আব্দুল হাসিব চৌধুরী
আব্দুল হাসিব চৌধুরী

বিশেষ সাক্ষাৎকার: আব্দুল হাসিব চৌধুরী

এটি আর শুধু ছাত্রদের আন্দোলন থাকল না

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি আব্দুল হাসিব চৌধুরী প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরবর্তী সহিংস পরিস্থিতি নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাফসান গালিব

[কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও পরবর্তী সংঘর্ষ–সহিংস পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই ২০২৪) রাত থেকে দেশজুড়ে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। মঙ্গলবার (২৩ জুলাই ২০২৪) রাতে সীমিত আকারে ইন্টারনেট চালু করা হয়। ফলে শুক্রবার (১৯ জুলাই ২০২৪) প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকায় প্রকাশিত এ লেখা আজ বুধবার (২৪ জুলাই ২০২৪) অনলাইনে প্রকাশ করা হলো।]

প্রশ্ন

কোটা সংস্কারের আন্দোলন এত দিন শান্তিপূর্ণ ছিল, সেটি সহিংস পর্যায়ে চলে গেল কেন?

আব্দুল হাসিব চৌধুরী: এ আন্দোলন সহিংস হয়ে উঠেছে, বিষয়টিকে আমি সেভাবে দেখছি না। আন্দোলনকারীদের সহিংস মনোভাব ছিল না। যখন তাদের ওপর বাধা ও আঘাত এল, তখন তারা প্রতিরোধের পথ বেছে নিয়েছে।

এ ছাড়া রংপুরে আবু সাঈদ নামের যে ছাত্রটি পুলিশের গুলির সামনে দুই হাত ছড়িয়ে দিয়ে বুক পেতে দিয়ে মারা গেছে, সেই ছবি বিশ্বজুড়ে একটি আইকনিক ছবি হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে। কোনো মতলবি আন্দোলন এমন আইকনিক ছবি তৈরি করতে পারে না। তেজ ও শৌর্যের বিবেচনায় আন্দোলনকারীদের চেতনা ও মানসিক দৃঢ়তা আমরা বুঝতে পারি।

এই আইকনিক ছবিই আমাদের সামনে ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন প্রবলভাবে হাজির করে। এই ছবিই এই বার্তা দেয়, ছাত্ররা যে আর রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় সিস্টেমের দাস হয়ে থাকতে চায় না। ছবিটি ছাত্রদের প্রতিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করেছে।

প্রশ্ন

পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনী, সরকারের ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মী ও বহিরাগতরা মিলে যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে দিল, বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

আব্দুল হাসিব চৌধুরী: দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা ও আক্রমণ চালিয়ে যেভাবে শিক্ষার্থীদের বের করে দেওয়া হলো, তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। একজন শিক্ষক হিসেবে আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

কিন্তু একসময় না একসময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তো খুলে দিতে হবে। ইতিমধ্যে অনেক তাজা প্রাণ ঝরে গেছে। এখন এই যে ছাত্ররা যে প্রতিরোধ-সংগ্রামের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে, ক্যাম্পাসে ফিরে কিন্তু ঠিকই তারা জ্বলে উঠবে। ক্যাম্পাস বন্ধ করে শান্তি ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত সুফল দেবে বলে মনে হয় না।

প্রশ্ন

শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে প্রাণহানি হয়েছে, সংঘর্ষ ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। এটি কি এখন আর শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আছে মনে করেন?

আব্দুল হাসিব চৌধুরী: এটিই আসলে এই মুহূর্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। গত কয়েক রাত সারা দেশের আমাদের মায়েরা নির্ঘুম কাটিয়েছেন। তাঁদের সেই উদ্বেগ পরিবার থেকে শুরু করে সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ১৬ জুলাইয়ে রংপুরের আবু সাঈদসহ আরও ছাত্রের নিহতের ঘটনা সর্বস্তরের মানুষকে আলোড়িত করেছে। তখন এই আন্দোলন পুরোপুরি ভিন্ন একটি পর্যায়ে চলে গেছে। এটি এখন আর শুধু কোটা সংস্কারের প্রশ্ন হয়ে থাকল না।

১৯৫২ সালে যখন ভাষার জন্য আন্দোলন হয়েছে, শেষ পর্যন্ত সেই আন্দোলন কি সেখানে থাকতে পেরেছে? ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন এমনকি এরশাদের সময় মজিদ খানের শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যে আন্দোলন শুরু করেছিল, তা কি সেই আন্দোলনে থাকতে পেরেছিল?

এখন ছাত্রদের দাবিকে আপনি অগ্রাহ্য করতে থাকেন এবং মনে করেন কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কেউ বিভ্রান্ত করছে, তখন অবশ্যম্ভাবী এটি রাজনৈতিক হয়ে উঠবে।

প্রশ্ন

সরকার এখন কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছে এবং সরকারি দলও চাকরিতে ৮০ শতাংশ নিয়োগ মেধাভিত্তিক রাখার আবেদন করবে বলে জানিয়েছে। সরকার ও সরকারদলীয় এ সিদ্ধান্তকে কীভাবে দেখছেন?

আব্দুল হাসিব চৌধুরী: এখন এ সিদ্ধান্ত যদি তাঁরা সপ্তাহখানেক আগে নিতেন, তাহলে পরিস্থিতি এ পর্যন্ত গড়াত না। যখন আঘাত এল, তখন সারা দেশের স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েসহ লাখো শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে এল এবং তাদের বাধা দিতে গিয়ে অনেক প্রাণহানি ঘটল। তখন এ সিদ্ধান্ত এল, সেটি আসলে বাধ্য হয়ে নিয়েছেন, তাঁরা আন্তরিক নন।

প্রশ্ন

এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আপনার কী পরামর্শ থাকবে?

আব্দুল হাসিব চৌধুরী: ছাত্ররা যখন দেখছে তাদের গুলি করে মারা হচ্ছে, তখন এ আন্দোলন আরও প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। পরিস্থিতি আরও সহিংস হয়ে উঠছে। পরিস্থিতি এখান থেকে ফেরাতে চাইলে দ্রুত সব ধরনের হামলা বন্ধ করতে হবে। পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি—সব ধরনের বাহিনীকে প্রত্যাহার করতে হবে।

ছাত্রদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে যেতে দিতে হবে। তাদের যদি ক্যাম্পাসে ফিরে যেতে দেওয়া না হয়, তারা তো ঘরে বন্দী হয়ে থাকবে না, তখন রাস্তায় নামবে।

আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হাতের মুঠোয় রাখার কথা চিন্তা করলেও বিষয়টি ভুল হবে মনে করি। ছাত্রদেরই সিদ্ধান্ত নিতে দিতে হবে ক্যাম্পাসে রাজনীতি থাকবে কি থাকবে না এবং থাকলে কীভাবে থাকবে।

প্রশ্ন

আপনাকে ধন্যবাদ।

আব্দুল হাসিব চৌধুরী: আপনাকেও ধন্যবাদ।