করোনা ও যুদ্ধ না হলেও আমরা সমস্যায় পড়তাম

ড. সেলিম রায়হান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক। বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনোজ দে

সেলিম রায়হান
প্রশ্ন

করোনা মহামারির তিন বছর ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর পেরোল। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এ দুইয়ের প্রভাব কতটা পড়েছে?

সেলিম রায়হান: করোনা মহামারি আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে বড় একটা ধাক্কা দিয়ে গেছে। এখনো তা পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা যায়নি। মহামারির প্রভাব কাটিয়ে অর্থনীতি যখন পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় ছিল, সে সময়েই (২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি) নতুন ধাক্কা এল—রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধের কারণে বিশ্বে খাদ্যপণ্য, জ্বালানি ও কাঁচামালের দাম যেভাবে বেড়ে গেছে, তার একটা প্রভাব প্রকটভাবে আমাদের অর্থনীতির ওপর পড়েছে।

প্রশ্ন

বাংলাদেশের অর্থনীতি একটা সংকটকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ সংকটের পেছনে মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের, নাকি আমাদের অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনার দায় দেখছেন?

সেলিম রায়হান: আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, আমরা যদি শুধু করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে কথা বলি, তাহলে আমাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির যেসব সমস্যা, সেগুলো যথার্থভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারব না। সমাধানের ব্যাপারেও আন্তরিক হব না। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন ভারসাম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি।

ব্যাংকিং, রাজস্ব খাতসহ আমাদের অর্থনৈতিক খাতে সমস্যা দীর্ঘদিনের। কেউ হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, এর মধ্যেই তো আমরা এগিয়ে গেছি, সমস্যা তো হয়নি। কিন্তু ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতি, অর্থ পাচার, রাজস্ব সংগ্রহে নিম্নগতি, রপ্তানিতে একক পণ্যের ওপর নির্ভরতা—এসব বিবেচনায় কি বলতে পারি, আমরা যে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের কথা বলি, সে জায়গায় পৌঁছাতে পারতাম? কোভিড মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ না হলেও আমাদের অর্থনীতির দুর্বল জায়গাগুলোর কারণে আমরা সমস্যায় পড়তাম।

 করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে আমাদের অর্থনীতির বাড়তি বোঝা হিসেবে দেখব, সমস্যার কারণ হিসেবে দেখব না। তা না হলে আমরা সব দায় যুদ্ধের ওপর চাপিয়ে দেব। নিজেদের দায়টা স্বীকার করব না। শুধু অর্থনীতির কাঠামোগত সংস্কার নয়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার দরকার। সামগ্রিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন দরকার। দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান নিতে হবে।

প্রশ্ন

করোনা মহামারির অভিঘাত পেরিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল, সে সময়েই অপ্রত্যাশিত আঘাত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। জ্বালানি ও কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, সরবরাহ-শৃঙ্খল ভেঙে পড়া ও মূল্যস্ফীতির মতো সংকটগুলো এ সময়ে ভুগিয়েছে গোটা বিশ্বকে। বিশ্ব অর্থনীতির এ মুহূর্তের প্রধান প্রধান চ্যালেঞ্জ কী বলে মনে করছেন?

সেলিম রায়হান: বিশ্ব অর্থনীতিতে একটা বড় অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে—এখনকার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এটি। যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ-শৃঙ্খল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষেত্রে আপাত যে থিতু অবস্থার কথা আমরা চিন্তা করি, সেটা দেখা যাচ্ছে না। ইউরোপ বিশ্ব অর্থনীতির বড় একটা কেন্দ্র, সেখানে যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধে যেসব দেশ সরাসরি জড়িত নয়, সেগুলোয় নানা প্রভাব পড়ছে।

আমরা অর্থনীতির সূচকগুলো দেখতে পাই। কিন্তু দারিদ্র্য, অসাম্য, কর্মসংস্থানে ভাটা, শ্রমবাজারের অস্থিরতা—এসব সংকট অনেকটাই অদৃশ্য থেকে যায়। কোভিডের সময় বিশাল যে সামাজিক ক্ষয় হয়েছিল, তা পুনরুদ্ধারে দেশে দেশে সামাজিক খাতে ব্যয় বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধ এসে পড়ায় জ্বালানি ও সামরিক খাতে ব্যয় বাড়াতে হচ্ছে। ফলে যুদ্ধের কারণে অগ্রাধিকারে পরিবর্তন হয়ে গেল কি না, সেটাও আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ।

প্রশ্ন

এ বছরে বিশ্ববাজারে মন্দার পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে একধরনের মন্দা চলছে বলে মনে করা হচ্ছে। এ বছর চীনের অর্থনীতিও সংকুচিত হতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে এ বছর বিশ্ব অর্থনীতি কোন পথে চলেছে?

সেলিম রায়হান: আমরা একটা মন্দার ভেতরেই আছি; গত বছরের শেষের থেকে মন্দা চালু হয়ে গেছে। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোয় মূল্যস্ফীতির বড় চাপ তৈরি হয়েছিল। সেটা প্রশমনের জন্য সুদহার বাড়িয়ে মানুষের চাহিদা কমানোসহ নানা পদক্ষেপ নিতে হয়েছে—তার একটা প্রভাব দেখা যাচ্ছে। এ প্রভাব ক্রমান্বয়ে সারা বিশ্বেই পড়ছে। বৈশ্বিক অর্থনীতির বড় কেন্দ্রগুলো পণ্য ও সেবা খাতে যে চাহিদা তারা সৃষ্টি করে, সেসব চাহিদা আমাদের মতো দেশগুলো নানাভাবে রপ্তানি করে মেটায়। ২০২৩ সালে বিশ্বমন্দা কতটা গভীর হবে, সেটা ঘুরেফিরেই নির্ভর করছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের গতিপ্রকৃতির ওপরই।

মন্দা পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন ছিল প্রকৃত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের দিকে ফিরে যাওয়া—যেসব খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলো যাতে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারে, মানুষ যাতে কাজ পায়, সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে যাতে গতিশীলতা আসে, সেসব উদ্যোগ নেওয়া। কিন্তু অগ্রাধিকারগুলো পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় একটা ভয় থেকেই যাচ্ছে—বৈশ্বিক মন্দা প্রকট আকার ধারণ না করলেও ২০২৩ সালের শেষে গিয়েও দেখা যাবে এখনকার সংকটগুলো তখনো রয়ে গেছে।

চীন বিশ্ব অর্থনীতির আরেকটি বড় কেন্দ্র এবং তারা বিশ্বের কারখানা হিসেবে পরিচিত। চীনের অর্থনীতিতে কয়েক বছর ধরে বড় ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন হচ্ছে। দেশটি অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও সেবা খাতের ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। মহামারি ও ভূরাজনীতির কারণে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সম্পর্কেরও অবনতি হয়েছে। তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা চলছে। আমরা চাই না তাইওয়ান ভূরাজনীতির একটা মল্লযুদ্ধক্ষেত্র হোক। কিন্তু সে ধরনের কিছু হলে বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর আরও বড় আঘাত আসবে। সরাসরি সংঘাত না হলেও প্রক্সি যুদ্ধের আলামত আমরা দেখছি। সেটার একটা প্রভাব আছে।

প্রশ্ন

বাংলাদেশের রপ্তানির প্রধান প্রধান বাজারে মন্দা চলছে। দেশের অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে? আমাদের কী ধরনের সতর্কতা নেওয়া উচিত?

সেলিম রায়হান: বাংলাদেশকে অবশ্যই এসব প্রেক্ষাপট চিন্তা করা উচিত। বৈশ্বিক অর্থনীতি ও ভূরাজনীতিতে যেসব ঘটনা ঘটছে, তাতে আমাদের তেমন কোনো হাত নেই। কিন্তু বাংলাদেশের মতো যে দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, আন্তর্জাতিক পরিসরে তাদের একটি সমন্বিত কণ্ঠস্বর থাকা উচিত। জাতিসংঘ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় বাংলাদেশকে এ বিষয়ে আরও জোরালোভাবে কথা বলা দরকার।

আমাদের অর্থনীতি কোনো কোনো জায়গায় যথেষ্ট শক্তিশালী। আমরা গত কয়েক দশকে এসব জায়গায় বেশ ভালো করেছি। কিন্তু কোনো কোনো জায়গায় আমরা যথেষ্ট দুর্বলও। বিশেষ করে রপ্তানির ক্ষেত্রে একক পণ্যনির্ভরতা, বিদেশি বিনিয়োগ আমাদের খুবই কম, অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো সংস্কার করতে পারিনি, রাজস্ব আদায়ে আমাদের ভয়াবহ দুর্বলতা রয়েছে, স্বাস্থ্য-শিক্ষা খাতে সরকারি খরচ খুবই কম। এসব দিকে বিশেষ নজর দেওয়ার পাশাপাশি ও সংস্কার করা দরকার। আধাখেঁচড়া বা দায়সারাভাবে নয়, আন্তরিকভাবে সংস্কারটা করতে হবে। সংস্কার বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভবিষ্যতের জন্য প্রতিরোধক্ষমতা বাড়িয়ে দেবে। সেটা করা গেলে সামনের দিনে অর্থনীতিতে যে আঘাত আসবে, আমরা তা ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারব। আমাদের নীতিনির্ধারকদের উপলব্ধিতে আসতে হবে যে এখনই সংস্কারের প্রকৃত সময়, এ সুযোগ হেলায় হারানো ঠিক হবে না।

প্রশ্ন

গত বছরের মার্চ-এপ্রিল থেকেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ সইতে হচ্ছে। ওএমএসের লাইনে দীর্ঘ হচ্ছে মানুষের সারি। মূল্যস্ফীতি কমার কোনো লক্ষণ দেখছেন কি?

সেলিম রায়হান: মূল্যম্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষ কী রকমভাবে পিষ্ট হচ্ছে, সেটা আমরা সংবাদমাধ্যমের খবরে দেখছি। ওএমএসের লাইনে যেভাবে ভিড় বাড়ছে, আমাদের তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে উপায় নেই। এ সময়ে মানুষ অনেক কষ্ট করে জীবন অতিবাহিত করছেন। মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় অনেকখানি কমে গেছে। আগে ১০০ টাকায় যে বাজার তাঁরা করতে পারতেন, এখন সেই টাকা দিয়ে ৬০ টাকার বাজার করতে পারেন। ফলে অনেকটা খালি হাতে বাজার থেকে ফিরতে হচ্ছে। পাঙাশ, তেলাপিয়া, ব্রয়লার মুরগি, ডিম—সস্তা প্রোটিন হিসেবে বিবেচনা করা হয়, সেগুলোও এখন কী পরিমাণ দামি হয়ে গেছে!

বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং মুদ্রার বিনিময় হারের সমন্বয় হওয়ায় আমদানিনির্ভর অনেক পণ্যের দাম বেড়েছে। কিন্তু অনেক পণ্য আমরা দেশেই উৎপাদন করি। সেগুলোরও অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি দেখছি। এতে যে প্রশ্ন সামনে আসে, তা হলো আমাদের বাজারব্যবস্থাটা ঠিকমতো কাজ করছে কি না। আমাদের বাজারব্যবস্থাটা ত্রুটিপূর্ণ, এখানে সাময়িক ঘাটতি তৈরি করে, কেউ কেউ অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়িয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে দায় সরকারের আছে, দায় ব্যবসায়ীদের আছে। বাজারে জবাবদিহির জায়গা নেই। তদারকির জায়গা খুব দুর্বল।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির যে অবস্থা চলছে, সেটা শিগগিরই কাটিয়ে ওঠা যাবে বলে মনে হয় না। এটা আরও কয়েক মাস চলবে। জ্বালানি, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, পবিত্র রোজা বা এ রকম নতুন নতুন ঘটনা সেটি উসকে দেবে। রোজাকে প্রতিবছর অনেক ব্যবসায়ী সুযোগ হিসেবে নেয়।

প্রশ্ন

মূল্যস্ফীতির চাপটা সহনীয় করা যাবে কীভাবে?

সেলিম রায়হান: আন্তর্জাতিক বাজারে বিকল্প উৎসগুলো খোঁজা প্রয়োজন, যাতে তুলনামূলক কম দামে আমদানি করা যায়। অভ্যন্তরীণ বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার জায়গাগুলো নিশ্চিত করতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকার, প্রতিযোগিতা কমিশনের মতো সংস্থা আছে বাজার তদারকির জন্য। কিন্তু তাদের নিয়মিত কর্মকাণ্ড দেখি না।

ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম খুব সফলভাবে মূল্যস্ফীতির চাপ ঠেকাতে পেরেছে। এর কারণ হলো, তারা বাজার তদারকিব্যবস্থা শক্তিশালী রেখেছে, জবাবদিহি নিশ্চিত করেছে, বাজারে সরবরাহে যাতে ঘাটতি না, হয় সে ব্যবস্থা নিয়েছে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিলে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পত্রপত্রিকায় যখন লেখালেখি হয়, তখন কিছুটা তোড়জোড় দেখা যায়, তারপর ব্যাপারটা একেবারে উবে যায়। বাজারে এর কোনো প্রভাব দেখা যায় না।

সরকার গত বছর থেকে এক কোটি পরিবারকে ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে সহযোগিতা দেওয়া শুরু করেছিল। এর পরিসর ও পরিমাণ বাড়ানো দরকার। পরিবারগুলোর এক মাসের খরচ ও প্রয়োজনের তুলনায় যেটা দেওয়া হচ্ছে, সেটা অনেক কম। কোভিডের সময় থেকেই মধ্যবিত্তরা চাপে আছে। তারা কোনো তালিকার মধ্যে নেই। আবার নানা ধরনের সামাজিক সংকোচও তাদের মধ্যে কাজ করে। নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্য–মধ্যবিত্তদের মধ্যে যারা সীমিত আয়ের চাকরি ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তাদের কীভাবে সহযোগিতার আওতায় আনা যায়, সেসব বিষয় আলোচনার মধ্যে আনা প্রয়োজন। সরকারের পাশাপাশি এ সময় বেসরকারি খাতকেও এগিয়ে আসতে হবে। পোশাকশিল্পসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত শিল্পকারখানায় মালিকেরা তাদের কর্মীদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করতে পারে। এ ধরনের উদ্যোগ দরকার এই কষ্টের সময় পার করার জন্য।

প্রশ্ন

বিদ্যুৎ-জ্বালানি-গ্যাসের দাম দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে। শীতে এমনিতেই চাহিদা কম থাকে। গ্রীষ্ম মৌসুমে পরিস্থিতি কতটা সামাল দেওয়া যাবে?

সেলিম রায়হান: বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে সরকারের হয়তো ইচ্ছা আছে, চেষ্টা আছে, কিন্তু সমন্বিত পরিকল্পনার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সঙ্গে মিলিয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতেও সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা আসা দরকার। বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম সমন্বয়ের ক্ষেত্রে কোনো স্বচ্ছ প্রক্রিয়া এখানে নেই। হঠাৎ সিদ্ধান্ত আছে। এ কারণে বড় ধরনের চাপ একবারে আসে। দাম বাড়ালেই যে বিদ্যুৎ-জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চিত হবে, সে নিশ্চয়তা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। গ্যাস, ডিজেল আমাদের কিনতে হয় ডলারে। দেশে মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে টাকায়। শেষ পর্যন্ত আমরা আমদানি করতে পারছি কি না, সেটা নির্ভর করছে আমাদের ডলারের সরবরাহের ওপর।

বিদ্যুৎ-জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি যৌক্তিকভাবে করা হচ্ছে কি না, সে জায়গায় প্রশ্ন তোলা দরকার। দাম সমন্বয়ের বিষয়টি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের হাত থেকে সরকার নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়া ও হিসাবে সেখানে কতটুকু স্বচ্ছতা বজায় থাকবে, সে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

প্রশ্ন

আইএমএফের ঋণ চলমান সংকট মোকাবিলায় কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে?

সেলিম রায়হান: আমাদের যে চাহিদা, তার তুলনায় আইএমএফের ঋণের পরিমাণ খুব বেশি নয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দুটি সুবিধা আমরা পাচ্ছি। প্রথমত, আইএমএফ চুক্তিতে যাওয়ার আগে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা মূল্যায়ন করেছে। ফলে অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাকে আর নতুন করে এতটা মূল্যায়ন করতে হবে না। আমরা দেখেছি, আইএমএফ সম্মত হওয়ার পর বিশ্বব্যাংক, এডিবি আরও বর্ধিতভাবে ঋণসুবিধা দিতে এগিয়ে এসেছে। দ্বিতীয়ত, এই ঋণের সঙ্গে সংস্কার কর্মসূচির কথা বলা হচ্ছে। এত বছর ধরে যে সংস্কারের কথা আমরা বলে এসেছি, এখন তার একটা ক্ষেত্র তৈরি হলো।

প্রশ্ন

এত আলোচনার পরও সংস্কার কেন এত দিনেও শুরু করা যায়নি?

সেলিম রায়হান: বাংলাদেশে এত দিন সংস্কার করতে না পারার বড় কারণ হলো সংস্কারবিরোধী যারা, তারা যথেষ্ট শক্তিশালী। এখানে ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বা স্বজনতোষণ পুঁজিবাদ চালু হয়েছে। সংস্কার যাঁরা ঠেকিয়ে রেখেছেন, তাঁরা অনেক বেশি প্রভাবশালী এবং তাঁরা বিদ্যমান ব্যবস্থা থেকে সুবিধা নেন। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের শক্তিশালী রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। এই ক্রান্তিকালে সরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাবে বলে আশা করি।

প্রশ্ন

সংস্কারের চাপটা কি শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষকেই বইতে হবে?

সেলিম রায়হান: এ ধরনের সংস্কার করতে গেলে তার অনেক ব্যথাও আছে। সংস্কারের ব্যথা কে বহন করবে? কিছু ব্যথা আছে, যেগুলো হয়তো অনিবার্য। সেটা এড়ানোর উপায় নেই। সে ক্ষেত্রে জনগণের দুর্দশা কিছুটা লাঘবের জন্য সরকারকে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। প্রভাবশালীরা যদি সংস্কারের দায় না নেয়, নানা লবি করে বাড়তি সুবিধা আদায় করে নেয়, তাহলে পুরো চাপ সাধারণ মানুষের ঘাড়ে গিয়েই চাপবে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণ ও ব্যবসায়ীদের যাঁরা সত্যিকার অর্থে ব্যবসা করতে চান, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে চান, তাঁদের নিয়েই সরকারকে সংস্কার কর্মসূচি এগিয়ে নিতে হবে। ক্রোনিদের নিয়ে যদি সংস্কারের নকশা করা হয়, তাহলে আমরা আগের ফাঁদ থেকে বের হতে পারব না।

প্রশ্ন

মেগা প্রজেক্টের ঋণ পরিশোধের কারণে অর্থনীতিতে বড় চাপ পড়বে। সেই সক্ষমতা কতটা আছে বাংলাদেশের?

সেলিম রায়হান: বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সক্ষমতার ক্ষেত্রে আমরা এখন বেশ চাপে আছি। মেগা প্রকল্পের কারণে কয়েক বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধের বড় একটা ক্ষেত্র তৈরি হবে। প্রতিবছরই সে পরিমাণ বড়তে থাকবে। কিন্তু আমাদের বিদেশি মুদ্রা আসার উৎস কী? রপ্তানি ও রেমিট্যান্স। এ ছাড়া কিছু অনুদান ও সহযোগিতা আছে। মেগা প্রকল্পের ঋণ শোধ করতে হলে আমাদের বিদেশি মুদ্রা আয়ের পরিসর অনেক বাড়াতে হবে। সময় না বাড়িয়ে মেগা প্রকল্পগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আমাদের বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় এখন পর্যন্ত বড় আকারের বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা যাচ্ছে না। এদিকে নজর দেওয়া দরকার। ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে আমরা বেরিয়ে আসব। তখন নতুন করে আরেকটা ধাক্কা আসবে। সব দিক বিবেচনায় সামনের বছরগুলোয় ঋণ পরিশোধের ওপর চাপটা বাড়বে। কিন্তু চাপ মুক্ত করার জন্য যে শক্তিশালী ব্যবস্থা দরকার, সে সক্ষমতা আমাদের গড়ে ওঠেনি এখনো। একক পণ্যের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে রপ্তানি বহুমুখী করা প্রয়োজন। আমাদের প্রবাসী আয়ের একটা বড় অংশ হুন্ডির মাধ্যমে আসে। বৈধ পথে টাকা যাতে আসে, সেটা নিশ্চিত করা দরকার। বাংলাদেশ থেকে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যায়, সেটা হুন্ডি ব্যবসাকে রমরমা করে রাখে।

প্রশ্ন

আপনাকে ধন্যবাদ।

সেলিম রায়হান: আপনাকেও ধন্যবাদ।