সলিমুল্লাহ খান
সলিমুল্লাহ খান

বিশেষ সাক্ষাৎকার: সলিমুল্লাহ খান

সংস্কার আমাদের সংবিধান থেকেই শুরু করতে হবে

সলিমুল্লাহ খান ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের অধ্যাপক। আইনশাস্ত্র, ধ্রুপদি অর্থশাস্ত্র, ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্ব, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি, ইতিহাস ও সাহিত্যে তাঁর পাণ্ডিত্য রয়েছে। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান, অন্তর্বর্তী সরকারের কর্তব্য, সংবিধান সংশোধন—এসব বিষয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনোজ দে

প্রশ্ন

ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে পরিণত হলো এবং শেষ পর্যন্ত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকারের পতন হলো। এই আন্দোলনের একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল হাসিনা সরকারের পতন। কিন্তু আরও অনেক জনআকাঙ্ক্ষাও তৈরি হয়েছে। আপনার বিবেচনায় সে আকাঙ্ক্ষাগুলো কী?    

সলিমুল্লাহ খান: হাসিনা সরকারের পতনের কারণটা যদি আমরা অনুসন্ধান করি তাহলে জনআকাঙ্ক্ষার একটা চেহারা ভেসে উঠবে। হাসিনা সরকারের প্রথম দোষ হলো ২০০৯ থেকে শুরু করে ২০২৪-এর ৫ আগস্ট পর্যন্ত তাঁর যে শাসনকাল, তাতে বড়জোর বলা যায় প্রথমটাতে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরের তিন মেয়াদের তিনটি নির্বাচনই ত্রুটিপূর্ণ ছিল। এ কারণে মানুষ জানে যে তাঁর সরকার অনির্বাচিত সরকার। আমাদের মতো প্রজাতন্ত্রে মানুষ রাষ্ট্রের উপর নিজের মালিকানা দাবি করতে পারে কেবলমাত্র নির্বাচনের মাধ্যমে। সেটাও যদি কেউ কেড়ে নেয়, তাহলে সেই জবরদখলকারী সরকারকে উৎখাত করা ছাড়া মানুষের আর কী উপায় থাকে!    

জবরদখলকারী হাসিনা সরকার তাদের বৈধতার জন্য মুখে দুটি বয়ান দিয়ে আসছিল। তারা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে একদলীয় ব্যাখ্যা দিয়েছিল। আমি বলব এই ব্যাখ্যাটা অর্ধসত্য, যেটা অসত্যের চেয়ে মারাত্মক। দ্বিতীয়টা উন্নয়নের বয়ান। সেই উন্নয়নে জনগণের কী লাভ হয়েছে সেটা বিচার করলে দেখা যায় জনগণের বিশেষ কিছু লাভ হয়নি। আয় বণ্টনের যে বৈষম্য সেটা কমেনি, বরং বেড়েছে।

এটা ঠিক যে দেশে কতগুলো চোখে পড়ার মতো উন্নয়নকর্ম হয়েছে। কিন্তু হাসিনার উন্নয়নের বয়ান মানুষ গ্রহণ করেনি। আমি এখানে অর্থনীতিবিদদের একটু সমালোচনা করতে চাই। উন্নয়ন নিয়ে তাদের যে মাপকাঠি সেটাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দেশের জনগণের মধ্যে হতাশা বেড়েছে, আফসোস বেড়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, বঞ্চনাটা বেড়েছে। বেকারত্বের দিকে তাকালে সেটা দেখা যায়। বেকারত্বের জায়গা থেকেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত বলা যায়।

জনআকাঙ্ক্ষার প্রশ্নে যদি আসি, তাহলে প্রথমেই বলব, প্রত্যেক মানুষই চায় নিজের মর্যাদা। হাসিনা সরকারের সবচেয়ে বড় খারাপ কাজ ছিল সাধারণ মানুষের মতামতকে উপেক্ষা করা। কথায় কথায় মানুষকে অপমান করেছে তারা। দ্বিতীয় খারাপ কাজ হলো সাধারণ মানুষের বৈষয়িক স্বার্থকে একেবারে লঙ্ঘন করা। সাইবার নিরাপত্তা আইনসহ সর্বশেষ তারা যে আইন করেছিল তার মাধ্যমে সরকারকে যেকোনো ধরনের সমালোচনা অথবা পরিহাস করার ক্ষমতা পর্যন্ত কেড়ে নেয়া হয়েছিল। এতে বোঝা যায় হাসিনা সরকার প্রকৃত অর্থেই প্রতিনিধিত্বশীল ছিল না।

প্রশ্ন

একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। এই সরকারের আশু কর্তব্য ও দীর্ঘমেয়াদি কর্তব্য কী বলে মনে করেন?

সলিমুল্লাহ খান: হাসিনা টিকে ছিলেন তাঁর আগের আমলের অত্যাচার, অবিচার, বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের যে ঐক্যের কারণে জনগণের মধ্যে যে ভয় ছিল তার সূত্রে। সেই ভয়কে মূলধন করেই হাসিনা টিকে ছিলেন। লোকে বলত, হাসিনা চলে গেলে যদি বিএনপি আসে! এটাকে বলা যায় ভারসাম্যজনিত শূন্যতা। পৃথিবী ও চাঁদের মাঝামাঝি মহাকাশে একটা জায়গা আছে, যেখানে নভোচারীর ওজন শূন্য হয়ে পড়ে। এ রকম একটা অচলাবস্থার মধ্যেই বিগত সরকার টিকে ছিল। বিএনপিই ছিল হাসিনার মূলধন।

গত ১৫ বছরে বিএনপি বহু আন্দোলন করেও সফল হতে পারেনি। এর কারণ বিএনপির ভেতরেও অজস্র টানাপোড়েন। বিএনপি একটা একক রাজনৈতিক দল নয়, অনেক দলের সমষ্টি। আওয়ামী লীগ খানিকটা দল হলেও সেটা এক পরিবার ও একব্যক্তিকেন্দ্রিক। ছাত্ররা সফল হয়েছেন এ কারণে যে, তাঁরা জনতাকে আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন। এই জনতাকে বিএনপি আকৃষ্ট করতে পারেনি। ছাত্ররা পেরেছেন তাঁদের কোনো অলৌকিক গুণ আছে বলে নয়, তাঁদের সাহস ও দূরদৃষ্টির কারণে। হাসিনা সরকারও বুঝতে পেরেছিল ছাত্রদের শক্তি। তাই ছাত্রদের বুকে গুলি করতে তারা পিছপা হয়নি। এ ধরনের গুলিবর্ষণ পৃথিবীর সব দেশেই জনতাকে আন্দোলনে টেনে নিয়ে আসে।

এ ছাড়া আমাদের এখানে প্রচণ্ড বেকারত্ব সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এ অবস্থায় আর্থিক দুর্নীতির যে বিপুল চিত্র প্রকাশিত হলো সেটাও হাসিনা সরকারকে জনগণের সামনে সম্পূর্ণ উদোম করে দেয়। এই অবস্থায় একটা ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গও দাবানল সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশে জুলাই-আগস্ট মাসে সেটাই ঘটেছে।

অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে ছাত্রদের আন্দোলনকে মূলধন করে। ছাত্ররা নিরপেক্ষ লোক হিসেবে বিশ্ববরেণ্য মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে এসেছেন। সরকারের এক মাসও পার হয়নি এখন পর্যন্ত। অন্তর্বর্তী সরকার যা যা করতে পারে তার তালিকা দুই ভাগে বিন্যস্ত করা যায়। প্রথমত, বিগত সরকার, তার আগের সরকার এবং তারও আগের সরকারের আমল মিলে যে বিশাল জঞ্জাল স্তূপীকৃত হয়েছে, তা পরিষ্কার করা। সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছে, দেশ দুর্নীতিতে ভরে গেছে। এসব দূর করতে হবে।

দ্বিতীয় কাজের মধ্যে আছে, নতুন কিছু গড়ার প্রস্তাব। নতুন একটা ব্যবস্থা প্রবর্তনের ম্যান্ডেট এই সরকারের আছে কি না, তা নিয়ে একটা বিতর্ক আছে। নির্বাচনের আগে কতটুকু সংস্কার করা যাবে, তাও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। নির্বাচন ও সংস্কার পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। সংস্কার না করলে নির্বাচন হবে না, আবার নির্বাচন না করলে সংস্কারের কর্তৃত্ব পাওয়া যাবে না। এই দ্বন্দ্ব জীবিত আছে।

এখন তাহলে কোথা থেকে শুরু করতে হবে? শুরু করতে হবে ইতিহাসের দিক থেকে। ঘটনা যা ঘটে গেছে সেখান থেকে। দেশে একটা রাজনৈতিক অভ্যুত্থান ঘটেছে। সেটা জনসমর্থনধন্য। এই অভ্যুত্থানেই আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী পলায়ন করেছেন এবং জনগণ ছাত্রদের বৈধতা দিয়েছে। এটা নির্বাচনের বিকল্প। এই বিকল্পটা সাময়িক। সময়টা কত দীর্ঘ হবে, তাও জনগণের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। সময়টা আগে থেকে বলে দেওয়া যাচ্ছে না।

জনগণের ইচ্ছা, আগের সরকার যে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করেছে, সেগুলোর ন্যূনতম মেরামত না হওয়া পর্যন্ত নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব হবে না। দুটি বিষয় এখানে বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন ব্যবস্থা পরিপক্ব হওয়ার আগে নির্বাচন অনুষ্ঠান করলে বড় ধরনের ক্ষতি হবে। আবার ব্যবস্থা ঠিক হওয়ার পরেও অনেকদিন পর্যন্ত নির্বাচন করা না গেলে তার ফল হবে আরো ভয়াবহ। নির্বাচনের জন্য কোনটা যে সঠিক সময়, সেটা মানুষই নির্ধারণ করবে।

সলিমুল্লাহ খান
প্রশ্ন

রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নটি সব জায়গায় জোরালোভাবে উঠছে। কোন কোন জায়গায় সংস্কার দরকার? কী ধরনের সংস্কার করতে হবে?

সলিমুল্লাহ খান: সংস্কার শুরু করা উচিত সংবিধান থেকেই। যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। তাই ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর আন্দোলনকারী চার জোট সর্বজনসম্মত সিদ্ধান্ত নেয় যে ভবিষ্যতে যতদিন প্রয়োজন নির্বাচনসমূহ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যস্থতায় হবে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। সমস্যার সূত্রপাত বিএনপি করল ১৯৯৬ সালে। পরে বিএনপি সংবিধান এমনভাবে সংশোধন করল, যাতে অবসরগ্রহীতা বিচারপতিদের বয়স ৬৫ থেকে ৬৭ বছরে পৌঁছল। বিএনপিকে তার ঐতিহাসিক দায় নিতে বাধ্য। এদিকে ত্রয়োদশ সংশোধনীর কল্যাণে আওয়ামী লীগ সেই দায়কে বহুগুণ বৃদ্ধি করল। তারা তত্ত্বাধায়ক ব্যবস্থা উঠিয়ে দেয়। আওয়ামী লীগ যা করেছে তাকে বলা যায় সাংবিধানিক গর্ভপাত। এটাই আজকের সংকটের গোড়ার কথা। প্রথমে এটার সমাধান করতে হবে।

শেখ হাসিনার সর্বশেষ অপকর্ম ছিল নির্বাহী আদেশবলে জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ করা। অন্তর্বর্তী সরকার সেই প্রজ্ঞাপনটি বাতিল করেছে। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার প্রশ্নে বর্তমান সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, তাঁরা তা করবেন না। এতে মনে হয় আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগও অংশগ্রহণ করতে পারবে। অবশ্য কোনো ব্যক্তি যদি গুরুতর অপরাধী সাব্যস্ত হন, তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। এ প্রশ্নে আরও আলোচনার অবকাশ আছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন নির্বাচন হয়ে গেলে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ক্ষমতায় আসবেন। আমরা যদি রাজনৈতিক সংস্কার শুরু করতে চাই তাহলে সর্বপ্রথমে অর্থবহ অর্থনৈতিক সংস্কারের কাজে হাত দিতে হবে। অর্থনৈতিক সংস্কার আর রাজনৈতিক সংস্কার কাগজের এপিঠ আর ওপিঠের মতো।

প্রশ্ন

অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কার করবে, নির্বাচিত সরকার সেটা মানবে, এমন নিশ্চয়তা কী আছে?

সলিমুল্লাহ খান: আমরা সবাই বলি, ইতিহাস থেকে আমরা একটা শিক্ষাই গ্রহণ করি, সেটা হলো ইতিহাসের শিক্ষাটা কেউ গ্রহণ করি না। নির্বাচনের আগে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে এই মর্মে প্রতিশ্রুতিপত্র বা ইশতেহার দিতে হবে, যে সমস্ত মৌলিক সংস্কার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার করবে সেগুলো তারা মেনে চলবে। এটা অনেকটা আইনগত কাঠামো আদেশের মতো কাজ করবে।

যেমন, কেউ ক্ষমতায় গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বাতিল করবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার একটা সমস্যা ছিল, তা আমরা দেখেছি। একসময় ভাবতাম বিচার বিভাগ নিরপেক্ষ জায়গা। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কারণে বিচার বিভাগের সেই নিরপেক্ষতাও নষ্ট হয়েছে। আমরা একসময় মনে করতাম, সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের নিরপেক্ষ শক্তি। এখন দেখছি তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

অনেকে দাবি তুলেছেন, র‍্যাবের মতো সংবিধানবহির্ভূত যে সমস্ত বাহিনী গঠিত হয়েছে, সেগুলো বিলুপ্ত করতে হবে। র‍্যাবের গঠন সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। র‍্যাব হোক, ডিবি হোক আর পুলিশ হোক, কোনো নাগরিককে বিনা বিচারে ২৪ ঘণ্টার বেশি বন্দি রাখা যাবে না। একই কথা ডিজিএফআই বা প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দেশে সামরিক বাহিনী থাকবে আর তার গোয়েন্দা বাহিনী থাকবে না, সেটা হতে পারে না। তবে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা যে অভিযোগ করেছিলেন তা যদি সত্য হয় তবে ডিজিএফআইকে নিয়েও দেশবাসীর নতুন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বন্দুকযুদ্ধ, ক্রসফায়ার—এগুলো বেশুমার হত্যা, বেওয়ারিশ হত্যা, পাইকারি হত্যা বৈ নয়। এগুলো বন্ধ করা চাই। গুমের বিষয়ে একটা তদন্ত কমিশন হয়েছে। একে আমরা স্বাগত জানাই। কোনো স্বাধীন দেশে গুম আর নির্বিচার লোকহত্যা চলতে থাকবে কল্পনাও করা যায় না। গুম পরাধীন দেশে হয় বলে আমরা শুনতাম। অথচ আমাদের স্বাধীন দেশে কেন এত বেশুমার হত্যা, এত গুমের ঘটনা ঘটেছে, তার মূল কারণ এখনো আমরা নির্ণয় করতে পারি নাই। বিগত ৫০ বছর ধরে দেশে ধনসম্পদ ও পুঁজি সঞ্চয়নের যে প্রক্রিয়া চলেছে, তাতে সরাসরি বিদেশি শক্তির হাতও আছে। এ কারণে রাষ্ট্র বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

আমি মনে করি সংবিধান সংশোধনীর দ্বিতীয় কাজ হবে মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে এমন আইন প্রণয়ন নিষিদ্ধ করা। প্রয়োজন হলে সংবিধানে যথাযথ সংশোধনী আনয়ন করে সেটা করতে হবে। বর্তমান সংবিধানেও আছে মৌলিক অধিকার সংশোধনের অতীত। কিন্তু তা তো কার্যকর হয় না। ঘোষণা আর কার্যক্ষেত্রে বাস্তবায়নের মধ্যে এই ফারাকটা বিলুপ্ত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমরা মার্কিন দেশের সংবিধান অনুসরণ করতে পারি। সেখানে প্রথম ১০টি সংশোধনী (বা বিল অব রাইটস) সংশোধনের অতীত। বাক্স্বাধীনতা, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অধিকার, সভা-সমিতি বা সংগঠন করার অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। আমাদের এখানেও তা অস্বীকার করা যাবে না।

সলিমুল্লাহ খান
প্রশ্ন

সংবিধান সংস্কারসহ সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান রচনার দাবিও উঠেছে নানা মহল থেকে। আপনি কী মনে করেন? বাস্তবসম্মত পথ কী?

সলিমুল্লাহ খান: এবার যা ঘটেছে তা অভ্যুত্থান। তা ঘটেছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এবং তাঁর সরকার কর্তৃক জনগণের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে। সংবিধানের যে অংশগুলো শেখ হাসিনা সংশোধন করেছেন, সেগুলো বাতিল ঘোষণা করতে হবে। অন্যান্য সরকারের আমেলেও যে সকল সংশোধনী ও আইনের মাধ্যমে মৌলিক অধিকার কার্যত হরণ করা হয়েছিল, সেগুলোও বাতিল করতে হবে।

নতুন সংবিধান  প্রণয়ন না ও পুরোনো সংবিধানের সংশোধন—এই তর্ক একাডেমিক। ১৯৭২ সালের সংবিধান লেখা হয়েছিল ভারতের সংবিধানটাকে আদর্শ ধরে। আমাদের নতুন (সংশোধিত বা লিখিত) সংবিধান হবে সরল। প্রথম ভাগটা হবে মৌলিক অধিকার বিষয়ক, দ্বিতীয় ভাগে থাকবে সরকারের গঠনতন্ত্র।

সংবিধানে সর্বক্ষমতা যেতে হবে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত আইনসভার ওপর। বর্তমান সংবিধান আইনসভাকে রেখেছে পঞ্চম ভাগে। চতুর্থ ভাগে রেখেছে নির্বাহী বিভাগকে। এভাবে অনেকটা অজ্ঞানেই আমাদের গঠনতন্ত্র নির্বাহী বিভাগকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের শুরুতেই রয়েছে কংগ্রেস বা আইনসভা, তারপর নির্বাহী বিভাগ, পরে বিচার বিভাগ। সেখানে রাষ্ট্রপতির চেয়েও বড় আইনসভা (সিনেট ও হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ)। আমাদের এখানে আইনসভার এ গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

সবার আগে আইনসভার কর্তৃত্ব তৈরি করতে হবে। আর তা করতে হলে আইনসভার সদস্যদের সত্যি সত্যি নির্বাচিত হতে হবে। কোনো সদস্য যদি গুরুতর অসদাচরণ করেন, তাহলে বিচারপতিদের অপসারণের যেমন বিধি আছে, তেমনি তাঁদেরও অপসারণের বিধান থাকতে হবে।

সরকারের তিন বিভাগের মধ্যে আইনসভাকে সবার ওপরে স্থান দিতে হবে। এর অধীনে অর্থাৎ আইনসভার যাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা, তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন। বিচার বিভাগের সদস্য বা বিচারকদেরও আইনসভার অনুমোদন ছাড়া নিয়োগ বৈধ হবে না। যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেসের অনুমোদন লাভ না করলে কেউ উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিযুক্ত হতে পারেন না। যুক্তরাষ্ট্রে ধনতন্ত্রের সর্বোচ্চ বিকাশ হয়েছে। আমরা তাদের সমান নই, কিংবা তাদের অনুকরণ করার সময়ও হয়তো আসেনি। কিন্তু ছায়া হিসেবে বাস্তবে সব ক্ষেত্রেই আমরা তো তাদের অনুসরণ করেই থাকি। তাহলে এক্ষেত্রে করব না কেন?

অনেকে বলেন, এক কক্ষের জায়গায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ হলে বেহতর হবে। অনেকে মনে করেন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য বিধান করলে ভালো হবে। অনেকে মনে করেন, দেশকে আট-নয়টি প্রদেশে বিভক্ত করলেই হয়তো ভালো হবে। এগুলোর কোনোটাই মৌলিক সংস্কার নয়। এগুলো ঘায়ের ওপর প্রলেপ দেওয়া। আসল কথা, নির্বাচন হতে হবে নির্বাচনের মতো। জনগণের অধিকার অলঙ্ঘনীয় রাখতে হবে। যারা মিথ্যা মামলা রুজু করবেন, তাঁদেরও শাস্তির বিধান থাকতে হবে।

প্রশ্ন

এখানে যে স্বৈরতান্ত্রিক ও বংশানুক্রমিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা চলে আসছে, তা থেকে বের হয়ে আসার পথ কী?

সলিমুল্লাহ খান: প্রশ্নটা হচ্ছে, শেখ হাসিনা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকলেন কীভাবে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে যখন তিনি প্রকারান্তরে জালিয়াতিই করলেন, তখনই তাঁর বিদায় নেওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু ইতিহাসের যে ভারসাম্যজনিত শূন্যতার কথা আগে বলেছি, তার কল্যাণে আর আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের কল্যাণে আওয়ামী লীগ ১৫ বছর ধরে জনগণের ওপর অত্যাচার করেছে। তাই সরকার পতনের পর জনগণের রোষ লীগের ওপর হামলে পড়েছে। কেন তাদের ওপর হামলা হয়েছে, সেটা বোঝা কঠিন নয়।

অনেক হিন্দু পরিবার আক্রান্ত হয়েছেন, এ কথা সত্য। কিন্তু বেছে বেছে হিন্দুদের উপর আক্রমণ হয়েছে, এমনটা বলা বোধ হয় ঠিক নয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছেন, হিন্দুসহ সব সংখ্যালঘুর অধিকার যেন রক্ষিত হয়। তিনি বলতে পারতেন, বাংলাদেশের সব জনগণের অধিকার যেন রক্ষিত হয়। এই যে উদারতার অভাব, এটা আমাদের এই অঞ্চলের রাজনীতিবিদদের একটা বৈশিষ্ট্য।

আমাদের দেশে পরিবারতন্ত্র এবং পরিবারতান্ত্রিক রাজতন্ত্র যদি উঠেও যায়, স্বৈরতন্ত্রের উদয় যে হবে না তার নিশ্চয়তা নেই। এখানে রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র আছে। সেটা শুধু শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। আমরা মফস্বলেও দেখেছি, এমপি সাহেবদের পুত্র–কন্যারাও এমপি সাহেব-বেগম হচ্ছেন। এটা বোধ হয় আমাদের সমাজে স্বাভাবিক। এ থেকে বের হতে গেলে দেশের রাজনীতিতে মৌলিক সংস্কার করতে হবে।

গণতন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে, সবার কাছ থেকে নিতে হবে তার সামর্থ্য অনুযায়ী, আর সবাইকে দিতে হবে তার প্রয়োজন অনুসারে। সামাজিক সুযোগ-সুবিধার বণ্টন করতে হবে সমানাধিকারভিত্তিক। যখন আমাদের সকল ছেলেমেয়েই স্কুলে যেতে পারবে, তাদের টাকাপয়সার, খাদ্যের আর ওষুধের অভাব হবে না, প্রাইভেট টিউটর থাকলে সবার থাকবে, না থাকলে কারও থাকবে না—এ অবস্থায় প্রতিযোগিতা করে যারা জিপিএ-৫ পাবে, তারাই স্বীকৃত হবে প্রকৃত মেধাবীরূপে। তাদের শাসন যদি প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলেই আমরা বর্তমান ধারা থেকে বেরিয়ে আসার আশা করতে পারব।

প্রশ্ন

অন্তর্বর্তী সরকার একটু ধীরে চলো নীতিতে এগুচ্ছে। তাদের মধ্যে কোথাও কি কোনো সংশয় কাজ করছে?

সলিমুল্লাহ খান: অনেকে মনে করছেন বাংলাদেশ দুর্বল রাষ্ট্র, তার স্বাধীনতা রক্ষা করা সম্ভব নয়। আমি বলব, দেশটা যখন আমাদের পক্ষে যখন স্বাধীন করা সম্ভব হয়েছে, তা রক্ষা করাও অসম্ভব নয়। আমিও মনে করি, সেটা সম্ভব হবে। আমরা একটা ফাঁপরের মধ্যে পড়েছি, এ কথা সত্য। রাজতান্ত্রিক প্রবণতা এখানে আছে, এটা বংশানুক্রমিক আকারে দেখা দিয়েছে। যদিও মুখে কেউ রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি করেন না, কাজে ঠিক তাই করেন। শেখ হাসিনা তো কার্যত রাজতন্ত্রই কায়েম করেছিলেন। এটাই ছিল শেখ হাসিনার আসল অপরাধ। শেখ হাসিনা একা এক আমলে যে ক্ষতি করে গেছেন তা সারতে বহু দিন, বহু বছর লাগবে।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে একটা দ্বিধা আছে। তারা এখনো নিশ্চিত নয়, আগে সংস্কার করে নির্বাচন দেবে, না নির্বাচন দেওয়ার পর সংস্কার করবে। আমরা বলব, তাদের উচিত জনগণকে বিশ্বাস করা। জনগণের সমর্থন না পেলে, সেনাবাহিনীর উল্লেখযোগ্য একটা অংশের সাহায্য না পেলে, গত ছাত্র-জনগণের আন্দোলনে যে পরিমাণ প্রাণহানি আর রক্তপাত ঘটেছে, তার থেকে অনেক বেশি ঘটত।

এ অবস্থায় দেশকে নৈরাজ্য ও অধঃপতনের হাত থেকে বাঁচাতে হলে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত, সংস্কার করতে তাদের কত সময় লাগবে তা পরিষ্কার ঘোষণা করা। তাদের এখতিয়ারভুক্ত নয়, এমন সংস্কারে হাত দেওয়া সম্ভবত উচিত হবে না। যেমন, বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ মার্কিন নেতৃত্বাধীন চতুর্বর্গ সামরিক জোটে যুক্ত হবে কি না তা নির্ধারণ করতে জনগণের ম্যান্ডেট লাগবে। জোট নিরপেক্ষতার নীতি থেকে বেরিয়ে আসা বাংলাদেশের মতো ছোট দেশের ক্ষেত্রে ভয়ানক আত্মহত্যার শামিল হবে।