ড. হারুন–অর–রশিদ
ড. হারুন–অর–রশিদ

নতুন সরকার ভালোভাবেই দেশ চালাতে পারবে, কোনো সমস্যা হবে না

৭ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত। একদিকে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ বেশ কিছু দল নির্বাচনী প্রচারে ব্যস্ত; অন্যদিকে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো সরকার ও নির্বাচনের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু নাশকতার ঘটনাও ঘটেছে। সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. হারুন-অর-রশিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান

প্রশ্ন

নির্বাচনের পরিবেশ কেমন দেখছেন? ঢাকা শহরে তো নির্বাচনী তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।

ড. হারুন-অর-রশিদ: নির্বাচনী পরিবেশ তো ভালোই। পাড়ায় পাড়ায় প্রার্থীদের নির্বাচনী ক্যাম্প বসানো হয়েছে। পোস্টারে শহর ছেয়ে গেছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় কর্মীরা মিছিল করছেন। নির্বাচনের এখনো ১৪ দিন বাকি আছে। ঢাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থী কম থাকায় প্রচার কিছুটা কম। ঢাকার বাইরে নির্বাচন বেশ জমে উঠেছে।

প্রশ্ন

বিএনপি নেই। এবারের নির্বাচনে কার সঙ্গে কার প্রতিযোগিতা হবে?

হারুন-অর-রশিদ: এই নির্বাচনে বিএনপি না এসে ভুল করেছে। দলের দাবিদাওয়া জনগণের কাছে তুলে ধরার জন্যও বিএনপি নির্বাচনে আসতে পারত। বিএনপির অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের মনোনীত; অর্থাৎ নৌকার প্রার্থীদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতিযোগিতা হবে। কোথাও কোথাও জাতীয় পার্টি, তৃণমূল বিএনপি ইত্যাদি পার্টির সঙ্গেও প্রতিযোগিতা হবে। তবে বিএনপি নির্বাচনে এলে যে ধরনের প্রতিযোগিতা হতো, স্বাভাবিকভাবেই সেটা হবে না।

প্রশ্ন

বিএনপি নির্বাচনে আসেনি, না আসতে দেওয়া হয়নি? ২৮ অক্টোবরের পর তো বিএনপির কয়েক হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হলো। তারা চাইলেও নির্বাচনে আসতে পারত না।

হারুন-অর-রশিদ: বিএনপি তো আগে থেকে এক দফার রাজনীতি করে আসছে। বিএনপি বলেছে, শেখ হাসিনার পদত্যাগ ছাড়া তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না। এর অর্থ, তাদের জয়ের নিশ্চয়তা দিতে হবে। ২৮ তারিখের পর তারা হরতাল-অবরোধের নামে নাশকতা করছে। ট্রেনে আগুন দিয়ে মা ও শিশুকে হত্যা করেছে। নাশকতা ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি একসঙ্গে চলতে পারে না। বিএনপিকে আগে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে আসতে হবে।

প্রশ্ন

নাশকতা কে ঘটিয়েছে, তদন্তের আগেই সরকারি দলের নেতারা, পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তারা বিএনপিকে দায়ী করছেন। নাশকতাকারীদের খুঁজে বের করতে তো নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত হতে হবে।

হারুন-অর-রশিদ: সেই চেষ্টা তো সরকার করছে। গাজীপুরে রেললাইন কেটে ফেলার ঘটনায় তো বিএনপির নেতা-কর্মীরা গ্রেপ্তার হয়েছেন।

প্রশ্ন

বিএনপি জনগণকে একতরফা নির্বাচন প্রত্যাখ্যানের আহ্বান জানানোর পাশাপাশি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?

হারুন-অর-রশিদ: বিএনপির অসহযোগ আন্দোলনের ডাক তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রকাশ। তাদের এই আন্দোলন কেবল আওয়ামী লীগ নয়, স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের ওপর আঘাত। এই আন্দোলনে জনগণের কোনো সমর্থন নেই। ফলে আন্দোলন ব্যর্থ ও অকার্যকর হতে বাধ্য। অসহযোগের নামে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল না দিতে বলেছে বিএনপি। যাদের ন্যূনতম দেশপ্রেম ও জনগণের প্রতি মমত্ববোধ আছে, তারা এ রকম কর্মসূচি দিতে পারে না। বিএনপির এক দফার প্রতি জনগণের সমর্থন থাকলে তো তারা গণ-অভ্যুত্থান করে ফেলতে পারত।

প্রশ্ন

দুই পক্ষের মুখোমুখি অবস্থানে সাধারণ মানুষ তো ভয়ে আছে। তাঁরা কি ভোট দিতে যাবেন?

হারুন-অর-রশিদ: আমি ভয়ের কিছু দেখছি না। বিএনপি ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালেও জ্বালাও-পোড়াও করেছে। মানুষ তাদের আন্দোলনে সাড়া দেননি। এবারও দেবেন না।

প্রশ্ন

আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে যাঁরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছেন, তাঁরাও আওয়ামী লীগের নেতা। তাঁরা কী বক্তব্য নিয়ে জনগণের কাছে যাবেন?

হারুন-অর-রশিদ: এলাকায় কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন না হলে সেটা বলবেন। নৌকা প্রার্থীর সম্পদ বাড়লে সেটি বলবেন। তিনি তাঁর পরিকল্পনা ভোটারদের কাছে তুলে ধরবেন।

আমার ধারণা, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা হবে। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৩০টির বেশি আসন পেতে পারে। স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে নৌকার অনেক প্রার্থী ধরাশায়ী হলেও অবাক হব না। জাতীয় পার্টির অবস্থান হবে তৃতীয়।

প্রশ্ন

৭ জানুয়ারি যেভাবে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তাতে সংকট কাটবে বলে মনে করেন?

হারুন-অর-রশিদ: নির্বাচনের পর নতুন সংসদ গঠিত হবে। সরকার গঠিত হবে। সরকার ভালোভাবেই দেশ চালাতে পারবে। কোনো সমস্যা হবে না। বন্ধুদেশগুলোও বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারা দেখতে চাইবে। তারাও হরতাল-অবরোধ ও নাশকতা চায় না।

প্রশ্ন

কিন্তু দেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে যে নির্বাচন হবে, তাতে গণরায়ের প্রতিফলন ঘটবে না বলেই অনেকে মনে করেন। সে ক্ষেত্রে সংকট কি আরও বাড়বে না?

হারুন-অর-রশিদ: বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক সংকট, সেটি আদর্শিক। বাংলাদেশে দুই প্রধান দল দুই ধারায় বিভক্ত। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আর বিএনপি স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে আন্দোলন করছে। এই বিভাজন আরও অনেক দিন ধরে চলবে।

প্রশ্ন

বিএনপি এখন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চাইছে না। আওয়ামী লীগও তো ১৯৯৬ সালে বিএনপির অধীনে নির্বাচনে যায়নি এবং আন্দোলন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করল। তাহলে বিএনপির এখনকার দাবিকে নেতিবাচকভাবে কেন দেখছেন?

হারুন-অর-রশিদ: তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা নষ্ট করেছে বিএনপিই। তারা বিচারপতির বয়স বাড়িয়ে দিল। ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করল। ফলে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্বাচন হতে পারল না।

প্রশ্ন

২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচনের পর আপনি প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এই নির্বাচনের পর সরকারের পাঁচ বছর ক্ষমতায় না থেকে মধ্যবর্তী নির্বাচন দেওয়া উচিত। এবারও কি আপনি সেটা বলবেন?

হারুন-অর-রশিদ: না, এবারে সেটা বলব না। কেননা, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে গেছে। এবারের নির্বাচনে বিএনপি না এলেও অনেকগুলো দল এসেছে। ফলে নির্বাচনটি একতরফাও হচ্ছে না।

প্রশ্ন

বিএনপিহীন ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি কেমন হবে বলে মনে করেন?

হারুন-অর-রশিদ: আমার ধারণা, বিএনপি না এলেও নির্বাচনটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ভোটার উপস্থিত হলেই সেটা অংশগ্রহণমূলক হবে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালে যে নির্বাচন হয়, তাতেও ভোটারের উপস্থিতি ছিল ৫৫ শতাংশ।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

হারুন–অর–রশিদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।