আবু আলম শহীদ খান। ছাত্রজীবনে বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত এই সাবেক সচিব প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন, পিএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁস, বেনজীর-মতিউর কাণ্ড এবং প্রশাসনের ভেতর–বাহির নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও রাফসান গালিব
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হলো, তা কি এড়ানো যেত না?
আবু আলম শহীদ খান: সরকার চাইলেই এড়াতে পারত। শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামলেন, যখন সরকারের ২০১৮ সালে জারি করা পরিপত্রটি বাতিল হলো। অনেকেই বলেছেন, এটা ছিল সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত। আদালতও সেটা স্বীকার করলেন। তবে অনেক দেরিতে। ইতিমধ্যে দুই শতাধিক মানুষকে জীবন দিতে হলো। রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস হলো। জনজীবন ও অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ল। এ বিষয়ে আদালতেরও দায়িত্ব ছিল। এখানে সরকারের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে যেকোনো আন্দোলনে গণমানুষের অংশগ্রহণ অস্বাভাবিক নয়। দ্রব্যমূল্য, বেকারত্ব, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি বৈষম্য মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছে। সরকার এসব বিষয়ে নজর দেয়নি। কোটা সংস্কার নিয়ে তো এত বড় আন্দোলন হওয়ার কথা নয়। ভারতের সুপ্রিম কোর্টেও কোটার মামলা উঠেছিল। মোদি সরকার অনগ্রসর শ্রেণির জন্য ১০ শতাংশ কোটা বহাল রেখেছে। সেখানে কিন্তু কেউ বলেননি রাস্তায় আন্দোলন হয়েছে বলে আপনারা আদালতে এসেছেন।
বরং আদালত সরকারের কাছে জানতে চেয়েছেন কোটা কত দিন চলবে, কারা সুবিধা পাবেন? সরকার থেকে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে যঁাদের পাঁচ একর পর্যন্ত জমি, এক হাজার বর্গফুটের বাড়ি এবং বার্ষিক আয় লাখ রুপির মধ্যে, তাঁরা কোটা সুবিধা পাবেন। এর বেশি সম্পদধারীরা পাবেন না। একই পরিবারে একজন সরকারি কর্মকর্তা থাকলে আরেকজন কোটা সুবিধা পাবেন না।
আমাদের এখানে মুক্তিযোদ্ধা ভাতার ক্ষেত্রেও তো সে রকম কোনো বিধান থাকা উচিত ছিল বলে মনে করেন?
আবু আলম শহীদ খান: সে রকমই ছিল। কিন্তু হোয়াইট কলার মুক্তিযোদ্ধারা এটি বদলে দিলেন। প্রথমে হতদরিদ্র মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা দেওয়া হতো। পরে নাম বদল করে সম্মানী ভাতা করা হলো।
আপনি যখন প্রশাসনে ছিলেন, তখনো কোটা বিতর্ক ছিল। কোনটি ন্যায়সংগত বলে মনে করেন?
আবু আলম শহীদ খান: সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশ যেমন নারী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বা প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা থাকা প্রয়োজন। এটা আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে যে সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা আছে, তারই বাস্তবায়ন বলে মনে করি। অনেক দেশেই কোটাব্যবস্থা আছে। তবে এর যৌক্তিকীকরণ প্রয়োজন। আমাদের দেশে ৪০ লাখের বেশি শিক্ষিত বেকার আছেন। তাঁরা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন। কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর ২০ হাজার স্নাতক বের হন।
এর বাইরে সরকারি-বেসরকারি আরও বিশ্ববিদ্যালয় আছে। কলেজগুলোতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেওয়া হয়। এভাবে হাজার হাজার শিক্ষিত বেকার তৈরি করার প্রয়োজন আছে কি না, সেই প্রশ্নও আছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক অসংগতি আছে। প্রকৌশলী ও চিকিৎসকেরা সাধারণ ক্যাডারে চাকরি নিচ্ছেন। এটা দেশের বড় ক্ষতি বলে মনে করি।
কিন্তু কোটা সমস্যার সমাধান তো শান্তিপূর্ণভাবেও করা যেত।
আবু আলম শহীদ খান: যেকোনো সমস্যা হলে অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করেই সমাধান করা উচিত। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রকাঠামোটাই এমন যে বাধ্য না হলে কেউ কিছু করেন না। এটা হলো ঔপনিবেশিক মানসিকতা। ফলে যেকোনো দাবি আদায় করতে মানুষকে রাস্তায় নামতে হয়। ২০১৮ সালেও শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছিলেন। এবারও তাঁদের আন্দোলনের দিকেই ঠেলে দেওয়া হলো।
শিক্ষার্থীরা যখন কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন করলেন, তখনই খবর এল পিএসসির পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
আবু আলম শহীদ খান: পিএসসির জন্য এটি তো বিব্রতকর। পিএসসিতে একসময় প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিশেষ করে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত। এরপর এক-এগারোর সরকারের আমলে সাদত হোসাইন চেয়ারম্যান হয়ে এটি বন্ধ করেছিলেন। এরপর যাঁরা এসেছেন, তাঁরাও নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন। এখানে আরেকটি সমস্যা হলো পিএসসি বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে নিয়ে এত ব্যস্ত থাকে যে নন-ক্যাডারে মনোযোগ কম থাকে।
যদি তাঁরা সময় দিতে না পারেন, নন–ক্যাডারদের জন্য আরেকটি কমিশন হতে পারে। কিন্তু কোনো পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসকে বরদাশত করা যায় না। একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেলে প্রশ্নপত্র ফাঁস হতো; সেগুলো এখন বন্ধ হয়েছে। এখানে কেবল দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে হবে না। এর সুবিধাভোগীদেরও ধরতে হবে। অর্থের লেনদেন হয়েছে। অসাধু পথে যাঁরা চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের নিয়োগ বাতিল করতে হবে। পরে কেউ এই অপকর্ম করতে সাহস পাবেন না। কাজটি কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়।
জনপ্রশাসনে বেনজীর ও মতিউর-কাণ্ড ঘটল কীভাবে? এর দায় কার বলে মনে করেন?
আবু আলম শহীদ খান: আমাদের সরকার যাঁরাই চালান না কেন, তাঁদের দায়িত্ব হলো কর্মকর্তাদের মনিটর করা। মনিটরিংটা দুই ধরনের। তাঁদের ওপর যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেটা তাঁরা পালন করছেন কি না। দ্বিতীয়ত দায়িত্বের বাইরে গিয়ে কিছু করছেন কি না। যেসব দুর্নীতির খবর বের হচ্ছে, সেটা তো এক দিনে ঘটেনি। এই দায় সরকার কোনোভাবে এড়াতে পারে না। আর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তো দায়িত্ব নিতেই হবে। আপনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা বলবেন, আবার ভয়ভীতি দেখিয়ে সংখ্যালঘুদের শত শত একর জমি দখল করবেন, এটা হতে পারে না।
দুর্নীতির এই সর্বগ্রাসী রূপ নেওয়ার পেছনে প্রশাসনিক কোনো দুর্বলতা কাজ করেছে কি না?
আবু আলম শহীদ খান: আমাদের একটা আইন আছে, হুইসেল ব্লোয়ার। ঊর্ধ্বতন বা সহকর্মী কেউ দুর্নীতি করলে সেটা কর্তৃপক্ষকে জানানোর কথা। বেনজীরের ক্ষেত্রে তাঁর ওসি–এসপিরা সেই দায়িত্ব পালন করেননি। একজন খ্যাতনামা সম্পাদক বলেছেন, আমলাদের দুর্নীতির কথা আমরা জানলেও প্রকাশ করতে পারিনি। এর অর্থ দেশে ভয়ের সংস্কৃতি আছে। নির্যাতন ও হয়রানির ভয়। অন্যদিকে সরকারের এতগুলো এজেন্সি কেন এই মহাদুর্নীতি দেখেনি।
গোয়েন্দাপ্রধানদের দায়িত্ব সরকারপ্রধানকে প্রতিদিনের ঘটনা জানানো। আবার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলেরও দায়িত্ব আছে। যেখানে দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে, সেখানকার নেতা-কর্মীরাও তো জানবেন। সমস্যা হলো ক্ষমতার শীর্ষে যাঁরা থাকেন, তাঁদের সঙ্গে দলীয় নেতা-কর্মী কিংবা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি দেয়াল তৈরি হয়। ফলে তঁাদের কাছে দুর্নীতির তথ্য জানানোর কোনো উপায় থাকে না।
অভিযোগ আছে সরকার যখন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দিয়ে অন্যায় কাজ করায়, তখন তাঁরাও সরকারের কাছ থেকে অন্যায় সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেন।
আবু আলম শহীদ খান: এটা হলো দুইয়ে দুইয়ে চারের মতো। রাষ্ট্র চলে আইনের ভিত্তিতে। আপনি যখন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে আইনবহির্ভূত কাজে ব্যবহার করবেন, সেই ব্যক্তিও ফায়দা নিতে চাইবেন। নেবেন। সব সরকারের আমলেই এমনটি হয়েছে।
প্রজাতন্ত্রের কর্মীদের দায়িত্ব হলো সরকারের নির্দেশনামতো কাজ করা। কিন্তু আপনারা একসময় সেই নির্দেশনা অমান্য করে জনতার মঞ্চ করেছিলেন। অনেকের অভিযোগ, সেই সময় থেকে প্রশাসনের সর্বনাশ হয়েছে।
আবু আলম শহীদ খান: নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও ছিয়ানব্বইয়ে জনতার মঞ্চ করার একটা পটভূমি ছিল। নব্বইয়ে গোটা জাতি এরশাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার পর সরকারি কর্মকর্তারাও তাঁর বিরুদ্ধে চলে যান। আর ছিয়ানব্বইয়ে জনতার মঞ্চ হয় ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর। সচিবালয়ে সে সময় কিছু ঘটনাও পরিস্থিতিকে নাজুক করে তোলে।
এ পর্যায়ে সব সচিব গিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেন। এরপর জনতার মঞ্চ হয় কয়েক দিনের জন্য। আমি বলব, প্রজাতন্ত্রের কর্মীরা বিবেক দ্বারা চালিত থাকলেও সব সময় তাঁরা সেটা প্রকাশ করতে পারেন না। অনেক সময় অন্যায় মেনে নিতে হয়। সেই বিবেক জাগ্রত হয়, যখন বাইরে প্রচণ্ড আন্দোলন হয়।
এই সরকারের অধীনেও তো তিনটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু জনতার মঞ্চের মতো প্রজাতন্ত্রের কর্মীদের কোনো ভূমিকা দেখলাম না।
আবু আলম শহীদ খান: শেষ দুটি নির্বাচনের সময় আমি প্রশাসনে ছিলাম না। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালে যখন পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়, তখন আমি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলাম। সেসব নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছিল এবং বিরোধী দলের সমর্থক প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন।
আমাদের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। সেলিনা হায়াৎ আইভী সেনাবাহিনী চেয়েছিলেন। কিন্তু সরকার সেনাবাহিনী দেয়নি। ভয় ছিল সেনাবাহিনী দিলে শামীম ওসমানের লোকজন অঘটন ঘটাতে পারে। আমরা সেলিনা হায়াৎ আইভীকে পূর্ণ নিশ্চয়তা দিয়েছিলাম নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। তিনি বিষয়টি মেনে নিলেন। নির্বাচন সুষ্ঠু হলো। পরের চার সিটি নির্বাচনও সুষ্ঠু হয়েছে। বিরোধী দলের সমর্থকদের জয়ের পেছনে হেফাজতে ইসলামেরও একটা বড় ভূমিকা ছিল।
আর এখন যে তিন নির্বাচন ভোটারবিহীন হওয়ার অভিযোগ, এর বিরুদ্ধে যদি চূড়ান্ত কোনো আন্দোলন হতো, তাহলে দেখা যেত গণকর্মচারীরা রাস্তায় নেমে আসতেন। ইতিহাস বলে গোটা দেশ, গোটা জাতি যখন আন্দোলনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে আমলারা সেখানে যুক্ত হয়েছিলেন। কারণ, তাঁরা তো আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি নন। আমি মনে করি না, সরকারি কর্মচারীরা পুরোপুরি দলদাস হয়ে গেছেন। পরিবেশ পরিস্থিতি অনুকূল থাকলে ছিয়ানব্বইয়ের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটা অস্বাভাবিক নয়।
আপনি ১৯৮৩ সালে সরকারি চাকরিতে ঢুকেছেন। বিদায় নিয়েছেন ২০১৫ সালে। এই সময়ে সামরিক-অসামরিক, গণতান্ত্রিক অনেক সরকারের অধীনে কাজ করেছেন। আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে?
আবু আলম শহীদ খান: এরশাদের আমলে সবচেয়ে কম হস্তক্ষেপ হয়েছে। আপনি যদি তাঁর ব্যক্তিগত দুর্নীতি ও প্রহসনমূলক নির্বাচনের বিষয় বাদ দেন, সেই সময়ে প্রশাসন ভালো চলেছে। প্রশাসনিক সংস্কার হয়েছে। তবে বিএনপির প্রথম ও আওয়ামী লীগের প্রথম আমলে মোটামুটি স্বাধীনভাবে কাজ করা যেত। সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সে বিষয়ে মতামত দেওয়া যেত। বলা যেত এটা ভুল বা সঠিক। কিন্তু ২০০১-এর পর পরিস্থিতি বদলে যায়।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার দায়িত্ব নিয়েই মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের পাইকারি হারে বাদ দিতে থাকে। তখন থেকেই ‘ডিএনএ টেস্ট’ শুরু হয়। কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত নথিতে লেখা থাকত এ বি বা জে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াত। মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা যাঁরা ছিলেন, তাঁদের ডিঙিয়ে অনেককে সচিব করা হয়। এরপর এক-এগারোর সরকার এল। কিছু কিছু সেনা হস্তক্ষেপ হয়েছে। এনবিআরের মতিউর রহমানের পক্ষে তদবির হয়েছে। চোর ধরার জন্যই হয়তো তারা এই কৌশল নিয়েছিল।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার এসে কি পাল্টা ব্যবস্থা নিতে শুরু করল?
আবু আলম শহীদ খান: বলতে পারেন, ২০০৯ সালে তার পাল্টা হয়েছে। কিন্তু ১৯৯৬ সালে সেটা হয়নি। পদোন্নতিতে গণহারে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন হয়নি। জনতার মঞ্চ করার জন্য কেউ বাড়তি সুবিধাও পাননি। মাত্র দুজন কর্মকর্তার পদোন্নতি আটকে গিয়েছিল। এর জন্য তঁাদের আরও তথ্য প্রয়োজন, এমনটা লেখা হয়েছিল ফাইলে। তখন প্রধানমন্ত্রীকে আমি বুঝিয়েছিলাম, এসএসবি (সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড) তঁাদের উপযুক্ত মনে করেছে, সে জন্য সুপারিশ করেছে।
আরও তথ্য প্রয়োজন—এটি লেখার মাধ্যমে এমন একটি দ্বার উন্মোচন হবে, যা পুরো প্রশাসনকে তছনছ করে দেবে। পরবর্তী সময়ে এসএসবি আরও তথ্য নেওয়ার চার মাস পর তাঁদের পদোন্নতি হয়ে যায়। এটি ছিল একমাত্র ঘটনা, তার আগে যেমন মাগুরা নির্বাচনের একটা মাত্র ঘটনার কারণে পরে অনেক কিছু ঘটে গেল। এরপর তো ২০০১ সালে এসে ডিএনএ ফাইল তৈরি করা হলো। পরবর্তী সময়ে স্বাভাবিকভাবেই সেই ডিএনএ ফাইল চলে এল আওয়ামী লীগের কাছেও।
এখন তো এমনও অভিযোগ আছে, পিএসসির সুপারিশপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রে ভেরিফিকেশনে পরিবারের কেউ বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা এমনকি কোনো আত্মীয়স্বজন থাকলেও তাঁদের আর চাকরি হয় না।
আবু আলম শহীদ খান: এমনটি হচ্ছে। এটি খুব বিব্রতকর এবং সংবিধানবিরোধী। সংবিধানের ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদে যে বিষয়গুলো বিবৃত আছে, সেগুলো অনুসরণ করা হচ্ছে না।
কিন্তু পুলিশসহ আরও সরকারি সংস্থা দিয়ে এত ভেরিফিকেশন কেন হবে?
আবু আলম শহীদ খান: এটা তো কলোনিয়াল ব্যবস্থাকে আমরা বজায় রেখেছি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকারীরা যাতে গণকর্মচারী হয়ে না যায়, এ জন্য সেটি চালু করা হয়েছিল। পাকিস্তান আমলেও কমিউনিস্ট পার্টি করেছে, এমন কেউ চাকরি পাননি। রক্ত দিয়ে আমরা স্বাধীন হলেও সেই কলোনিয়াল মানসিকতা থেকে তো আমরা স্বাধীন হইনি। এখন এটি করার ফলে দলীয়করণ তৈরি হয়। এটি প্রশাসনের মেধাভিত্তিক ও গুণগত মানের হানি হয়। একজন যুদ্ধাপরাধীর পরবর্তী প্রজন্মও তো রাষ্ট্রের নাগরিক, তার তো অধিকার আছে চাকরি পাওয়ার। পূর্ববর্তী প্রজন্মের কর্মকাণ্ডের দায় তো তার হতে পারে না।
প্রশাসনের অদক্ষতা ও অসততার জন্য মূলত কাকে দায়ী করবেন?
আবু আলম শহীদ খান: প্রথমত ব্যক্তিকে দায় নিতে হবে। প্রশাসনে নিয়োগপ্রক্রিয়া, পদোন্নতিতে রাজনীতিকরণ বা দলীয়করণ হলে এটি ঘটতেই থাকবে। ফলে চূড়ান্তভাবে দায়টা রাজনীতিবিদদেরই নিতে হবে। কারণ, রাষ্ট্র পরিচালনার ভার তাঁদের হাতেই। এখন তাঁরা যদি বলেন, আমলারা তাঁদের চেয়ে শক্তিশালী। তখন তাঁদের বলতে হয়, আমলাদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে আপনারা বাড়ি চলে যান। আসলে শক্তিশালী আমলা নেই, যিনি সরকারের অন্যায্য নির্দেশ কখনো পালন করবেন না এবং বহাল তবিয়তে থাকবেন।
এখানে ব্যক্তির চেয়ে বরং আমলাতন্ত্র সিস্টেমটাই শক্তিশালী, বিষয়টি তো এভাবে দেখা হয়।
আবু আলম শহীদ খান: মন্ত্রীদের অনেকের নিজেদের অসততা, অযোগ্যতা, অদক্ষতার কারণে তাঁরা আমলাদের দোষ দিয়ে থাকেন। কেন তাঁরা মন্ত্রণালয় চালাতে পারবেন না? বিহারের মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদবের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ ছিল, তিনি তো প্রশাসন চালিয়েছেন। ভারতে তো নির্বাচনের পর ইভিএম জেলা প্রশাসনের কাছে জমা থাকে। কেউ তো প্রতিবাদ করে না। কারণ, তাঁরা জানেন যে জেলা প্রশাসক ভোটের সময় কাউকে সমর্থন করবে না। বিশ্বাস ও আস্থার জায়গা থেকে আমাদের প্রশাসন, রাজনীতিবিদ, গণকর্মচারী, বিচার বিভাগ সবাই নিচে নেমে গিয়েছি। এটি আমাদের জাতির জন্য বড় একটা দুর্ভাগ্য। এখান থেকে আমাদের বের হতে হবে।
দেশে একটা অস্বাভাবিক অবস্থা চলছিল। দ্রুত স্বাভাবিক হওয়ার লক্ষণ দেখেন কি?
আবু আলম শহীদ খান: এখানে রাজনৈতিক সদিচ্ছাই প্রধান। প্রতিটি হত্যা ও সহিংসতার নির্মোহ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত হতে হবে। কেননা এই আন্দোলনের পেছনে আছে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ও আস্থাহীনতা। সরকার ও রাজনীতিবিদেরা নতুন প্রজন্মের ভাবনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। সবকিছু নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। তরুণদের প্রতিপক্ষ ভাবা হবে চরম ভুল। আত্মসমালোচনা করতে হবে। শুধু ষড়যন্ত্রতত্ত্ব ও তৃতীয় পক্ষের ওপর দায় চাপালে সমস্যার সমাধান হবে না। স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
আবু আলম শহীদ খান: আপনাদেরও ধন্যবাদ।