ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ও বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের ফোরাম সাদা দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ও বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের ফোরাম সাদা দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান

রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কাছে শিক্ষকেরা অসহায়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ও বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের ফোরাম সাদা দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান। তিনি কথা বলেছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতা নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনোজ দে

প্রশ্ন

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দফায় দফায় হামলা হলো। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনে হতাহতের ঘটনা ঘটল। শিক্ষার পরিবেশ অনিশ্চিত হলো। এ রকম একটা অভাবনীয় পরিস্থিতি তৈরির দায়টা কার?

মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান: বর্তমানে যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত আছেন, তাঁদের কেউ কেউ এই আন্দোলনের পেছনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি রয়েছে, এ রকম তকমা এঁটে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। সরকার সমর্থক সুশীল সমাজের দিক থেকেও এ ধরনের বক্তব্য এসেছে।

সরকারের দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার কথা বলা হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হামলার ঘটনা দেখলাম। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটেছে, সেটা অবর্ণনীয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুরে দুর্ভাগ্যজনকভাবে কয়েকজন নিহত হয়েছেন।

দায়িত্বশীল পদে থেকে দায়িত্বহীন বক্তব্য অনেক সময় ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করে, এ ঘটনা তার নজির। ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য যে কেউই আন্দোলন করতে পারে। সেই আন্দোলন যদি শান্তিপূর্ণ না হয়, তাহলে সেটা ঠেকানোর জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে। পেটোয়া বাহিনীকে আন্দোলন ঠেকানোর সেই দায়িত্ব দিয়ে একটা ফৌজদারি অপরাধ করা হয়েছে।

প্রশ্ন

একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে এভাবে মারামারি হলো। লাঠিসোঁটা নিয়ে বহিরাগতরাও সেখানে যোগ দিল। মেয়েদের পিটিয়ে আহত করা হলো। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষকেরা চুপ করে বসে থাকলেন। কয়েক ঘণ্টা পর ক্যাম্পাসে পুলিশ এল। শিক্ষকদের পক্ষে কীভাবে সম্ভব হলো এমন নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করা?

মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান: আমি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করেছি। এখন একটি হলের প্রভোস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের যে ঘটনা ঘটে, তার ওপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সব সময় নিয়ন্ত্রণ থাকে না।

সোমবার বিকেলে যখন শহীদুল্লাহ্‌ হলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত চলছিল, সেখানে পুলিশ আনতে অনেক সময় লেগেছে। সে সময় প্রভোস্ট কমিটির জরুরি সভা চলছিল।

আমি দেখেছি উপাচার্য মহোদয় বারবার চেষ্টা করেছেন পুলিশ আনতে। কিন্তু ঘণ্টাখানেক চেষ্টার পর পুলিশ এসেছে। সাধারণত এর সঙ্গে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত থাকে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কথা পুলিশ শোনে না।

প্রশ্ন

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা চাইলে, ছাত্রদের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করলে এই পরিস্থিতি কি এড়ানো সম্ভব হতো না? শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে শিক্ষকেরা ব্যর্থ হলেন কেন?

মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান: শিক্ষক হিসেবে মনে করি, এই ব্যর্থতার দায় আমাদের সবার। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়েরও কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কোনো পুলিশ বাহিনী নেই, পরিস্থিতি মোকাবিলায় নিজস্ব কোনো ম্যাকানিজম নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও অন্যদের ওপর বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্ভর করতে হয়।

সে ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেয়, কিংবা ব্যবস্থা না নেওয়াটাই তাদের কর্মসূচির অংশ হয়, তাহলে তো তারা আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবে না।

প্রশাসনে যাঁরা থাকেন, তাঁরা সরকারি ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে একধরনের আলাপ–আলোচনার মধ্যে থাকেন। ফলে তাঁদের সুযোগ থাকে সরকারি ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে কথা বলার। সে ক্ষেত্রে তাঁরা সরকারি ছাত্রসংগঠনকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছেন কি না, সেই প্রশ্নটা থেকে যায়।

প্রশ্ন

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থামাতে বল প্রয়োগ ও দমন–পীড়নই কি একমাত্র সমাধান? নব্বইয়ের পর যতগুলো সরকার এসেছে, সবাই একই পথ বেছে নিয়েছে?

মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান: আমরা যখন বিরোধী দলে থাকি, তখন গণতন্ত্র রক্ষার ব্যাপারে যতটা সোচ্চার থাকি, ক্ষমতায় গেলে সেগুলো এড়িয়ে চলি।

বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সব সময় ছাত্ররা এগিয়ে আসেন। সে কারণে যাঁরা শাসনক্ষমতায় থাকেন, তাঁরা সব সময় মনস্তাত্ত্বিকভাবে ছাত্রদের প্রতিপক্ষ হিসেবে ভাবেন।

যাঁরা শাসনক্ষমতায় থাকেন, তাঁরা গণতন্ত্রের কথা বললেও গণতন্ত্রের লেবাসে অগণতান্ত্রিকতার চর্চা করেন বেশি, সে কারণে তাঁরা সব সময় ছাত্রদের বড় হুমকি মনে করেন।

ফলে ছাত্রদের আন্দোলন দমন করার একটা প্রবণতা থাকে। এ ক্ষেত্রে তাঁরা দুটি শক্তিকে ব্যবহার করেন। একটা হলো অনুগত ছাত্রসংগঠন, অন্যটি রাষ্ট্রীয় বাহিনী।

প্রশ্ন

সাধারণ শিক্ষার্থীরা এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, হলে উঠলে তাঁদের ওপর হামলা হবে কি না। অনেকে হল ছাড়ছেন। তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়টি এখন বড় উদ্বেগের বিষয়।

মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান: হলগুলোতে নিরাপত্তার সংকট এখন প্রবল। প্রত্যয় পেনশন স্কিমকে কেন্দ্র করে শিক্ষকদের একটা কর্মবিরতি চলছে। তারপরও প্রভোস্ট কমিটির একটা জরুরি সভায় উপাচার্য হাউস টিউটরসহ প্রভোস্টদের নির্দেশ দিয়েছেন উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনা করে তাঁরা যেন সার্বক্ষণিক হলে অবস্থান করেন। ছাত্রদের নিরাপত্তাজনিত কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হলে সেখানে শিক্ষকেরা যেন উপাচার্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেন। প্রভোস্টরা হলে অবস্থান করছেন। এরপরও কোনো কোনো হলে কিছু কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে গেছে। শিক্ষকেরা চেষ্টা করেন, কিন্তু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যদি তাঁদের অনুকূলে না থাকে, তাহলে কিন্তু শিক্ষকেরা একধরনের অসহায়ত্বের মধ্যে পড়ে যান। কেননা, রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের কাছ থেকেও আনুগত্য চান। এটা আমাদের রাজনীতির একটা দুর্ভাগ্যজনক চিত্র।

প্রশ্ন

শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে এখন করণীয় কী?

মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান: কোটাব্যবস্থা নিয়ে সমস্যাটি একেবারেই মীমাংসিত সমস্যা। এখন যে সমস্যাটি তৈরি হয়েছে সেটি সমাধানে সরকারের কাছ থেকে একটা যৌক্তিক আশ্বাস লাগবে। রাগ, ক্ষোভ, জেদাজেদি নয়, একটা যৌক্তিক ও সহনীয় সমাধান প্রত্যাশা করি।

প্রশ্ন

আপনাকে ধন্যবাদ।

মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান: আপনাদেরও ধন্যবাদ।