ড. ফাহমিদা খাতুন, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক। ব্র্যাকের গভর্নিং বোর্ডের সদস্য। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান আটলান্টিক কাউন্সিলের নন-রেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্টডক্টরাল করেছেন। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, সংকট ও উত্তরণের পথ নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাফসান গালিব
প্রথম আলো: বিগত অর্থবছর সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যই ইতিহাসের অন্যতম খারাপ অর্থবছর হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার আসলে কী করছে?
ফাহমিদা খাতুন: সরকারের পক্ষ থেকে কিছু কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো আসলে সীমিত পদক্ষেপ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ওই পদক্ষেপগুলো যে আবার সঠিক, তা–ও নয়। সমস্যা অনুযায়ী যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ছিল, সেগুলোর প্রতিফলন অনেক ক্ষেত্রেই দেখতে পাইনি। আরেকটি বিষয় হচ্ছে সময়োপযোগী পদক্ষেপ না নেওয়া। দেখা যাচ্ছে, সমস্যা তৈরি হয়ে এত ঘনীভূত হয়ে গেছে, তারপর আমাদের হুঁশ হয়েছে যে কিছু একটা করা দরকার। সেদিক থেকে আমি মনে করি, যথেষ্ট পরিমাণে উদ্যোগ বা পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
প্রথম আলো: শ্রীলঙ্কা চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছিল। মূল্যস্ফীতি ৬৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এখন তা তারা ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে এনেছে, যা আমাদের চেয়েও কম। শ্রীলঙ্কা পারল অথচ আমরা পারছি না কেন?
ফাহমিদা খাতুন: সংকট মোকাবিলায় শ্রীলঙ্কা এখন একটা মডেল রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সমস্যা যখন তৈরি হয়েছিল, সেটি যেমন ছিল একটা উদাহরণ, আবার সমস্যা থেকে তারা যেভাবে বের হয়ে এসেছে, সেটাও একটি উদাহরণ। সংকট মোকাবিলায় শ্রীলঙ্কা মূলত দুটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে—মুদ্রানীতি ও আর্থিক নীতি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে পৃথিবীজুড়ে আমরা দেখেছি যে সবাই মুদ্রানীতিকে ব্যবহার করেছে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে অত্যন্ত বেশি হয়ে গেলে মুদ্রানীতিটাকে ব্যবহার করতে হয়। অর্থাৎ ঋণের সুদের হারের ওপর হাত দিতে হয়। সেটিকে বাড়াতে হয়।
শ্রীলঙ্কাসহ অন্যান্য দেশ তা–ই করেছে। তারা সবাই ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে, যাতে বাজারে অর্থ কম যায়। টাকা মানুষের কাছে গেলে তারা তখন তা খরচ করতে থাকবে, যা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেয়। সেখানে একটা লাগাম টেনে ধরতে হয়। কিন্তু আমরা সেটি করিনি। আরেকটি বিষয় হচ্ছে একক কোনো পদক্ষেপ নিয়ে কিন্তু সমস্যার সমাধান করা যায় না, বিশেষ করে বহুমুখী সমস্যার ক্ষেত্রে। শ্রীলঙ্কা আর্থিক নীতি ব্যবহার করার পাশাপাশি রাজস্ব আদায়ের দিকে মনোযোগ দিয়েছে। সেই সঙ্গে প্রশাসনিক ও সরকারি ব্যয় কমানোর দিকে মনোযোগ দিয়েছে।
প্রথম আলো: কয় দিন আগে এক প্রতিবেদনে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি কমে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হবে। এডিবির এ পূর্বাভাসে আপনি কতটা আশাবাদী?
ফাহমিদা খাতুন: আমি খুব একটা আশাবাদী নই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রথমবারের মতো তাদের মুদ্রানীতিতে একটা কাঠামোগত পরিবর্তন এনেছে। সেটি হচ্ছে, এত দিন পর্যন্ত তারা মুদ্রা সরবরাহকে টার্গেট করে মুদ্রানীতি করত। কিন্তু এবার জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত যে মুদ্রানীতিটা করেছে, সেখানে তারা সুদের হারকে টার্গেট করেছে। মানে ওখানে হাত দিয়ে তারা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবে। এখন সেপ্টেম্বর শেষ হতে চলেছে, মূল্যস্ফীতির হার কিন্তু আরও বাড়ছে এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে সাড়ে ১২ শতাংশে পৌঁছে গেছে। আগামী কয়েক মাসে যদি এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকে, তাহলে পরিস্থিতি পরিবর্তন হবে বলে মনে করি না। তা ছাড়া শুধু সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ব্যবহার করে ফল আসবে না, যদি সম্প্রসারণমূলক আর্থিক নীতি ব্যবহার করা হয়। আমাদের এখানে সেটিই ঘটছে। মুদ্রানীতি ও আর্থিক নীতির মধ্যে সমন্বয় নেই।
আরেকটি বিষয় যে মুদ্রানীতি তো স্থির কোনো বিষয় না। মুদ্রানীতি করা হলো, ঋণের সুদের হার বাড়ানো হলো, সেটি যদি আরও বাড়ানোর প্রয়োজন হয়, তা করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের অনেক দেশে এমন পরিস্থিতিতে সুদের হার বাড়িয়ে দেওয়া হয়। আবার মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলে, কিছুদিনের জন্য স্থগিত রাখে। আবার যদি মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়, সুদের হারের ওপর হাত দেয়। ফলে এভাবে অবস্থা বুঝে নীতি গ্রহণ করতে হবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, বাজারে যদি পণ্যের সরবরাহ না থাকে, সুদের হার বাড়িয়েও তেমন কাজ হবে না।
দেশে উৎপাদিত আর বাইরে থেকে আমদানিকৃত দুই ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রেই কিন্তু দাম ঊর্ধ্বমুখী। দেশীয় উৎপাদিত পণ্যের সরবরাহ আছে, কিন্তু উৎপাদক থেকে বাজার পর্যন্ত আসতে মধ্যস্বত্বভোগীদের কয়েকটি ধাপ পার হয়ে আসতে হয়। এতে দাম তো বাড়েই। এরপর কৃত্রিম সংকট তৈরি বা নানা কারসাজি করা হয়। আমদানির বেলায় দেখা যায়, গুটি কয়েক বড় কোম্পানি বা গোষ্ঠী পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এখন এ বিষয়গুলোর জন্য বাণিজ্যবিষয়ক একটা নীতি গ্রহণ করতে হবে। আবার সব নীতির সমন্বয় না থাকলে মূল্যস্ফীতি রাশ টেনে ধরা মুশকিল হবে। আমদানির জন্য আরও কোম্পানিকে সুযোগ দিতে হবে। তখন স্বাভাবিকভাবে একটি প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি হবে। এতে পণ্যের মূল্য কমতে বাধ্য হবে। গত অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের ওপরে দেখেছি, সেখানে বাজারবিষয়ক অন্তর্নিহিত কারণগুলো ঠিক না করলে এ অর্থবছরে আগামী জুন মাসে মূল্যস্ফীতির হার নাটকীয়ভাবে নেমে আসবে না।
প্রথম আলো: জিনিসপত্রের মূল্য বেড়েই চলেছে। পণ্যের দাম বেঁধে দিয়েও ফল মিলছে না কেন? একেকটা সিন্ডিকেট বাজার থেকে শত শত কোটি টাকা তুলে নিচ্ছে। সরকার কিছু করতে পারছে না কেন?
ফাহমিদা খাতুন: সরকার চাইলে সবকিছুই করতে পারে, যদি সদিচ্ছাটা থাকে। কারা এই বাজার কারসাজি করছে, সরকার যে জানে না, এমন তো না। এখন তারা সিন্ডিকেট ভাঙতে চায় কি না, সেটিই প্রশ্ন। সেটি করতে গেলে আমদানিকারকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, পণ্য সরবরাহ, পণ্যের দাম ইত্যাদি একটি ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনতে হবে। এখন একটি পণ্যের দাম বাড়ল, তখন হইচই পড়ে গেল আর সেই পণ্যের জন্য দু-একটা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এরপর আরেকটা পণ্যের দাম বাড়ে, এরপর আরেকটা। এভাবে চলতেই থাকে। এটি এ দেশে নতুন কিছু নয়। এখন সামগ্রিক একটা ব্যবস্থাপনা বা কাঠামো থাকলে সিন্ডিকেটের সুযোগ নেওয়াটা কঠিন হয়ে যেত। সেই ব্যবস্থাপনা থাকলে, প্রয়োজনের মুহূর্তে দ্রুত পণ্য আমদানি করা সম্ভব হয়। কোন্ দেশের পণ্য আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকে, কী ধরনের শুল্ক আরোপ করা হয়, কোন দেশ থেকে পণ্য আনতে কেমন সময় লাগবে—এ–সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়। এখন পণ্যের দাম বাড়ে, আমদানির সিদ্ধান্ত ও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে নিতেই ভোক্তার পকেট খালি হয়ে যায়। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, পণ্যের দাম যখন অনেক বেড়ে যায়, তখন শুল্ক কমিয়েও পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দেওয়া যায়। তবে সেটার জন্য শক্ত নজরদারির প্রয়োজন হয়, যাতে সুবিধাটা ভোক্তারা পেতে পারে।
বাজার কারসাজি ও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। যেমন প্রতিযোগিতা কমিশন বলে একটি প্রতিষ্ঠান আছে, যার কথা অনেকে জানে না। তাদের দক্ষতা ও মানবসম্পদ বাড়াতে হবে। আইনিভাবে এটিকে শক্তিশালী করতে হবে। তারা বিভিন্ন কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করে, কিন্তু সেগুলোর নিষ্পত্তি হয় না। সিন্ডিকেট করার কারণে শাস্তির বিধান থাকলেও তার বাস্তবায়ন আমরা দেখি না। শুধু জরিমানা দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। আরেকটা হচ্ছে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরকেও শক্তিশালী করতে হবে, যাতে তারা কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে। দোকানে দোকানে গিয়ে পাইকারি বা খুচরা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে তো লাভ নেই। দাম বেঁধে দেওয়া হলেও বেশি দামেই তাদের পণ্য কিনে আনতে হয়।
প্রথম আলো: বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়েই যাচ্ছে। তা মূল্যস্ফীতিকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদদের পরামর্শও তারা শুনছে না। টাকা ছাপানো ছাড়া কি আর কোনো পথ নেই?
ফাহমিদা খাতুন: আগে দেখতে হবে টাকা ছাপাতে হচ্ছে কেন। কারণ, সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। সরকার তার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ কয়েকটি সূত্র থেকে যেমন বাণিজ্যিক ব্যাংক, সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে টাকা নিয়ে থাকে। তবে সর্বশেষ পদক্ষেপ হচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে যাওয়া। কোনো সরকারই সেটি করতে চায় না। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া মানে সেটা টাকা ছাপিয়ে দিতে হয়। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কেন সরকারের ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন পড়ছে। কারণ, আমাদের আর্থিক নীতিটা হচ্ছে সম্প্রসারণমূলক। আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে বাড়তি ব্যয়ে। বিভিন্ন কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হয়, এতে ব্যয়ও বেড়ে যায়। জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণেও সেটি হয়, অপচয়ও হয়, দুর্নীতি-অনিয়ম তো আছেই।
আরেকটা হচ্ছে, সরকারের যে প্রশাসনিক ব্যয় বা পরিচালন ব্যয়, সেখানেও তো আমরা কোনো ধরনের কৃচ্ছ্রসাধন দেখি না। কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বিভিন্ন সময় সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বলা হয়েছিল কিন্তু তার কোনো প্রতিফলন আমরা দেখিনি। প্রায় সময় পত্রপত্রিকায় দেখি, বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ হয়নি, গাড়িসুবিধা বাড়ানো হচ্ছে, ভবন বানানো হচ্ছে, পদ না থাকলেও পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। এখন সামনে নির্বাচন, তো এ সময় সরকার প্রশাসনের জন্য সন্তুষ্টিমূলক উদ্যোগ নিচ্ছে। ফলে সরকারের আকার যেমন বাড়ছে, ব্যয়ও বাড়ছে। এ ব্যয়ের ওপর লাগাম টানা হলে, সরকারকে তো ঋণ নিতেই হবে। এখন অন্যান্য ব্যাংক সরকারকে ঋণ দেবে নাকি ব্যক্তি খাতে ঋণ দেবে। এতে তারল্যের ওপর একটা চাপ তৈরি হয়। সে জন্য সরকার একটা সহজ উপায় বের করেছে, তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে চলে যাচ্ছে। এর জন্য টাকা ছাপাতে হচ্ছে, যা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিচ্ছে।
প্রথম আলো: ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণে জর্জরিত। সরকারও ব্যয় মেটানোর জন্য ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিচ্ছে। আবার ব্যাংকগুলোর সংকট সামাল দিতে তাদেরকে টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখানে যে তারল্যসংকট তৈরি হয়েছে, এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পথ কী?
ফাহমিদা খাতুন: কারণগুলোর মধ্যেই পথটা খুঁজে পাওয়া যায়। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই যাচ্ছে। বড় বড় ঋণগ্রহীতা, যঁারা প্রভাবশালী, বিশেষ করে যাঁদের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগসূত্র তৈরি হয়েছে, তঁাদের কারণেই এটি বাড়ছে। তাঁরা ঋণ নিচ্ছেন এবং খেলাপি হচ্ছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, তঁারা কি ব্যবসা করতে বা কোনো কলকারখানা গড়তে গিয়ে বা উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে ঋণখেলাপি হচ্ছেন? সেটা তো নয়। বরং আমরা শুনে থাকি, সেই ঋণের টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির প্রতিবেদন থেকে আমরা এই অর্থ পাচারের কথা জানতে পারি। কিন্তু সেটিও হালনাগাদ এবং সম্পূর্ণ তথ্য নয়। এত ঋণ নেওয়া হচ্ছে ব্যাংক থেকে, ব্যক্তি বা শিল্প খাতে এর বিনিয়োগের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। টাকাটা কোথায় যাচ্ছে আসলে?
খেলাপি ঋণের পরিমাণ বলা হচ্ছে ১ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকার মতো, কিন্তু চাপযুক্ত অর্থাৎ খুব দুর্বল অবস্থায় থাকা ঋণের পরিমাণ তো ৩ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকার মতো। ব্যাংক খাতে মোট ঋণের পরিমাণের ২০ শতাংশের ওপরে খুব দুর্বল ঋণ। এর মানে আসল চিত্রটা বেশ কঠিন। এখন এ পরিস্থিতি থেকে বের হতে হলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। ব্যাংকগুলোকেও নীতি ও গাইডলাইন মেনে স্বাধীনভাবে কাজ করতে হবে। এখন বিষয়গুলো সেভাবে হচ্ছে না, কারণ বাইরে থেকে হস্তক্ষেপ থাকে। এর জন্য আসলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দরকার। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে সুদের হার ৯-৬ করে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, সেটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল। এখন যেটি মুদ্রানীতির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজেরই তো স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা।
প্রথম আলো: কিছুদিন আগে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘অর্থনীতি ভালো চলছে, সবার থেকে ভালো করছে। যাঁরা বলছেন দেশের অর্থনীতি ভালো নেই, তাঁরা অর্থনীতিই বোঝেন না।’ এখন আবার সংকট নিরসনে অর্থনীতিবিদদের থেকে পরামর্শ নিতে তাঁদের সঙ্গে বৈঠকে বসছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়। বিষয়গুলো কীভাবে দেখছেন?
ফাহমিদা খাতুন: মনে হচ্ছে ওনার কাছে অর্থনীতি পড়তে হবে! অর্থনীতিবিদেরা তো অর্থনীতি বিশ্লেষণ করেন সরকারি তথ্যের ভিত্তিতেই। আর অর্থনীতির যে প্রতিঘাত তা কিন্তু সাধারণ মানুষ হাড়ে হাড়েই বুঝতে পারছেন। সাধারণ মানুষই ভালো বলে দিতে পারেন অর্থনীতি কতটা ভালো চলছে, কতটা খারাপ চলছে বা অর্থনীতি তঁাদের জীবনে কতটা প্রভাব ফেলছে। বাজারে গিয়ে দৈনন্দিনের পণ্য কিনতে যখন তাঁর পকেট খালি হয়ে যায়, বাজার তালিকায় কাটছাঁট করতে হয় বা অনেক কিছু না কিনে ঘরে ফিরতে হয়, তঁারাই তখন বুঝে ফেলেন অর্থনীতিটা কেমন চলছে। যঁারা চিকিৎসা বা পড়াশোনার জন্য বিদেশে যাবেন, তার জন্য যে ডলার প্রয়োজন, তা যখন পাওয়া যায় না, তখন তাঁরা বুঝতে পারেন অর্থনীতি কেমন চলছে। সুতরাং এখানে আমাদের নতুন করে বলার কিছু নেই। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য খুবই দুঃখজনক, অসংবেদনশীল ও বাস্তবতাবিবর্জিত।
এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে সলাপরামর্শ করা শুরু হয়েছে, এটি খুবই ভালো উদ্যোগ। এটি আরও আগে শুরু করার দরকার ছিল। এখন অর্থনীতিবিদদের সুপারিশমালা তাদের নীতিমালায় প্রতিফলন ঘটবে, সেটাই প্রত্যাশা।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
ফাহমিদা খাতুন: আপনাকেও ধন্যবাদ।