দিলে সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। তাঁরা হয়তো রাজনীতি করতে পারবেন, সেটা বিচার সম্পন্ন হওয়ার পরে।
সমস্যা হলো আমাদের দেশে বিচারপ্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীরগতির। এর ফলে আগামী নির্বাচনের আগে এই বিচার শেষ হবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এই বিচার যাতে দ্রুত হয়, সরকারের উচিত সে জন্য ব্যবস্থা নেওয়া। আসলে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করা না–করা নিয়ে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যেখানে কোনোটাই উত্তম সমাধান নয়।
১৫ বছরের একটানা শাসনে আওয়ামী লীগ সরকার যেমন অন্যায়-অত্যাচার করেছে, তেমনই এবার গণ–অভ্যুত্থানের সময় অনেক আন্দোলনকারীকে হত্যা করা হয়েছে। এ কারণে মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ, বিদ্বেষ তৈরি হয়েছে, যা কিছু আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কিত, সেগুলোকে অন্যায়-অত্যাচারের প্রতীক হিসেবে মনে করেছে মানুষ। এ কারণেই আওয়ামী লীগের সবকিছুকে এখন বিরোধিতা করা হচ্ছে; পরিস্থিতি যে জায়গায় পৌঁছেছে, তাতে এমনটাই হওয়ার কথা। মানুষের ক্ষোভ প্রশমিত হলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি পাল্টাতে পারে। তখন হয়তো তারাও (আওয়ামী লীগ) রাজনীতি করার সুযোগ পাবে।
একটা রাজনৈতিক দলকে চেনা যায় ক্ষমতায় থাকাকালীন তার কর্মকাণ্ডের দ্বারা। তাই ১৯৭১ সালের আগের আওয়ামী লীগ আর ১৯৭১ সালের পরের আওয়ামী লীগ এক নয়। ’৭২ থেকে ’৭৫ সালে প্রথম আওয়ামী লীগ আমলেও দেশে স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করা হয়েছিল। আর গত ১৫ বছরের দুঃশাসন বা ফ্যাসিবাদী শাসনের মাধ্যমে দলটি ধীরে ধীরে আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে গেছে। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের মধ্য দিয়ে সেটা সম্পন্ন হয়েছে।
১৯৬৯ ও ১৯৯০-এর গণ–অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছাত্রসংগঠনগুলো। কিন্তু ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সাধারণ ছাত্রদের নেতৃত্বের ভূমিকায় বেশি দেখা গেছে। এটা কি রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত?
মাহবুবউল্লাহ: এবারের গণ–অভ্যুত্থানে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁদের আমরা সমন্বয়ক হিসেবে চিনি। তাঁদের কেউ কেউ গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি নামে একটা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যদিও তাঁরা এখন সেই সংগঠনের কথা খুব একটা বলছেন না। কোনো না কোনো নামে ছাত্রদের সংগঠিত হওয়ার এই চেষ্টা থেকে সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা বোঝা যায়। বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে এখনো গণতন্ত্র দানা বাঁধেনি, সেখানে ছাত্রসংগঠনগুলোর বড় ধরনের ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে।
এবার ছাত্ররা যে আন্দোলন করেছেন, সেটা শুধু ছাত্রদের আন্দোলন ছিল না, দেশের সর্বস্তরের মানুষ তাতে অংশগ্রহণ করেছিল। দেশের মানুষ আগে থেকেই শেখ হাসিনাকে বিদায় জানানোর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে ছিল। এর ফলে ছাত্রদের আন্দোলনের সঙ্গে তারা খুব দ্রুত সম্পৃক্ত হতে পেরেছে।
এবারের আন্দোলনে প্রথাগত ছাত্রসংগঠনগুলো নেতৃত্বে না থাকলেও তাদের বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। যেসব ইস্যু নিয়ে আন্দোলন হয়েছে, সেই সব ইস্যু কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোরও ইস্যু ছিল। এ কারণে এটা বলা যাবে না যে রাজনীতিতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন হয়েছে।
অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি জনগণের অনাস্থা তৈরি হয়েছে—এমনটা মনে করেন কি না?
মাহবুবউল্লাহ: এ ধরনের কথা অনেকেই বলছেন। তবে আমি এগুলোকে ভিত্তিহীন মনে করি। প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা আছে কি না, সেটা বোঝা যায় নির্বাচনের মাধ্যমে। আওয়ামী লীগ দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে। এখন সেই নির্বাচনী ব্যবস্থা ঠিক করতে হবে। এরপর একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হলেই জনগণের আস্থা-অনাস্থার বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস পেরিয়ে গেছে। এ সরকারের কর্মকাণ্ডকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি নিয়ে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ লক্ষ করা যাচ্ছে।
মাহবুবউল্লাহ: এ সরকার বেশ কিছু ভালো ও গ্রহণযোগ্য উদ্যোগ নিয়েছে। সংস্কার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার তারা করবে—এমনটা আশা করি।
তবে আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিয়ে একধরনের শঙ্কা রয়েছে। ছিনতাই, রাহাজানি, ডাকাতি—এগুলো বেড়ে যাওয়ার কারণে জনগণের মধ্যে ভীতি আছে। এর কারণ হলো আমাদের দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজ করে থাকে মূলত পুলিশ। ৫ আগস্টের পর থেকে পুলিশ সেভাবে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না। এ বাহিনীর অনেক সদস্যের কাজে যোগ না দেওয়ার খবর জানা গেছে। যে পর্যন্ত পুলিশ বাহিনীকে পুরোপুরি কার্যকর না করা যাবে, সে পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।
আরেকটি বিষয় হলো, জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি। শুধু গত তিন মাসে নয়, আগের সরকার থাকতেই জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। চার-পাঁচ বছর ধরেই এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
গত সরকারের আমলে বেশ কিছু ব্যয়বহুল মেগা প্রজেক্ট নেওয়া হয়েছিল। অন্য দেশগুলোর তুলনায় তিন থেকে চার গুণ বেশি ব্যয়ে এসব মেগা প্রজেক্ট করা হয়েছে। এর বাইরেও নানাভাবে বিপুল অর্থ অপচয় করা হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে বিভিন্ন সময় অতিরিক্ত টাকা ছাপানো হয়েছে। ফলে বাজারে মানি সার্কুলেশন বা অর্থের প্রবাহ বেড়ে গেছে। বাজারে পণ্যের তুলনায় অর্থের প্রবাহ বেশি থাকলে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। এ অবস্থার পরিবর্তন হতে সময় লাগবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বিএনপি রোডম্যাপ (রূপরেখা) ও দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
মাহবুবউল্লাহ: অন্তর্বর্তী সরকারের মূল দায়িত্ব হলো সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য উপযোগী একটা পরিবেশ তৈরি করা। নির্বাচনমুখী একটি দল হিসেবে বিএনপি স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ বা রূপরেখা চাইবে—এটাই তো স্বাভাবিক। বিএনপির চাওয়ার মধ্যে দোষের কিছু নেই।
সরকারের বাহ্যিক আচরণ দেখে আমার কাছে মনে হচ্ছে না, এই সরকার দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকবে। ড. ইউনূসও বলেছেন, জনগণ না চাইলে তিনি থাকবেন না। ভবিষ্যতে অন্য কিছু ঘটবে কি না, তা নিয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করতে চাই না।
গত সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী কখনো জোটগতভাবে, আবার কখনো যুগপৎ আন্দোলন করেছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে নির্বাচন, সংস্কারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে মতভিন্নতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এটা কীভাবে দেখছেন?
মাহবুবউল্লাহ: আমার কাছে মনে হচ্ছে, জামায়াতে ইসলামীর আত্মবিশ্বাস অনেক বেশি বেড়ে গেছে। যেহেতু তাদের একটি সংগঠিত শক্তি আছে, বিশাল ক্যাডার বাহিনী আছে—এই আন্দোলনে তারা মিলিট্যান্ট ভূমিকা পালন করতে পেরেছে; এটা করতে পারায় তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। ফলে নিজেদের এত বড় মনে করছে, যাতে অন্যের সাহায্য বা সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছে না।
দেশের সংকট চূড়ান্তভাবে মীমাংসা হওয়ার আগে আন্দোলনের অংশীদারদের মধ্যে অনৈক্য দুঃখজনক। এটা দুঃখজনক এ কারণে যে শেখ হাসিনা ভারতে বসে কলকাঠি নাড়ছেন; দেশে নানা রকম অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। এ কারণে দেশে যাঁরা গণতন্ত্র চান, তাঁদের মধ্যে ঐক্য বা নিদেনপক্ষে ওয়ার্কিং রিলেশন থাকা দরকার।
ক্ষমতার পালাবদলের সুযোগে এখানে উগ্র দক্ষিণপন্থীদের উত্থানের আশঙ্কা আছে কি না?
মাহবুবউল্লাহ: এ দেশের মানুষজনের চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যত দূর আমি জানি, তাতে মনে হয় না এ ধরনের কোনো শক্তি নির্বাচন বা অন্য কোনো পন্থায় বাংলাদেশের ক্ষমতা দখল করতে পারবে। এবারের আন্দোলনে নানা গোষ্ঠী, সংগঠন অংশ নিয়েছিল। এর ফলে তাদের ধর্মীয় কিছু আইকন (প্রতীক) আমাদের চোখে পড়েছে। শেখ হাসিনা গত ১৫ বছর একটি দমন-পীড়নমূলক শাসন চালিয়েছেন। সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডকে সেটার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই বিবেচনা করা যেতে পারে।
আমি আমার একটা লেখায় উল্লেখ করেছিলাম, বাংলাদেশের মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য হলো পেন্ডুলাম বা ঘড়ির দোলকের মতো; একবার ডান দিকে যায় আবার সেটা বাঁ দিকে যায়। কখনো কখনো দেখা গেছে, আমরা সেক্যুলার উৎসব বা অনুষ্ঠানের দিকে ঝুঁকে পড়েছি। আবার কখনো কখনো আমাদের মধ্যে ধর্মীয় আচার-আচরণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এর মানে হলো আমাদের দেশের মানুষের যে বিশ্বাস বা চৈতন্যের জগৎ, সেটা এখনো নড়বড়ে অবস্থায় আছে। এর কারণ হলো আমাদের নেশন বিল্ডিং বা জাতি গঠনের যে সমস্যা, সেই সমস্যার এখনো সমাধান হয়নি। এর ফলে ব্রড (বড়) ইস্যুগুলোতে জাতি হিসেবে দল-মতনির্বিশেষে আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারিনি।
নেশন বিল্ডিংয়ের কাজটা সহজ বা খুব তাড়াতাড়ি সম্ভব নয়। এ জন্য আমাদের বড়মাপের নেতৃত্বের প্রয়োজন। রাজনীতিকে আরও গভীর করা প্রয়োজন। শুধু স্লোগানসর্বস্ব রাজনীতি দিয়ে এটা হবে না।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনি কি আশাবাদী?
মাহবুবউল্লাহ: একটা অগণতান্ত্রিক বা ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটানোই যথেষ্ট নয়; নতুন করে যাতে ফ্যাসিবাদের উত্থান না ঘটে, সেটার নিশ্চয়তা দরকার। ফ্যাসিবাদের উত্থানের সঙ্গে অর্থনীতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। একটা দেশে যখন দেশপ্রেমিক বুর্জোয়ার বদলে লুম্পেন বুর্জোয়ারা অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে যায়, তখন সেখানে গণতন্ত্র থাকে না।
নানা তরফ থেকে বিভিন্ন পরিবর্তন বা সংস্কারের ঘোষণা দেওয়া হলেও সমাজ পরির্বতন বা অর্থনীতি-রাজনীতির মৌলিক পরিবর্তনের কোনো কথা কেউ বলছে না। এর ফলে আমি গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব আশাবাদী নই। এ রকম পরিস্থিতিতেও আমি মনে করি, মানুষকে মন খুলে কথা বলতে দিতে হবে। মানুষ মন খুলে কথা বলতে পারলে মনে করব আমরা গণতন্ত্রের দিকে এগোচ্ছি। আর যদি মানুষ মন খুলে কথা বলতে না পারে, তাহলে ভিন্ন নামে ভিন্ন রূপে আবারও ফ্যাসিবাদ ফিরে আসতে পারে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
মাহবুবউল্লাহ: আপনাদেরও ধন্যবাদ।