টাইম ম্যাগাজিন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: সম্ভাবনার নতুন যুগ’ শীর্ষক এ বিশেষ সংখ্যার সন্নিবেশিত লেখাগুলোর ওপর ভিত্তি করে প্রথম আলোর জন্য ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ইশতিয়াক মান্নান। মূল লেখার সারাংশ, ভাষান্তর ও প্রাসঙ্গিক তথ্য-ব্যাখ্যা যুক্ত করেছেন তিনি। আজকের লেখাটি মূলত একটি সাক্ষাৎকার। ওপেন এআইয়ের প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যানের এ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এডওয়ার্ড ফেলসেনথাল ও বিলি পেরিগো। আগামী সপ্তাহের লেখা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে রোমান্স’
আপনি নিজে কী কাজে চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করেন?
স্যাম: আমি ইনবক্সে জমতে থাকা অসংখ্য ই–মেইল থেকে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো খুঁজে বের করতে চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করি। কখনো এমন হয় যে একটি টুইট ঠিকমতো লিখতে পারছি না, কিছুতেই মনমতো হচ্ছে না, তখন চ্যাটজিপিটির সাহায্য নেই। আবার হয়তো আগামী সপ্তাহে কারও সঙ্গে একটা মিটিং আছে—তার জন্য কয়েকটা আর্টিকেল ঘেঁটে একটা প্রস্তুতিমূলক সারাংশ তৈরি করতে হবে, তখনো আমি এর সাহায্য নিই।
এই যে বাজারে আসার পর চ্যাটজিপিটি এ রকম ভাইরাল হলো, আপনি কি খুব অবাক হয়েছেন?
স্যাম: বাইরে থেকে যতটা মনে হয়, ততটা না। আমরা নিজেরা যারা এর তৈরিতে যুক্ত ছিলাম, বাজারে ছাড়ার আগেই এর ক্ষমতা ও সম্ভাবনায় বেশ চমৎকৃত ছিলাম। অবশ্যই যে অবিশ্বাস্য হারে মানুষ একে গ্রহণ ও ব্যবহার করছে তা অবাক হওয়ার মতো। আমার মনে আছে যে প্রথম প্রথম আমাদের সব আলোচনায় এই কথাটাই ঘুরেফিরে আসছিল যে এ রকম চাহিদাসম্পন্ন একটা অ্যাপ্লিকেশন আরও আগে তৈরি হয়নি কেন?
কিন্তু বাজারে তো অন্যান্য এআই অ্যাপ্লিকেশন ছিল?
স্যাম: আমার মনে হয়, একটা অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করার সময় ব্যবহারকারী কি অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন বা কেমন বোধ করছেন, সেটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চ্যাটজিপিটির মডেলটাকে একটা আলাপচারিতার ঢঙে তৈরি করেছি। এটা এসেছে মূলত টেক্সটিংয়ের অভিজ্ঞতা থেকে। আমি নিজে কিন্তু টেক্সট মেসেজ করা শুরু করেছি একেবারে শুরু থেকেই এবং প্রায় সারাক্ষণই এটা ব্যবহার করি।
এই যে ব্যবহারকারীর সঙ্গে আন্তসংযোগ—এটা সামনের দিনগুলোতে কোনদিকে যাচ্ছে?
স্যাম: আসছে দিনগুলোতে ব্যাপারটা অনেকটা দুজন মানুষের কথোপকথনের মতনই অর্থপূর্ণ ও কার্যকর হবে। সেপ্টেম্বর ২০২৩–এ চ্যাটজিপিটিতে ভয়েস ও ইমেজ যুক্ত হয়েছে। আমরা চাই, অল্প কথার মধ্য দিয়ে যেন ব্যবহারকারী সবচেয়ে বেশি লাভবান হতে পারেন। এই মডেল যত বেশি আপনাকে মনে রাখতে ও বুঝতে পারবে, তত বেশি আপনার জন্য করতে পারবে, আপনি যত অল্প প্রম্পোটই দেন না কেন।
আপনি কি বলছেন, এই পরিবর্তনগুলো ফোনের মাধ্যমে ঘটবে, না কি সবখানেই?
স্যাম: আমি মনে করি, সব ক্ষেত্রেই এবং পরিবর্তনগুলো প্রায় একই সঙ্গে ঘটবে। এখনো আমরা এ রকম শুনি এবং এ রকম শুনতেই অভ্যস্ত যে ‘আমি আপনাকে এআই সেবা দিচ্ছি।’ কিন্তু অচিরেই সব পণ্য এবং সেবায় কিছু না কিছু পরিমাণ বুদ্ধিমত্তা সংযুক্ত হবে। এখন যেমন আমরা হামেশাই নানা রকম মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করি, ঘটনাটা সে রকমই হয়ে দাঁড়াবে।
আপনি এআই প্রযুক্তিকে একদিকে বলেছেন, মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি, আরেক দিকে বলেছেন, সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা। কেন?
স্যাম: এ বিষয়ে আমরা সবাই নিঃসন্দেহ যে এআই এর ক্ষেত্রে সবচেয়ে ধোঁয়াশার জায়গা হচ্ছে, একই সঙ্গে এর ভালো এবং খারাপ করার বিপুল ক্ষমতা। অবশ্যই আমরা যত বেশি সম্ভব ভালোটাই নেওয়ার এবং ক্ষতিকর দিকগুলো প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়ে যাব; কিন্তু এই যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার একটা ক্ষমতা আমরা পৃথিবীর কাছে উন্মোচিত করে দিচ্ছি, সেটাতেই আমার বড় ভয়। কারণ, যদিও আমরা দীর্ঘদিন ধরে এআই প্রযুক্তি সহজলভ্য ও ব্যবহারযোগ্য হোক এটা চাইছিলাম, সাই-ফাই মুভিগুলো তা–ই দেখাচ্ছিল; কিন্তু এখন দেখছি বাস্তবে এআই শুধু নিছক কিছু পরিবর্তন আনছে তা নয়; বরং মানুষ কীভাবে কাজ করবে, কীভাবে শিখবে, কীভাবে জগতের সঙ্গে যুক্ত হবে এসব বিষয়েই একটা পুরোমাত্রার রূপান্তর ঘটিয়ে দিচ্ছে।
মা–বাবা বা অভিভাবক হিসেবে আপনি কি দুশ্চিন্তায় পড়ে যাচ্ছেন না যখন ‘টাকা লাগবে’ বা ‘সাহায্য লাগবে’ বলে আপনার সন্তানের ফোন আসছে, সে কি আসলেই আপনার সন্তান কি না?
স্যাম: এটা অচিরেই আসলে একটি গভীর সমস্যা হতে যাচ্ছে। মা–বাবা হিসেবে দুশ্চিন্তা করছি; কারণ এ রকম সাহায্য চেয়ে আসা ফোনকলগুলোকে এবং ফোনে শোনা কণ্ঠগুলোকে আর বিশ্বাস করা যাবে না। সবাইকে এই ঝুঁকিগুলো নিয়ে জানানো দরকার।
আমাদের কি তাহলে বাচ্চাদের সঙ্গে একটি কোড শব্দ থাকা দরকার, যাতে যাচাই করা যায়, সে সত্যিই আমার সন্তান কি না?
স্যাম: হুম, কোড শব্দগুলো সমাধানের মধ্যে একটি হতেই পারে। ভিডিওর মাধ্যমে বা গোপন কোনো সংকেতবার্তার মাধ্যমেও যাচাই করা যেতে পারে। প্রযুক্তিগত সমাধান বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা তো তৈরি হবেই; সেই সঙ্গে সামাজিক ব্যবস্থাগুলোও কাজ করতে হবে। আমি চিন্তিত হলেও এটা বিশ্বাস করি যে নতুন নতুন ঝুঁকি তৈরি হতে থাকলেও মানব জাতি হিসেবে এগুলো সামাজিকভাবে মোকাবিলায় আমরা বেশ দক্ষ।
পারমাণবিক শক্তির ক্ষেত্রে যেমনটি হয়েছে, আপনি তেমন একটি বৈশ্বিক তদারকি বা নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার কথা বলেছেন।
স্যাম: দেখুন এ বিষয়ে আমি আসলে বিশেষজ্ঞ নই, তার ওপর আমি নিজে যেহেতু এই প্রযুক্তি–সংক্রান্ত শিল্প ও ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত; তাই আমরা যখন নিজেদের নিয়ন্ত্রণের কথা বলব, অন্যদের সেটা বেশ খানিকটা সন্দেহ বা দ্বিধা নিয়ে বিবেচনা করবার অধিকার আছে। তবুও আমি এমন কিছু নিয়মনীতি আরোপের কথা বলছি; যেগুলো আমাদেরই বেশি ভোগাবে। যেহেতু এই প্রযুক্তির ঝুঁকির মাত্রাটা অনেক বেশি, তাই খুব শক্তভাবে সামাজিক স্বার্থেই নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে এবং একধরনের সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। এই কাজটা করতে পারলেই এআইয়ের যা কিছু ভালো তার পূর্ণাঙ্গ সুফল মানবজাতি ভোগ করতে পারবে।
এখনই করা যায় এমন সুনির্দিষ্ট কিছু কি ভাবছেন?
স্যাম: হ্যাঁ, ছোটখাটো বেশ কিছু বিষয় আছে, যেটা নিয়ে বিরোধের অবকাশ কম। যেমন আমি মনে করি, এআইয়ের তৈরি করা সব কনটেন্টের ক্ষেত্রে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া দরকার যে এটি এআইয়ের তৈরি; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এটুকুতেই আমরা সবাই এখনো সম্মত হতে পারিনি। আমার মনে হয়, এটা করা না গেলে একটা সুযোগ হারাব আমরা।
ওপেন এআইতে আপনারা কোনো প্রোডাক্ট বা প্রযুক্তি তৈরির ক্ষেত্রে একেবারে পূর্ণাঙ্গতা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা না করে একটু যেন আগেভাগেই মানুষের কাছে নিয়ে আসছেন। এটা কেন?
স্যাম: আমরা এটা করি আসলে মানুষের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য। আমরা মানুষকে দেখাতে চাই, কী হচ্ছে এবং কী হতে যাচ্ছে, একই সঙ্গে সবার মতামত ও অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রযুক্তিকে তৈরি করতে চাই যাতে তা সমাজের সবচেয়ে বেশি মানুষের, সম্ভাব্য সবচেয়ে বেশি উপায়ে কাজে লাগে। আমরা চাই না যে একটি প্রযুক্তি বাজারে ছেড়ে তারপর ব্যবহারকারীদের সঙ্গে কথা বলতে। এই যে সবার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমরা তাঁদের মতামতকে আমলে নিচ্ছি; এটা আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সাধারণ মানুষ এখন এআই ব্যবহার করতে শুরু করেছে, একধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, এ কথাও বলা যায়। আপনার কি মনে হয়, কোথায় তারা ভুল করছে বা ভুল বুঝছে?
স্যাম: একটা বিষয়ে মানুষ স্পষ্টতই ভুল–বোঝাবুঝির মধ্যে আছে—এআই কি আমাদের একটা নিত্যদিনের ব্যবহারের টুল বা প্রযুক্তি না কি আমাদের মতনই একটা প্রাণী। এমনকি যাঁরা নিশ্চিতভাবেই জানেন যে এটা কেবলমাত্র একটা টুল, তাঁরাও অবচেতনে কখনো কখনো এআইকে মানবরূপ দিয়ে ফেলছেন এবং সেই মতো আচরণ করছেন।
যেটা দরকার তা হলো, শুধু মুখে কথা না বলে, এআইয়ের সঙ্গে মানুষের আরও বেশি ও গভীরভাবে সংযুক্ত হওয়া দরকার। মানুষকে দেখাতে হবে এবং মানুষকেও নিজেদের অভিজ্ঞতা নিতে হবে এআই কী করতে পারে, একে ব্যবহারের সুবিধা, অসুবিধা, সীমাবদ্ধতা, শক্তির জায়গাগুলো কোথায়। এই ব্যাপারটা এখনই শুরু করা উচিত। কারণ, এতে সময় লাগবে। আশার কথা এই যে বিভিন্ন দেশের সরকারও এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় মনোযোগ ও গুরুত্ব দিচ্ছেন।
আপনি বিভিন্ন সময়ে বলেছেন ও লিখেছেন যে, কোন কোন বিবেচনায় এআইয়ের অগ্রযাত্রা একটু ধীরগতির করতে হতে পারে। সেগুলো কী?
স্যাম: প্রথমত, আমরা যখন অনুভব করবই যে এআইয়ের অগ্রগতি এমনভাবে হচ্ছে যে আমরা সেটা বুঝতে পারছি না। দ্বিতীয়ত, যদি দেখা যায় যে এই প্রযুক্তির কারণে সমাজে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে এবং তৃতীয়ত, যদি দেখা যায় যে এই প্রযুক্তি এমন দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে যে মানুষের ভালো থাকার অন্য প্রযুক্তির উন্নয়ন বা লভ্যতার সঙ্গে এর সামঞ্জস্য থাকছে না, তখন।
এই যে যেদিকে তাকাই, এখন দেখা যাচ্ছে সবাই এআই নিয়ে কাজ করছে, নতুন নতুন উদ্যোগে, বিনিয়োগে বাজার ভরে যাচ্ছে, আপনি কি কোনো চাপ অনুভব করেন?
স্যাম: আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না, আমি এটা সব সময়ই বলে আসছি, আমি মোটেও চাপ অনুভব করি না। কারণ, এআইয়ের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ ধরনের প্রযুক্তির প্রচলন বা প্রসার আগে কখনো ঘটেনি। এআই সমাজকে মৌলিকভাবে এতটাই বদলে দেবে যে কে কতটুকু বাজার দখল করল বা বাজার হারাল, সেই ব্যাপারটা এখানে একেবারেই গৌণ। আমাদের মনোযোগ দিতে হবে, কীভাবে আমরা এই নতুন পরিস্থিতি যেন দিন শেষে ক্ষতিটাকে ন্যূনতম পর্যায়ে রেখে সমাজের ভালোই করে, সেই দিকে।
ইশতিয়াক মান্নান আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত বিশেষজ্ঞ