শাহ আলম
শাহ আলম

সংবিধান পুনর্লিখনের বিপক্ষে আমরা

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান–পরবর্তী রাজনীতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের নানা উদ্যোগ ও সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি শাহ আলম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান।

প্রশ্ন

সাম্প্রতিক ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সাবেক স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটল। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিল। কী পরিবর্তন লক্ষ করছেন?

শাহ আলম: এটি ছিল স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন। এই আন্দোলনে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যুক্ত ছিল, সে কারণে একে পাশ কাটানো বা হেয়প্রতিপন্ন করা যাবে না। একই সঙ্গে আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি নিজেদের অবস্থান সংহত করেছে। সাম্প্রদায়িক ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিও নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করেছে।

প্রশ্ন

কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে ছাত্র গণ-অভ্যুত্থান ঘটল, তারা কি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছিল?

শাহ আলম: না, তারা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছিল না। এমনকি তারা সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গেও নানাভাবে আপস করেছে। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধের অপব্যবহার করেছে। এসব কারণেই অনেকে মুক্তিযুদ্ধ ও বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন নিয়ে কটাক্ষ করছেন। এটা হওয়া উচিত ছিল না। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে যে গণতান্ত্রিক ধারা তৈরি হয়েছে, সেটাকে রক্ষা করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, সাম্প্রদায়িক শক্তি কখনো গণতন্ত্রের সহায়ক হতে পারে না। যারা সত্যিকার গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার শক্তি, তাদের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক শক্তির সংঘাত বাধবেই।

প্রশ্ন

ছাত্র গণ–অভ্যুত্থানে বাম গণতান্ত্রিক জোটের কী ভূমিকা ছিল? অনেক বাম দল নিষ্ক্রিয় ছিল বলে অভিযোগ আছে।

শাহ আলম: এটা প্রথমে অরাজনৈতিক আন্দোলন ছিল। ছাত্রদের দাবি ছিল কোটা বাতিলের। ১৬ জুলাই যখন ছাত্রলীগ আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপর হামলা করল, তখনই এটা সর্বাত্মক রূপ নেয়। কোটাবিরোধী আন্দোলন সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নিল। তখনো কিন্তু ছাত্ররা সরকারের পদত্যাগ চায়নি। তারা ৯ দফা দাবি দিয়েছিল। তারা খুব কৌশলী ছিল, ধাপে ধাপে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েছে। আমরা কিন্তু ১৬ জুলাইয়েই বলেছি, সরকারকে পদত্যাগ করে নতুন নির্বাচন দিতে হবে। দুর্ভাগ্য, আমাদের আন্দোলনের খবর সংবাদমাধ্যমে তেমন আসেনি।

প্রশ্ন

অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে ছয়টি কমিশন গঠন করেছে। এ সম্পর্কে আপনাদের চিন্তাভাবনা কী?

শাহ আলম: প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে আমরা সংস্কার নিয়ে আমাদের দাবির কথা বলেছি। তিনি আমাদের কথা শুনলেন। আমি বললাম, আপনি পশ্চিমা গণতন্ত্রের সমর্থক। কিন্তু পশ্চিমা গণতন্ত্র ও সাম্প্রদায়িকতা তো সাংঘর্ষিক। এটা কীভাবে মোকাবিলা করবেন? আমরা স্থানীয় সরকার সংস্থার ক্ষমতায়নের ওপর জোর দিলাম। তাঁরা এ বিষয়ে আগ্রহ দেখালেন।

প্রশ্ন

সংবিধান সংশোধন ও পুনর্লিখন নিয়ে বাহাস চলছে। আপনাদের অবস্থান কী?

শাহ আলম: আমরা সংবিধান পুনর্লিখনের বিরোধী। আমরা বলেছি, সংবিধানে মানবাধিকারবিরোধী, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাবিরোধী ও ব্যক্তির স্বাধীনতা ক্ষুণ্নকারী ধারা থাকলে সেগুলো সংশোধন করুন। কিন্তু পুরো সংবিধান বাতিল করতে হবে কেন? আমরা বলেছি, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানের যতটুকু সংশোধন প্রয়োজন, ততটুকু সংশোধন করুন।

প্রশ্ন

নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক আছে। আপনাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করুন।

শাহ আলম: আমরা আনুপাতিক নির্বাচনের কথা বলেছি। বাম দলগুলোই সবার আগে আনুপাতিক ভোটের কথা বলে এসেছে। সেই সঙ্গে আমরা না ভোট ও রিকল ব্যবস্থা চালুর কথা বলেছি। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী খরচের যে সীমা বেঁধে দিয়েছে, শ্রমিক ও কৃষক তার জোগান দিতে পারবে না। সীমা তুলে দেওয়া হোক। সরকার ইনক্লুসিভ নির্বাচনের কথা বলছে। কিন্তু নির্বাচনের নামে টাকার খেলা হলে তো গরিব ও সাধারণ মানুষ প্রথমেই বাদ পড়বে।

প্রশ্ন

অন্তর্বর্তী সরকার কি ঠিক পথে আছে বলে মনে করেন?

শাহ আলম: সরকার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধে যাঁদের বসিয়েছে, তাঁরা বেশ কিছু সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন। ব্যাংকিং খাতসহ অনেক প্রতিষ্ঠানকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির আওতায় আনা হয়েছে। এগুলো ভালো দিক। কিন্তু সমস্যা হলো সরকার ১/১১ কেন এসেছিল, সে দিকে নজর দেয়নি।

প্রশ্ন

এবারের পরিস্থিতি তো ভিন্ন।

শাহ আলম: বাংলাদেশে গণতন্ত্রের যে সংকট, সে জন্য জনগণ দায়ী নয়। দায়ী হলো সাংঘর্ষিক রাজনীতি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে এ দেশের মানুষ সব সময় জয়ী হয়েছে। আন্দোলনের পর যাঁরা ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁরা স্বৈরতান্ত্রিকভাবে দেশ চালিয়েছেন। ১/১১ এসেছিল রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে সামরিক ব্যুরোক্রেসির দ্বন্দ্বের কারণে। এবার জনগণই এগিয়ে এসেছে, সরকারের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। কিন্তু এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্র তো বদলায়নি। দেশে যে লুটেরা অর্থনীতি চলছে, তার বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী সরকার কোনো বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নেয়নি। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় সেটা সম্ভবও নয়।

বাজারে যে সিন্ডিকেট আছে, বক্তৃতা দিয়ে তা ভাঙা যাবে না। এ জন্য বিকল্প বাজারব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। সর্বজনীন রেশনিং চালু করলে গরিব মানুষ ও সীমিত আয়ের মানুষ উপকৃত হবে। কিন্তু গত দুই মাসে সরকারের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে কোনো শক্ত পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।