নির্বাচন কমিশন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। তফসিল অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি নির্বাচন হওয়ার কথা। সরকারি দল আওয়ামী লীগ এই তফসিলকে স্বাগত জানালেও বিএনপি ও সমমনা দলগুলো প্রত্যাখ্যান করেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে কথা বলেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. হারুন-অর-রশিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শেখ সাবিহা আলম।
তফসিল তো হয়ে গেল, সমঝোতা- সংলাপের কোনো সুযোগ আছে?
হারুন-অর-রশিদ: নির্বাচনের একটা সাইকেল থাকে, প্রাক্-নির্বাচন, নির্বাচনী তফসিল ও নির্বাচনের ফলাফল। আমরা এখন দ্বিতীয় ধাপে আছি এবং আমাদের একটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে। নির্বাচন কমিশন বিএনপিকে আমন্ত্রণ করেছে, চিঠি দিয়েছে, উন্মুক্ত আমন্ত্রণও ছিল। কিন্তু তারা তাতে সাড়া দেয়নি। আমি যেটা দেখি, তাদের জন্য খুব ক্ষীণ একটা আশা আছে। তারা এখন রাষ্ট্রপতির কাছে যেতে পারে। তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশনকে নির্বাহী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রপতির ওপর নির্ভর করতে হয়।
তার মানে এখনো সংলাপের সুযোগ আছে?
হারুন-অর-রশিদ: তফসিলটা একটু ‘টাইট’। মানে খুব বেশি সময় নেই। সন্দেহের প্রাচীর এত উঁচু, এটাকে ডিঙিয়ে সংলাপে পৌঁছানো খুবই দুরূহ। সংলাপের সম্ভাবনার সঙ্গে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে চিকিৎসাধীন রোগীর অবস্থাকে তুলনা করা যায়। তফসিল ঘোষণার আগে সংলাপ হওয়া দরকার ছিল। এখন সংলাপের কথা তোলার ভিন্ন অর্থ করতে পারে সরকারি দল ও নির্বাচন কমিশন। তারা ভাবতে পারে যথাসময়ে নির্বাচন ভন্ডুল করার জন্য সংলাপের কথা তোলা হচ্ছে।
বিএনপি রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়ে দলীয় নেতাদের মুক্তি, নির্বাচনে প্রশাসন যেন কোনোভাবে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে সেই দাবি এবং সেনাবাহিনী মোতায়েন চাইলে তা-ও বলতে পারে। এমনকি, তারা নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য কিছুটা সময়ও চাইতে পারে। আমরা সবাই, ব্যক্তিগতভাবে আমি একটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাই। অন্য দল অংশ না নিলেও বিএনপি যদি নির্বাচনে না আসে, তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সব দলের জন্যই সুযোগ থাকতে হবে। তবে বিএনপির অংশগ্রহণই হলো মূল কথা।
ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগ তো সংলাপের উদ্যোগ নিতে পারে। বিএনপির নেতা–কর্মীদের জেলে পাঠিয়ে আসলে সংলাপের পরিস্থিতি আছে কি না, সেটাও প্রশ্ন। আপনার কী মনে হয়?
হারুন-অর-রশিদ: তফসিল ঘোষণার পর আসলে সরকার রুটিন দায়িত্ব পালন করে। এখন মূল ভূমিকা পালন করবেন রাষ্ট্রপতি ও নির্বাচন কমিশন। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ হয়তো চাইলে কথা বলতে পারে। তবে যা বললাম, দুই দলের মধ্যে সন্দেহের প্রাচীর এত উঁচু যে এটা ডিঙানো খুবই দুরূহ। রাজনীতি দাবা খেলার মতো, চালে ভুল করলে প্রতিপক্ষ কিন্তু আপনার রাজা খেয়ে ফেলবে। আর তাদের শীর্ষ নেতারা জেলে।
কারণ, প্রধান বিচারপতির বাসভবন ভাঙচুর, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের ভেতরে হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরের মতো সন্ত্রাসী কাজের দায় কি তাঁরা এড়াতে পারেন? বাসের সহকারীকে অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করা হলো, তারা কি এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে? তারা তো বলতে পারত, আমরা এসব করিনি। এটা না করলে কর্মীদের কাছে এই বার্তা পৌঁছায় যে তোমরা এগুলো করতে থাকো। তারা যদি এই কর্মসূচি অব্যাহত রাখে, তাহলে তারাও কিন্তু মার্কিন ভিসা নীতির আওতায় পড়বে। তা ছাড়া বাজারে জিনিসপত্রের দাম চড়া। দিনের পর দিন হরতাল–অবরোধ হলে সাধারণ মানুষ কষ্টে পড়ে। তখন তারা আন্দোলন থেকে মুখ
সরিয়ে নেয়।
বিএনপি একটা চক্করের মধ্যে পড়ে গেছে, যেখান থেকে তারা বের হতে পারছে না। এর জন্য দায়ী হলো তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। রাজনীতি হলো দাবা খেলার মতো। আপনি চালে ভুল করলে প্রতিপক্ষ কিন্তু আপনার রাজা খেয়ে ফেলবে। বিএনপি মৌলিকভাবে এত ভুল করেছে যে তারা বিকল্প পথ খোলা রাখেনি।
কিন্তু পুলিশ যা করছে, সেটা তো জবরদস্তিমূলক। বিএনপির সিংহভাগ নেতাকে জেলে নেওয়ার যৌক্তিকতা কী। এ অবস্থায় নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ আছে, এ কথা কি বলা যাবে?
হারুন-অর-রশিদ: বিএনপি এখন জোরালোভাবে এই দাবি তো তুলতে পারে যে তাদের শীর্ষস্থধানীয় নেতাদের মুক্তি দিতে হবে। তারা আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে যেতে পারে। ১৯২৩ সালে ব্রিটিশ ভারতে বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের নির্বাচন হলো। এই নির্বাচন সামনে রেখে কংগ্রেস দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। ১৯১৯ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ খেলাফত আন্দোলন চলছিল। ১৯২২ সালে ২২ জন পুলিশ সদস্যকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা ঘটায় মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন স্থগিত করলেন।
তখন দলের সামনে প্রশ্ন হলো তারা কি নির্বাচনে যাবে, নাকি যাবে না? নির্বাচনের আগে মহাত্মা গান্ধীর অনুসারীরা নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। তারা বলল নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মানে হলো ব্রিটিশদের সমর্থন জানানো। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ও মতিলাল নেহরু কিন্তু স্বরাজ পার্টি করে নির্বাচনে অংশ নিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, তঁারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন সরকারকে সহযোগিতার জন্য নয়, বরং ভেতর থেকে সরকারকে অকেজো করে দিতে। বিএনপি দাবি অব্যাহত রেখে নির্বাচনে যেতে পারে।
তারপর জনগণ চাইলে তারা সরকার গঠন করবে আর না হলে বিরোধী দলে যাবে। আর যদি নির্বাচন সুষ্ঠু না হয়, কারচুপি হয়, ফল ঘুরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তো হলোই; তারা তখন বলতে পারবে যে দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় না।
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে অনেক দিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, ভারত কথা বলছে। এর মধ্যে ডোনাল্ড লু চিঠি দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও বলছে, বাংলাদেশে বিরোধী দলের ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন চলছে। এতে আর কিছু না হোক, দেশের ভাবমূর্তি তো নষ্ট হয়?
হারুন-অর-রশিদ: অভিযানে গেলে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের ঘটনা তো ঘটেই। তবে একটা জিনিস সত্য, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কারণে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারের সামনে বড় পরীক্ষা হলো অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন করা। জনগণ ব্যালটের মাধ্যমে যে জবাব দেবে, তার প্রতিফলন যেন থাকে। লাখ লাখ ভোটের ব্যবধানে একজন জিতে গেছে, এমন হলে ভোট নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
সরকার যদি এই পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়, ২০১৮ সালের নির্বাচন তো আমরা দেখলাম। সরকার কি আসলে চায় যে বিএনপি নির্বাচনে আসুক?
হারুন-অর-রশিদ: এবারের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হতেই হবে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো আরেকটি নির্বাচনের বোঝা দেশের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। তবে সরকারি দলের পক্ষ থেকে বিএনপির সঙ্গে বহুবার কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপি সবচেয়ে বড় ভুলটা করেছে।
এবার নির্বাচনে না যাওয়া হবে আরেকটা ভুল। সময় হাতে খুব কম। আওয়ামী লীগ তো নির্বাচনে জোয়ার তৈরি করে ফেলবেই, নতুন নতুন দলও নির্বাচনে আসবে। আর আওয়ামী লীগ বিএনপিকে নির্বাচনে চায় কি না, এমন প্রশ্নের উত্তর আমি কিন্তু আগেই দিয়েছি। রাজনীতি হলো দাবা খেলার মতো। একটা চাল ভুল হলেই প্রতিপক্ষ রাজা খেয়ে ফেলে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
হারুন-অর-রশিদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।