জোরামথাঙ্গা
জোরামথাঙ্গা

‘বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্কের বাধ্যবাধকতা আছে মিজোরামের’

মিজো নেতা জোরামথাঙ্গা হলেন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বয়োজ্যেষ্ঠ গেরিলা নেতা। বয়স ৮০ হলেও রাজনীতিতে সক্রিয় এখনো। গোপন ও প্রকাশ্য রাজনৈতিক জীবনের দারুণ এক সমন্বয় তিনি। ২০ বছর ছিলেন গোপন গেরিলাজীবনে। ১৫ বছর ছিলেন মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী। ৩০ বছর ধরে তিনি মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা এমএনএফের সভাপতি। উত্তর-পূর্ব ভারত, মিয়ানমার ও বাংলাদেশজুড়ে বিভিন্ন জাতির সংগঠকেরা তাঁকে মুরব্বি মানেন, প্রায় সবার সঙ্গে রয়েছে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ। এ অঞ্চলের বিভিন্ন বিষয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ১১ মে তাঁর এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আলতাফ পারভেজআশফাক রণি

প্রশ্ন

আপনি মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আম পাঠিয়েছিলেন। পেয়েছেন নিশ্চয়ই?

উত্তর: হ্যাঁ, একবার নয়, কয়েকবার। জীবনে যত আম খেয়েছি, তার মধ্যে ওগুলো সেরা ছিল।

প্রশ্ন

শুনেছি, একসময় আপনি ঢাকায়ও ছিলেন। আত্মজীবনী লিখছেন বলে খবর বেরিয়েছে। সেখানে কী ঢাকার সে সময়ের কথা থাকবে?

উত্তর: খবরটা সত্য। এটা ইংরেজিতে ভাষান্তরও হয়েছে। আমি প্রকাশের আগে এর ভিত্তিতে সিনেমা তৈরিতে আগ্রহী। এই বই একজন চমকপ্রদ গেরিলার জীবন—যে ২০ বছর জঙ্গলে ছিল, পরে তিনবার মুখ্যমন্ত্রীও হয়েছে।

মাও সে–তুং, চৌ এনলাই থেকে শেখ মুজিবুর রহমান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো পর্যন্ত অনেক রাজনীতিবিদের সঙ্গে দেখা হয়েছে এই গেরিলাজীবনে। কাহিনিতে এমন অনেক ঘটনা আছে, যা মুভি হওয়ার মতো। কিউবার গেরিলা নেতাদের চেয়ে কম নয় সেসব কাহিনি। মুভি তৈরির পর আমি বই আকারে এটা প্রকাশ করব।

প্রশ্ন

দক্ষিণ এশিয়ায় মিজোদের জাতীয়তাবাদী ভাবধারা গড়তে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা এমএনএফের ভূমিকা রয়েছে। কবে থেকে এসব শুরু?

উত্তর: এমএনএফ ১৯৬১ থেকে কাজ শুরু করে। ১৯৫৫ সালের দিকে আমরা একটা সাংস্কৃতিক সমিতি আকারে কাজ করতাম। ১৯৬১ সাল থেকে রাজনৈতিক দল আকারে কাজ শুরু করি। দল হিসেবে কাজ শুরুরও একটা পটভূমি আছে।

ব্রিটিশ শাসনামলে আমরা ‘ইন্ডিয়া’র অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না। এই এলাকাকে বলা হতো ‘এক্সক্লুডেট এরিয়া’। এটা শাসন করা হতো আসাম থেকে। ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত এখানে রাজনৈতিক দলের গঠনও অনুমোদিত ছিল না।

ব্রিটিশরা যাওয়ার সময় মিজোদের সামনে প্রশ্ন উঠল, আমরা কোন দিকে যাব। একদল বলল, আমরা তো পূর্ব পাকিস্তান–লাগোয়া, তাহলে আমরা এদিকেই থাকি। আরেক দল বলল, ভারতের সঙ্গে থাকা দরকার। কেউ কেউ বার্মার সঙ্গে যেতে চাইল। কেউ আবার ব্রিটিশদের একটা রাজকীয় কলোনি আকারে থেকে যেতে চাইল। কেউ কেউ স্বাধীনও হতে চাইল। এ সময় রাজনৈতিক ঐকমত্যের একটা শূন্যতা ছিল। রাজনৈতিক শূন্যতাও ছিল।

সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় শরিক না হয়েও আমরা ভারতভুক্ত হয়ে গেলাম শেষ পর্যন্ত। আমাদের ওপর ভারতীয় সংবিধান আরোপিত হলো। তখন স্থানীয়ভাবে সংস্কৃতি, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ে অধীন হয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে একপর্যায়ে এমএনএফ গঠিত হলো এবং আমরা বললাম, আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ভূমি, ধর্ম ইত্যাদির সুরক্ষা লাগবে। সুরক্ষার বিষয়টি ভারতীয় সংবিধানে থাকতে হবে।

এ নিয়ে আলোচনার মধ্যেই ভুল–বোঝাবুঝি বাড়ল। মিজোরামে ভারতীয় বাহিনী এল। এমএনএফও ১৯৬৬ সালে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করল।

প্রশ্ন

পরের ‘শান্তিচুক্তি’তে কি সেই লক্ষ্য অর্জিত হলো?

উত্তর: ১৯৮৬ সালে এসে একটি শান্তিচুক্তি হলো আমাদের। ভারতীয় সংবিধানে মিজোরামের বিষয়ে একটা সুরক্ষা হলো। ভূমি, সংস্কৃতি ইত্যাদি অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্তের এখতিয়ার ভারতীয় পার্লামেন্টের বদলে মিজোরামের জনপ্রতিনিধিরা পেলেন। যেমন মিজোরামের বাইরের কারও এখানে জমি কেনা দুরূহ; যদি আমাদের অনুমতি না থাকে। এ রকম অনেক বিষয়ে আমরা কিছু সুরক্ষা পেলাম।

এ রকম বাস্তবতাতেই এমএনএফ ভারতীয় সংবিধান মেনে নেয়। তখন এমএনএফ তার গেরিলাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসে। এর পর থেকে মিজোরাম দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার অন্যতম শান্তিপূর্ণ জায়গা।

আমাদের শান্তিচুক্তিটা বেশ কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এমএনএফ এখন এমনকি কেন্দ্রীয়ভাবে বিজেপি জোটেরও সদস্য। এই জোট গঠনে আমি একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।

প্রশ্ন

হিন্দুত্ববাদের উত্থানে কোনো অস্বস্তি নেই তো মিজোদের?

উত্তর: বিজেপি হিন্দু প্রভাবিত রাজনৈতিক দল। অন্যদিকে আমরা মিজোরা সবাই খ্রিষ্টান। তবে এর মধ্যে একটা সংবিধান তো আছে, যা আমাদের সুরক্ষা দেয়। এটা যদি বিজেপি মেনে চলে, ততক্ষণ কোনো সমস্যা নেই। মিজোরামে যতক্ষণ আমাদের সংস্কৃতি, ধর্ম ইত্যাদিতে কেউ হাত না দিচ্ছে, ততক্ষণ আমরা অসন্তুষ্ট নই।

প্রশ্ন

১৯৬৬ সালে গেরিলাযুদ্ধে নামলেন। ২০ বছর পর প্রকাশ্য রাজনীতিতে এলেন। যা যা চেয়েছিলেন, সেসব পেলেন কি?

উত্তর: এমএনএফের কর্মীরা তো স্বাধীনতার সম্ভাবনা নিয়েই ভাবে। ২০ বছর তো এ নিয়ে লড়াই হলো। কেউ কাউকে হারাতে পারিনি। মানুষ তখন শান্তি চাইছিল। শান্তি আলোচনা শুরু হয় ১৯৭১ থেকে। লালডেঙ্গা তখন আমাদের নেতা। আমি তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী। আমাদের গোপন সরকার আমাকে শিলং পাঠাল ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করতে। বাংলাদেশের তখনকার ঘটনাবলি আমাদের সংগ্রামকে একটা বিশেষ অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয়ের পর আমাদের এ এলাকা ছাড়তে হয়।

প্রথমে গেলাম আরাকানের আকিয়াবে। সেখান থেকে করাচি হয়ে ইসলামাবাদ এলাম। সেখানে চার বছর কাটল। এরপর বিশ্বের বিভিন্ন শহরে ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ–আলোচনা শুরু হলো। শেষে জেনেভায় লালডেঙ্গার সঙ্গে ভারতীয়দের বৈঠক হয়।

আমার মনে আছে, সেদিনটি ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বাংলাদেশে সেদিন শেখ মুজিবুর রহমান মারা যান। আমাদের সপ্তম বৈঠক ছিল ওটা। আমাদের সঙ্গে ভারত সরকারের সেই বৈঠকগুলো হচ্ছিল গোপনে। শেষ অধ্যায়ে নয়াদিল্লিতে দুই পক্ষের প্রকাশ্য বৈঠক হয় ১৯৭৬ সালে। এর মধ্যে আবার আমাদের গৃহবন্দী করা হলো।

আমরা দিল্লি থেকে পালিয়ে আবার আরকানের জঙ্গলে চলে গেলাম। আবার তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। তবে একপর্যায়ে আবারও আলোচনা শুরু হয় এবং ১৯৮৬ সালের জুনে শান্তিচুক্তি হয় উভয় পক্ষের মধ্যে। রাজ্যের মর্যাদা পেল মিজোরাম।

কিন্তু লালডেঙ্গা ১৯৯০ সালে মারা গেলেন। এর পর থেকে এমএনএফকে নেতৃত্ব দিতে হচ্ছে আমাকে। আমরা যে মিজোরামে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারলাম, তার জন্য কোনো গেরিলা হারাতে হয়নি। বরং তোমাদের বলি, আমাদের গেরিলারা ফেরার সময় বাংলাদেশি অনেককে বিয়ে করে সঙ্গে আনতে পেরেছিল।

প্রশ্ন

পাকিস্তান যে আপনাদের সহায়তা করছিল, সেটা বোঝা যাচ্ছে। চীনও কি আপনাদের সহায়তা করেছিল?

উত্তর: পাকিস্তানের সহায়তায় লালডেঙ্গাসহ আমি চীনে গিয়েছিলাম ১৯৭০ সালে। পাকিস্তানের দেওয়া একধরনের ট্রাভেল ডকুমেন্ট ব্যবহার করেছি। প্রথমে কুনিমং যাই, এরপর বেইজিং। আমরা চেয়েছিলাম চীন কিছু অস্ত্র টেকনাফ পর্যন্ত এনে দিক। সেটা অবশ্য হয়নি। তবে চীনের নানান জায়গায় গিয়েছি। চৌ এনলাইয়ের সঙ্গে কথা হয়েছিল। দারুণ ভদ্রলোক ছিলেন। ১৯৭৫ সালের দিকে আমরা প্রায় দেড় শ ছেলেকে প্রশিক্ষণের জন্য চীনে পাঠিয়েছিলাম।

প্রশ্ন

মিজোরামের এখনকার অবস্থাকে কীভাবে দেখছেন?

উত্তর: আমাদের এখানে পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ হলেও প্রতিবেশী মিয়ানমারের পরিস্থিতি তো অনুমান অযোগ্য হয়ে পড়েছে। পাশের বাংলাদেশে বান্দরবানেও কিছু সমস্যা যাচ্ছে। বমদের ছোট একটা সশস্ত্র দল তৈরি হয়েছে। এদিকে মণিপুরে অনেক ভুল পদক্ষেপ হলো। সবই আমাদের চারদিকে।

মিজোরাম স্থলবেষ্টিত রাজ্য। এই বাস্তবতার কারণে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক লাগবে। কিন্তু যাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক দরকার, তারা সবাই যদি অশান্তিতে থাকে, আমরা শান্তিতে থাকব কীভাবে?

মিয়ানমারে বর্তমান জান্তার আগে আমরা একটা শান্তি মিশনে গিয়েছিলাম। উত্তর-পূর্ব ভারতের অনেক গেরিলা দলের সঙ্গে দিল্লির সরকারের আলোচনার পরিবেশ তৈরিতে আমার ভূমিকা ছিল। গেরিলা নেতারা কমবেশি সবাই আমার বন্ধু। মিয়ানমারের বেলায়ও কাজ অনেক দূর এগিয়েছিলাম। কারেন-কাচিনসহ গেরিলা দলগুলোর সঙ্গে সরকারের একটা সমঝোতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

মিয়ানমারের প্রায় সব গেরিলা নেতা এখানে আমার বাসায় এসেছিলেন। ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল সাহায্য করছিলেন এই প্রক্রিয়াকে। চীনা প্রতিনিধিকেও ডেকেছিলাম এই উদ্যোগে। এমন সময় অং সান সুচির সরকার এল। সেই প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেল।

এরপর নতুন করে সামরিক শাসন এল এবং পুরো পটভূমিটা বদলে গেল। এখন অবস্থা যা, গোপন গেরিলা দলগুলো অনেক শক্তিশালী হয়ে গেছে। তারা আগের শর্তে শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাজি হবে কি না, সেটা বলা যায় না। একবার কোনো শান্তি আলোচনা ভেঙে গেলে সেটা জোড়া লাগানো কঠিন। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিবেশও এখন আগের চেয়ে জটিল।

প্রশ্ন

মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও মিজোরাম সীমান্তবর্তী এসব এলাকায় একটা গুরুত্বপূর্ণ জাতি কুকিরা। এমএনএফ কুকিদেরও একত্র করার চেষ্টা করছে কি না?

উত্তর: ‘কুকি’ শব্দটা ব্রিটিশরা ব্যবহার করত। এখন কুকি বললে প্রধানত মণিপুরের কুকিদের কথা আসে। মিজোরাও একই জাতি। আগে বলা হতো লুসাই। চিন প্রদেশে একই মানুষদের বলা হচ্ছে চিন। বাংলাদেশেও এরা আছে। সবাই এরা ভাইবোন। ব্রিটিশরা আমাদের বিভিন্ন জায়গায় ভাগ করে গেল। সব কুকি-মিজো-চিন-বমদেরই ইচ্ছা তারা একত্র হোক। কিন্তু আমরা তো এখন অনেকগুলো রাষ্ট্রের ভেতর পড়ে গেছি। চাইলেই তো একত্র হওয়া যাবে না।
যেকোনো আন্দোলন শুরু করা সহজ। কিন্তু সেই আন্দোলন থেকে শান্তিতে ফিরে আসা খুবই কঠিন।

প্রশ্ন

মিজোরাম ও আরাকান কাছাকাছি। সেখানে রোহিঙ্গারা বিশেষভাবে সমস্যায় আছে। এ বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ জানতে চাইছি।

উত্তর: এত দিন রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান নেপিডো সরকারের ওপর নির্ভর করছিল। আরাকান ছিল ইউনিয়নের একটা প্রদেশমাত্র। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন।

আরাকান আর্মি  শক্তিশালী একটি গেরিলা দল। তারা প্রদেশের বিরাট এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা এখন ইউনিয়নে থাকতে চাইবে কি না বলা মুশকিল। নতুন পরিস্থিতিতে তারা আরাকানকে স্বাধীন দেখতে চাইবে কি না, সেটাও বলা মুশকিল। সুতরাং রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান নির্ভর করছে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সরকারের যুদ্ধের ফলাফলের ওপর। মিয়ানমারের ‍গৃহযুদ্ধের একটা ফয়সালা ছাড়া আরাকানের রোহিঙ্গাদের সমস্যা আলাদাভাবে সমাধানযোগ্য নয়।

প্রশ্ন

রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে পারস্পরিক যে অবিশ্বাস কাজ করছে, সেটার সমাধান কীভাবে সম্ভব?

উত্তর: একসময় এই দুই গোষ্ঠী শান্তিপূর্ণভাবেই থাকত। আমরা যখন আরাকান জঙ্গলে থাকতাম, রোহিঙ্গারা আমাদের বন্ধু ছিল। সেই বন্ধুরা আমাদের কাছে নিজেদের পরিচয় দিত কমিউনিস্ট পার্টি অব বার্মার কর্মী হিসেবে। বহু বছর আমরা তাদের অতিথি ছিলাম। ১৯৭১ সালে তারাই আমাদের সাহায্য করেছিল আরাকান হয়ে করাচি পৌঁছাতে। পরে রাখাইন, রোহিঙ্গা ও বামাররা পরস্পরকে বহিরাগত বলে পারস্পরিক দূরত্ব তৈরি করতে শুরু করে। এরও সমাধান আছে। কিন্তু মিয়ানমারের মূল রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান ছাড়া এর বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

প্রশ্ন

এসব অঞ্চলের ঘটনায় গণচীন প্রভাব বিস্তার করে প্রচার আছে। আপনি কি সেটা মানবেন?

উত্তর: চীন, ভারতসহ সব বড় শক্তি এখন জল, স্থল ও আকাশে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। অরুণাচল নিয়ে ভারত ও চীনের মধ্যে গুরুতর মতপার্থক্য আছে। আবার মিয়ানমারের জন্য চীন হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ। তারা এখানকার শান্তি-অশান্তি উভয় ব্যাপারে চাইলে ভূমিকা রাখতে পারে।  

তবে এ–ও মনে রাখতে হবে, কারেন ও কাচিনরা খ্রিষ্টান। তারা সমাজতন্ত্রী চীনকে স্বস্তির সঙ্গে না–ও নিতে পারে। মিয়ানমারে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে ভালো ভূমিকা রাখতে পারে ভারত। মিয়ানমারের সরকার ও বিরোধী পক্ষ—উভয়ের কাছে ভারতের গ্রহণযোগ্যতা ভালো। তবে ভারত সে রকম উদ্যোগ নেবে কি না, আমি জানি না।

প্রশ্ন

বাংলাদেশের বান্দরবানে বম সমাজের ভেতর থেকে কেএনএফ নামে একটা সংগঠনের জন্ম হয়েছে। মিজোদের নেতা হিসেবে এ বিষয়ে জানেন কি কিছু?

উত্তর: বান্দরবান থেকে আমাদের এদিকে শরণার্থী আসছে। চিন ও মণিপুর থেকেও আমাদের শরণার্থী গ্রহণ করতে হয়েছে। চারদিকের এসব সমস্যায় আমরা জড়িয়ে যাচ্ছি। বমরা তো হাজার দশেক মানুষ বা তার চেয়ে কম হবে। তাদের মধ্যে কিছু তরুণ অস্ত্র হাতে নিয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক পুরোনো সমস্যা আছে। আমার বিবেচনায় এত অল্পসংখ্যক মানুষের বম সমাজের ভেতর থেকে সেখানে নতুন করে কোনো সশস্ত্র আন্দোলন হওয়া ঠিক হবে না।

এই যুদ্ধ থেকে ভালো কোনো ফল বয়ে আসবে বলে মনে হয় না। তাদের এই কাজের জন্য বম এলাকায় অনেক সমস্যা হচ্ছে। অনেকে গ্রামে থাকতে পারছে না। আমি এসব কেএনএফের ছেলেদের বলেছি। ওখানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিশ্চয়ই আরও কিছু করব। অন্তত চেষ্টা করে দেখব কেএনএফের ছেলেদের বোঝাতে পারি কি না।

প্রশ্ন

বান্দরবানের পাশাপাশি মণিপুরের জন্য আপনার সুপারিশ কী? কুকিরা তো নতুন একটা রাজ্য চাইছে।

উত্তর: মণিপুরে সমতলে থাকে হিন্দু মেইতেইরা। চারদিকের পাহাড়ে থাকে কুকিরা। যারা ৯০ ভাগ খ্রিষ্টান। এই দুই সমাজের সংস্কৃতি আলাদা। দীর্ঘ সময় তারা শান্তিপূর্ণভাবে ছিল। এখন পরিস্থিতি আলাদা।

উভয় জাতির এখন আর কোনো যোগাযোগ নেই। আমার মনে হয়, এখন সমাধান হলো কুকিদের এলাকা আলাদা করে কেন্দ্রশাসিত একটা অঞ্চল গড়া।

প্রশ্ন

আপনি বলছেন কোনো একসময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গেও আপনার কথা হয়েছিল। সেটা কোথায় এবং কীভাবে?

উত্তর: ১৯৬৯–৭০ সালে তাঁর সঙ্গে দেখা হতো ধানমন্ডিতে। আমরা তখন গোপনে লালমাটিয়া এলাকাতে থাকতাম। আমরা ওনার বাড়ির সামনে লেকের ধারে সকালে হাঁটতে যেতাম। সেখানে হাঁটার ছলে কয়েকবার আমরা বৈঠক করে ফেলেছিলাম ওনার সঙ্গে। পরস্পর বাংলাদেশ ও মিজোরামের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে মতবিনিময় করতাম।

প্রশ্ন

ওই সময়ের আর কোনো রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে দেখাসাক্ষাতের কথা আপনার মনে আছে?

উত্তর: মেননের কথা মনে আছে। খুব তরুণ ছিলেন। ভাসানীর সঙ্গে রাজনীতি করতেন। তিনি এখন কেমন আছেন? তবে আমাদের চলাচল খুব নিয়ন্ত্রিত ছিল। চাইলেই যেকোনো দিকে যেতে পারতাম না।

২৫ মার্চের পর আমরা রাঙামাটি চলে আসি। যুদ্ধের শেষলগ্নে আরাকানের দিকে সরে আসি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৫ মার্চের অভিযানের পর জিয়াউর রহমান আমাদের রাঙামাটি ক্যাম্পে এসেছিলেন। তিনি এসে বললেন, তোমরা যদি ‘ফ্রিডম ফাইটার’ হও, তাহলে আমাদের সঙ্গে মিলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে আসো। আমরা তাতে রাজি হইনি। নিরাশ হয়ে তিনি তখন চলে যান। খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা হওয়ার সময় অতীতের সেই গল্প করেছিলাম।

প্রশ্ন

বাংলাদেশের কাছে আপনার বিশেষ কোনো প্রত্যাশা আছে এখন?

উত্তর: ১৯৮৬ সালে ভারত সরকারের সঙ্গে যে শান্তিচুক্তি হয়, তাতে এমন একটা অনুচ্ছেদ ছিল, যার আওতায় ‘সীমান্ত বাণিজ্য’ উৎসাহিত করার সুযোগ আছে। মিজোরাম স্থলবেষ্টিত জায়গা। নৌবন্দর নেই। বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্কের বাধ্যবাধকতা আছে আমাদের।

আমি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে অন্তত দুবার দেখা করেছি। তাঁর পিতার সঙ্গে সম্পর্কের কথা জানিয়েছি। সে সময় এ–ও কথা হয়েছে, কীভাবে সীমান্ত বাণিজ্য বাড়ানো যায়। ভারত সরকার এ বিষয়ে খুব উৎসাহী। দুই দিকে রাস্তাঘাটের একটা সমস্যা ছিল। সেসবও অনেকখানি সমাধান হয়েছে। কর্ণফুলী নদী দিয়েও আমাদের পণ্য পরিবহন হতে পারে। এটা আমাদের একটা প্রধান চাওয়া।

এভাবে কলকাতা-চট্টগ্রাম-মিজোরামের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক হতে পারে। সরাসরি বিমান যোগাযোগ হলে ২০ মিনিটে আইজল থেকে ঢাকায় আসা-যাওয়া সম্ভব।

  • আলতাফ পারভেজআশফাক রণি: গবেষক ও লেখক