বিশেষ সাক্ষাৎকার: শফি মুহাম্মদ তারেক

ঢাকার বাতাসে আমরা ব্যাকটেরিয়া-ছত্রাকও পেয়েছি

ড. শফি মুহাম্মদ তারেক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে তিনি হাইড্রোবায়োজিওকেমিক্যাল অ্যান্ড পলিউশন কন্ট্রোল ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করেন। গবেষণার জন্য তিনি বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স এবং ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্স থেকে সেরা তরুণ বিজ্ঞানী হিসেবে স্বর্ণপদক পান। বাংলাদেশ বায়ুদূষণের কারণ, ক্ষতি ও করণীয় নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইফতেখার মাহমুদ

প্রশ্ন

বায়ুদূষণে বাংলাদেশের অবস্থার তো উন্নতি হচ্ছে না? এবারও বায়ুদূষণে ঢাকা বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়ে গেল। পরিস্থিতির কেন উন্নতি হচ্ছে না? 

শফি তারেক: কেন উন্নতি হচ্ছে না, সেই প্রশ্নের উত্তর আমরা সবাই মোটামুটি জানি। যারা বায়ুদূষণের জন্য দায়ী, তাদের থামানোর জন্য যে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া দরকার, তা কেউ নিতে চাইছে না। সবাই জানে যে ঢাকায় বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হচ্ছে সড়কে চলাচলকারী মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন। সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলেও আমরা দেখি যে ওই সব গাড়ির হয় লাইসেন্স নেই বা ফিটনেস নেই। অথচ এসব গাড়ি দিব্যি আমাদের চোখের সামনে কালো ধোঁয়া উড়িয়ে চলে যাচ্ছে। এগুলো দেখার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থা আছে। বিআরটিএ, পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসন এ ব্যাপারে চাইলেই ব্যবস্থা নিতে পারে।

 আপনি যদি দৈবচয়নের ভিত্তিতে একটি দূষণকারী গাড়ি নিয়ে পরীক্ষা করেন দেখবেন, এগুলোর বেশির ভাগ ২০ থেকে ২৫ বছরের পুরোনো। জাপান বা উন্নত দেশগুলোয় কোনো গাড়ি চার বছরের বেশি চালানোর নিয়ম নেই। কারণ, ওই সময়ের পর গাড়িগুলোর জ্বালানি থেকে দূষণ করার ক্ষমতা বেড়ে যায়। এ জন্য এসব গাড়ি রিকন্ডিশন আকারে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোয় পাঠানো হয়। তার মানে শুধু পণ্য নয়, দেশে দূষণও আমদানি হচ্ছে। 

প্রশ্ন

কিন্তু ইটভাটা ও নির্মাণকাজ থেকে প্রচুর দূষণ হচ্ছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা তো কাঠামোগতভাবে সহজ। যেমন মেয়াদোত্তীর্ণ ইটভাটাগুলোর লাইসেন্স বাতিল করা সম্ভব, এমনকি দূষণের অভিযোগে ভেঙে দেওয়া সম্ভব। আর নির্মাণকাজ তদারকির জন্য তো রাজউক, সিটি করপোরেশন ও পরিবেশ অধিদপ্তর আছে? 

শফি তারেক: আসলে সমস্যাটাকে সুনির্দিষ্টভাবে ভবন বা অবকাঠামো নির্মাণের আলোকে দেখলে হবে না। ঢাকা শহর সামগ্রিকভাবে একটি বিপর্যয়ের দিকে এগোচ্ছে। এই শহরে যত মানুষ থাকা সম্ভব, তার কয়েক গুণ বেশি মানুষ এখানে থাকে। বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য লজিস্টিক বা সেবা নিশ্চিত করতে হচ্ছে। যেমন সড়ক, ভবন, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেলসহ বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণের দিকে সরকারের নজর বেশি। আর এসব উন্নয়ন রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এসব প্রকল্পে মানুষের বাহবা পাওয়া যায়। আর এসব কাজ করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের ঘটনা ঘটে। যেমন নির্মাণকাজের জন্য প্রচুর ইট, বালু, সিমেন্ট, রং দরকার হয়। এগুলোর ব্যবহার যত বাড়বে, দূষণও তত বাড়বে। 

ঢাকা এখন বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল শহর। ফলে আমাদের উচিত ছিল এই দ্রুত অবকাঠামোর নির্মাণের ফলে যাতে বায়ুদূষণ বেশি না হয়, সে জন্য একটি সঠিক পরিকল্পনা ও নিয়ম হাজির করা। তা করা হয়নি। আর বায়ুদূষণের কারণে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তা চোখে খুব বেশি স্পষ্টভাবে দেখা যায় না। এর প্রভাব পড়ে আস্তে, দীর্ঘ মেয়াদে। ফলে বায়ুদূষণ নিয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকদের মাথাব্যথা কম। গণমাধ্যমেরও এ ব্যাপারে দায়িত্ব আছে। 

প্রশ্ন

দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা বলতে আসলে কী বোঝাচ্ছেন। কারণ, বায়ুদূষণে ঢাকার অবস্থান কত, বায়ুর মান কেমন—এসব বিষয়ে তো গণমাধ্যম নিয়মিত সংবাদ পরিবেশন করে আসছে।

শফি তারেক: একটি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে বা কোথাও আগুন লাগলে তার ক্ষয়ক্ষতি আমরা চোখে দেখতে পাই। মৃত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর আহাজারি মানুষের মনকে স্পর্শ করে। সরকার দ্রুত এসব ঘটনায় তাৎক্ষণিক কিছু ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু বায়ুদূষণের কারণে আপনার ঠান্ডা, কাশি, ফুসফুসের সমস্যা, ক্যানসার, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা ধরনের রোগ স্থায়ী রূপ নেবে। এসব রোগবালাই আপনার আয়ু কমিয়ে দেবে। অকালে মৃত্যু ঘটাবে। কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেবে। এসব সমস্যার কারণ হিসেবে আপনারা বায়ুদূষণকে হয়তো দায়ী করবেন না। ভাববেন আপনার নিজের কোনো একটি কারণে এসব সমস্যা হয়েছে। ফলে বায়ুদূষণকে সরকারি লোকজন গুরুত্ব দেয় না। আর গণমাধ্যম শুধু বায়ুদূষণে বাংলাদেশ কোন অবস্থানে আছে, এ ধরনের র‍্যাঙ্কিংয়ের তথ্য দিয়েই খালাস। নিয়মিতভাবে এর স্বাস্থ্যঝুঁকি, পরিবেশগত ক্ষতি, কৃষি, জীববৈচিত্র্যসহ নানা খাতে নেতিবাচক প্রভাবগুলো তুলে আনে না। 

প্রশ্ন

বায়ুদূষণের মাত্রা ও তীব্রতা বোঝার জন্য সাধারণত অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা পিএম-২.৫ ও পিএম-১০–এর বিষয়টিকে সবাই গুরুত্ব দেয়। এর বাইরে আর কোন ক্ষতিকর উপাদান বাতাসে আপনারা দেখতে পাচ্ছেন। 

শফি তারেক: আমরা সাধারণত বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণকে বিবেচনায় নিয়ে কোনো একটি এলাকার বাতাস কতটা ভালো বা খারাপ, তা বিবেচনা করি। কিন্তু আমরা সাম্প্রতিক সময় গবেষণা করে বেশ কিছু মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান ঢাকার বাতাসে পেয়েছি। যেমন নভেম্বর থেকে মে মাসের মধ্যে ঢাকার বায়ুপ্রবাহের মধ্যে আমরা ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের স্ট্রেন পেয়েছি। সাধারণত আমরা জানি, এ সময়ে আবহাওয়াগত কারণে আমাদের হাঁচি-কাশি বেশি হয়। আর এর জীবাণুগুলো অবশ্যই বাতাসে প্রবাহিত হয়। তবে তা খুব বেশি দূরে যেতে পারে না বলেই আমরা জানতাম। আমাদের গবেষণায় দেখেছি, এসব জীবাণু একজনের হাঁচি-কাশির মাধ্যমে বাইরে বের হয়ে বাতাসে ভেসে ১০ থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত দূরে গিয়ে আরেকজন মানুষের নিশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করতে পারে। সবচেয়ে মারাত্মক হয় যদি তা খাবারে গিয়ে পড়ে। এতে তা পাকস্থলীতে চলে গিয়ে মারাত্মক সংক্রমণ ও ক্ষতি করতে পারে। 

যে কারণে বাইরের উন্মুক্ত স্থানে ধুলাবালু পড়তে পারে, এমন খাবার আমাদের অবশ্যই ত্যাগ করতে হবে। অনেক মনে করে, ধুলা পরিষ্কার করে সেটি খেয়ে নিলেই হলো। কিন্তু ধুলার জন্য যে ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের অস্তিত্ব আমরা পেয়েছি, তা তো খাবারে রয়ে যায়। ফলে বায়ুদূষণ দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

প্রশ্ন

এসব স্বাস্থ্য সমস্যার সঙ্গে বায়ুদূষণের সরাসরি কোনো সম্পর্ক কি প্রমাণ করা গেছে?

শফি তারেক: নিশ্চয় এ ধরনের প্রমাণ আমরা পেয়েছি। যেমন ২০১৫ সালে রাজধানীতে ঠান্ডা-কাশিতে মোট এক লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল। ওই সময়ে ঢাকার বায়ুর মানের চেয়ে ২০২৩ সালে বায়ুর মান প্রায় দ্বিগুণ খারাপ হয়েছে। আর ঠান্ডা–কাশিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা বেড়ে পাঁচ লাখ ছাড়িয়েছে। এ সময়ের মধ্যে আমরা ঢাকার বাতাসে বিষাক্ত উপাদান অর্থাৎ ভারী ধাতু বা হেভিমেটাল বাড়তে দেখেছি। সিসা, ক্যাডমিয়ামের মতো ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান ঢাকার বাতাসে বাড়ছে। এ সবকিছু মিলে ঢাকার বাতাস মারাত্মকভাবে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু তাতেও কারও কোনো গা দেখছি না।

প্রশ্ন

তাহলে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী? 

শফি তারেক: উপায় আমাদের বের করতে হবে। এসব উপায় আমাদের সবারই কমবেশি জানা। প্রথমত, বায়ুদূষণের ক্ষতির বিষয়টিকে বেশি করে প্রচার করতে হবে। সরকারের নীতিনির্ধারক মহলকে এ ব্যাপারে সংবেদনশীল করতে হবে, যাতে তারা বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়। কোভিডের মতো মহামারি মোকাবিলায় বাংলাদেশ তো যথেষ্ট সফলতার পরিচয় দিয়েছে। 

ফলে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, স্বেচ্ছাসেবকদের ভূমিকা এবং বেসরকারি সংস্থাগুলো মিলে কাজ করলে তা সম্ভব। তবে মূল কাজটি সরকারকে করতে হবে। মেয়াদোত্তীর্ণ দূষণকারী গাড়িগুলোকে যদি পেট্রল ও গ্যাসপাম্প থেকে জ্বালানি দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া যায়, তাহলে এগুলো দ্রুত সংশোধিত হবে। 

ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। নির্মাণকাজের ধুলা নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজউক, সিটি করপোরেশন ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে উচ্চপর্যায়ের কমিটি করতে হবে। আমরা রানা প্লাজা ধসের পর তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর ভবন তো ঠিক করতে পেরেছি। তাহলে নির্মাণকাজের সময় কেন ধুলা–দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। আসল কথা হচ্ছে, বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। তাহলে বায়ুকে দূষণমুক্ত করে নির্মল করা সম্ভব, যেটা চীন, ভারত, থাইল্যান্ডের মতো দেশ করতে শুরু করেছে। 

প্রশ্ন

আপনাকে সময় দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। 

শফি তারেক: আপনাকেও ধন্যবাদ।