অর্থনীতির বর্তমান দাবি পূরণে বাজেট বড়ভাবেই ব্যর্থ হয়েছে

ড. সেলিম রায়হান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে তিনি কথা বলেছেন
প্রথম আলোর সঙ্গে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান মনোজ দে

ড. সেলিম রায়হান
প্রশ্ন

প্রথম আলো: নির্বাচনী বছরে বাজেট ঘোষণা করা হলো। এবারের বাজেটে ইতিবাচক দিকগুলো কী বলে মনে করছেন?

সেলিম রায়হান: প্রতিবছরের ধারাবাহিকতায় এবারের বাজেটেও কিছু ইতিবাচক বিষয়ের প্রতিফলন হয়েছে। পাশাপাশি নতুন কিছু ইতিবাচক বিষয়ও যুক্ত হয়েছে। এবারের বাজেটে ব্যক্তিগত আয়করসীমা বাড়ানো হয়েছে, বিলাসপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে কিছু ভাতা বাড়ানো হয়েছে, পরিসরও খানিকটা বাড়ানো হয়েছে। এবারের বাজেটে কার্বন করসহ এমন কিছু জায়গায় কর আরোপ করা হয়েছে, যেটার প্রয়োজন অনেক আগে থেকেই ছিল। ফ্ল্যাট ও জমির রেজিস্ট্রেশন ফি, দ্বিতীয় গাড়ি কেনা ও ভ্রমণের ক্ষেত্রে কর বাড়ানো হয়েছে—এগুলোও এবারের বাজেটের ইতিবাচক দিক।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: বাজেটের নেতিবাচক দিক কোনগুলো বলে মনে করেন?

সেলিম রায়হান: আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, অর্থনীতির এ সময়কার যে দাবি, সেটা এই বাজেট পূরণ করতে পেরেছে কি না। এ ক্ষেত্রে বাজেট বড়ভাবেই ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের অর্থনীতির এখনকার দুটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমটা মূল্যস্ফীতি। দ্বিতীয়ত, আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা। মূল্যস্ফীতির দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখতে পাব, ৮ থেকে ৯, কোনো কোনো সময় ১০ শতাংশের কাছাকাছি উচ্চ মূল্যস্ফীতির এক বছরের বেশি সময় ধরে বিরাজ করছে। এটা বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠীর, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। মূল্যস্ফীতির বিষয়টা বাজেটে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা করার জন্য কী কৌশল নেওয়া হবে, কী উদ্যোগ নেওয়া হবে, সেটা অনেক বড়ভাবেই অনুপস্থিত। সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় বিশেষ করে রাজস্ব আদায়, আর্থিক খাতের অব্যবস্থাপনা, অর্থনীতির অন্যান্য জায়গায় যে সংকট আছে, সেগুলো সামলে নেওয়ার জন্য কী করা উচিত, সে ব্যাপারে কোনো দিকনির্দেশনা দেখা যাচ্ছে না।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: অনেকে বলছেন এবারের বাজেট উচ্চাভিলাষী। আপনার মূল্যায়ন কী?

সেলিম রায়হান: যেকোনো বিষয়ের একটা তো ভিত্তি থাকতে হবে। একটা বিষয় হলো, বর্তমানের যে ভিত্তি, তার ওপর নির্ভর করে বাজেট উচ্চাভিলাষী হতেই পারে। কিন্তু আমাদের যে বর্তমান পরিস্থিতি, তাতে তো বিলাসিতা করার সুযোগ নেই। এ কারণে এবারের বাজেট যে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য, সেটাকে প্রসঙ্গের বাইরের একটা বিষয় বলে মনে হয়েছে। বাজেটে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যাভিমুখী নয় এবং এর লক্ষ্য ও মনোযোগের কেন্দ্রটা ঠিক নেই। বাজেটে যদি লক্ষ্য ও মনোযোগের কেন্দ্রটাকে ঠিক করা যেত, তাহলে অগ্রাধিকারসহ অন্য বিষয়গুলো ঠিকমতো আসত।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: ব্যক্তি আয়করসীমা কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। এটা কি যথেষ্ট বলে মনে করেন?

সেলিম রায়হান: আয়করসীমা যেটা বাড়ানো হয়েছে, সেটা আপাতদৃষ্টে যথেষ্ট বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এটার সঙ্গে বেশ কিছু সাংঘর্ষিক সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। সরকারি ৪৪টি সেবা পাওয়ার জন্য কেউ যদি ব্যক্তি আয়করসীমার বাইরেও থাকেন, তাঁকেও ২ হাজার টাকা দিতে হবে। এটাকে নৈতিকভাবে ঠিক বলে মনে করি না। আমরা কি তাহলে ধরে নিচ্ছি, একজন নিম্ন আয়ের মানুষ তাঁর আয় গোপন করে সরকারি সেবা নিতে যাচ্ছেন? আমাদের নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে আয় গোপন করার প্রবণতা কতটুকু? আমরা তো দেখি যাঁরা উচ্চ আয়ের মানুষ, যাঁরা অতিধনী, তাঁদের মধ্যেই অনেকে করখেলাপি, ঋণখেলাপি, টাকা পাচারকারী। তাঁরা নানা ধরনের সরকারি সুবিধাপ্রাপ্ত। তাঁদের বিদেশভ্রমণ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, তাঁদের সরকারি সেবা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে—এ রকম কিছু তো আমরা কখনো শুনি না। পাশাপাশি উঁচু ধনীদের মধ্যে যাঁরা করখেলাপি, ঋণখেলাপি, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা শক্তভাবে যদি বলা হতো, তাহলে হয়তো বিষয়টি ন্যায্যতা পেত। সরকারি সুবিধা নাগরিকের ন্যায়সংগত অধিকার। সেখানে এ রকম শর্ত আরোপ করা মোটেই যৌক্তিক হতে পারে না।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: মূল্যস্ফীতিকে ৯ থেকে ৬–এ নামিয়ে আনার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। এটাকে কি বাস্তবসম্মত বলে মনে করেন?

সেলিম রায়হান: এটাকে তখনই সম্ভব বলে মনে করা যেত, যদি দেখা যেত এক বছরের বেশি সময় ধরে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, সেটাকে কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ, কৌশল বা নীতি কাজ করছে। বরং আমরা দেখেছি, কোনো কৌশলই সেভাবে কার্যকর হয়নি। এ ক্ষেত্রে যেসব নীতি ও কৌশল নেওয়া দরকার ছিল, সেটা সরকার নেয়নি। আমরা যদি মুদ্রানীতির দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব, জোর করে সুদহার দীর্ঘ সময় ধরে বেঁধে রাখা হয়েছে। এটা কোনোভাবেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয়নি। রাজস্ব ক্ষেত্রে কর ও অন্যান্য ফি যেগুলো আছে, সেগুলো সমন্বয় করে জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে আনার চেষ্টা করা যেত। সে ধরনের উদ্যোগও দেখা যায়নি। উদাহরণ হিসেবে জ্বালানির কথা বলা যায়। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম যখন অনেক বেড়ে গেল, তখন দেশের বাজারেও দাম বাড়ানো হলো। সে সময় আমরা বলেছিলাম, কর সমন্বয় করে দামটা সহনীয় রাখতে। সেটা করা হয়নি। জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির প্রতিটা খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনা। বাজারে অসংগতি ও খুঁত আছে, প্রতিযোগিতার ঘাটতি আছে। সেগুলো কাটিয়ে তুলতে তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে আমরা দেখিনি। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজার কারসাজির সঙ্গে যে ব্যবসায়ীরা জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বলা চলে, মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনায় এক বছরের বেশি সময় ধরে কোনো কার্যকর উদ্যোগ অথবা নীতি নেই। তাহলে আমরা কীভাবে নিশ্চিত হব যে আগামী ছয় মাস বা এক বছরে সরকার সঠিক পদক্ষেপগুলো নিতে পারবে? বাজেটে সেসব পদক্ষেপ নিয়ে কোনো আলোচনা নেই।

আরেকটা বিষয় হলো, আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ কিছু সময় ধরে জিনিসপত্রের দাম কমছে। অথচ দেশের বাজারে সেটার কোনো প্রতিফলন দেখি না। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ও মাঠপর্যায়ে উদ্যোগগুলো কী হওয়া উচিত, সেটার কোনো প্রতিফলন এবারের বাজেটে নেই। বাজেট দেখে মনে হয়েছে মূল্যস্ফীতি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কমে আসবে। বাস্তবে সেটা সম্ভব নয়।

এখন মূল্যস্ফীতির জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করার সুযোগ নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম এখন অনেকটাই কমে গেছে, জ্বালানি তেলের দামও কমে এসেছে। বিশ্বব্যাংক যে পূর্বাভাস দিয়েছে, তাতে সামনের দিনগুলোয় তেলের দাম কমে আসার আরও সম্ভাবনা রয়েছে। আমি শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান ছাড়া পার্শ্ববর্তী কয়েকটা দেশ যেমন ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনামের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে দেখব, যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে তারা মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি ও অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনাকে খুব দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করে কঠিন সময়েও তারা মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় পর্যায়ে রেখেছে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: সরকার আশা করছে, বেসরকারি বিনিয়োগ এক বছরে ২২ থেকে ২৭ শতাংশে পৌঁছাবে। কিন্তু এক দশক ধরে দেখছি সেটা ২১-২২ শতাংশে ওঠানামা করছে। বিনিয়োগের এই উল্লম্ফন কীভাবে সম্ভব হবে?

সেলিম রায়হান: আমার কাছে মনে হয়েছে, এটা একেবারেই অসম্ভব। বাংলাদেশের অতীত ইতিহাসে বেসরকারি বিনিয়োগ এক বছরে এ রকম নাটকীয় উল্লম্ফন হয়নি। সরকার সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, সেটা অর্জনের জন্য বিনিয়োগ লাগবে জিডিপির অনুপাতে ৩৩ শতাংশ। সরকারি বিনিয়োগ যদি ৬ শতাংশের মতো হয়, তাহলে বেসরকারি বিনিয়োগ কত দরকার হবে, সেটা ধরেই বেসরকারি খাতে ২৭ শতাংশ বিনিয়োগের কথা বলা হয়েছে। এটা অনেকটা অঙ্কের হিসাবের মতো। এটা বাস্তব হিসাব নয়। হিসাবের মারপ্যাঁচে বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। অর্থনীতিতে এমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, যাতে বলা যাবে বেসরকারি বিনিয়োগে নাটকীয় উল্লম্ফন হতে পারে। এক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তি খাতে ব্যাংকের ঋণের প্রবাহের প্রবৃদ্ধি যথেষ্ট কমে গেছে। এটা ক্রমান্বয়ে নিম্নমুখী। তাহলে বেসরকারি বিনিয়োগ একলাফে কীভাবে বাড়বে?

এ ক্ষেত্রে আরেকটা অসংগতি রয়েছে। সরকার জিডিপির অনুপাতে ৫ দশমিক ২ শতাংশ বাজেটঘাটতির কথা বলছে। এই ক্ষেত্রে অর্থায়নের জন্য ব্যাংকিং খাত থেকে বেশ বড় পরিমাণ ঋণ নেওয়ার কথা বলছে। প্রশ্ন হলো, আমাদের ব্যাংকিং খাত সরকারকে এত টাকা কীভাবে দেবে আর বেসরকারি খাতকে এতটা অর্থায়ন কীভাবে করবে? আমাদের বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে অর্থ জোগানের বড় উৎসই হলো ব্যাংকিং খাত। কারণ, আমাদের পুঁজিবাজারের তেমনভাবে বিকাশ হয়নি। আমাদের ব্যাংকিং খাত এত বড় অর্থায়নের জন্য প্রস্তুত নয়। সে ক্ষেত্রে ২৭ শতাংশ বিনিয়োগ একেবারেই বাস্তবতাবিবর্জিত একটা চিন্তা।

সরকার যদি ব্যাংকিং খাত থেকে এত পরিমাণ টাকা না–ও নেয়, তাহলে ঘাটতি মেটানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে যেতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে সরকারকে সেই অর্থায়ন করতে হবে টাকা ছাপিয়ে। সেটা কিন্তু মূল্যস্ফীতির ওপর আবার বাড়তি একটা চাপ সৃষ্টি করবে। বিনিয়োগের এই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য ঠিক করার চেয়ে, আমাদের অর্থনীতি যে পুরো একটা দুষ্টচক্রের মতো জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে, সেই দিকটা সমাধানের চেষ্টা দরকার ছিল এবারের বাজেটে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: প্রতিবছর বাজেটের আগে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ নিয়ে আলোচনা হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষা খাতে বাংলাদেশে সবচেয়ে কম বরাদ্দ। এবারের বাজেটেও সেই একই প্রবণতা আমরা দেখছি। এর প্রভাব কী হবে বলে মনে করছেন?

সেলিম রায়হান: শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে আমরা জিডিপির তুলনায় অনেক কম খরচ করি। এখন যেটা খরচ করি শিক্ষা খাতে কমপক্ষে তার দ্বিগুণ আর স্বাস্থ্য খাতে তিন গুণ খরচ করা উচিত। শিক্ষা খাতে এখন অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ হলো কোভিড মহামারিকালের শিখনক্ষতি। এ সময়ে শিখনক্ষতির পরিমাণ বেশ ভয়াবহ। বাজেটের কোথাও এই শিখনক্ষতি পূরণ করা জন্য কী উদ্যোগ নেওয়া দরকার, সেই বিষয়টির উল্লেখ নেই। কোভিড মহামারির সময়ে আমরা চোখ বন্ধ করে রেখেছিলাম, এখন চোখ খুললেও আমরা ভুলে যেতে চাইছি মহামারির সময়টাতে প্রকৃতপক্ষে কী হয়েছে। এই যে একটা বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠী এবং শিশুদের যে শিখনক্ষতি হয়েছে, তারা এখন থেকে কয়েক বছর পরে আমাদের শ্রমবাজারে আসবে। তারা কোন শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আসবে? প্রকৃতপক্ষে তাদের উৎপাদনশীলতা অনেক কমে যাবে। এবারের বাজেটে এই দিকটাতে একেবারেই নজর দেওয়া হয়নি। আমি আশা করেছিলাম, এবারের বাজেটে এবং সামনের বাজেটগুলোয় এই দিকটাতে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে।

আমরা কোভিডের সময় দেখেছি, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হলেও মন্ত্রণালয় সেটা খরচ করতে পারেনি। এটাকে সামনে এনে যুক্তি দেখানো হতে পারে, বরাদ্দ বাড়িয়ে লাভ কী, তারা তো খরচই করতে পারে না। এটা একটা খোঁড়া যুক্তি। স্বাস্থ্য খাতে দক্ষতা ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা যদি না বাড়ানো যায়, তাহলে এ রকম একটা দুষ্টচক্র সব সময় চলতেই থাকবে। আমরা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের কথা বলছি, আমরা উন্নত দেশ হওয়ার কথা বলছি। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে এ রকম কম বরাদ্দ দিয়ে, আমরা কোনোভাবেই সেখানে পৌঁছাতে পারব না। আমাদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত চির-অবহেলিত ছিল, এবারের বাজেটে সেই অবহেলা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে সরকার পরিচালন ব্যয় সাড়ে ৭ শতাংশ বাড়ানোর কথা বলেছে। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

সেলিম রায়হান: কৃচ্ছ্রসাধনের কথা যখন বলা হচ্ছে, তখন সরকারকে এ বিষয়ে আরও সতর্ক হওয়ার দরকার ছিল। কৃচ্ছ্রসাধনের উদাহরণটা সরকারের দিক থেকেই আসা দরকার। এ বাজেটে পরিচালন ব্যয় কমানোর মধ্য দিয়ে সরকার একটা উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারত। তবে অর্থনীতির বিভিন্ন খাত এবং উপখাতে যখন বড় ধরনের চাপ রয়েছে, তখন পরিচালন ব্যয় বাড়ানো যাবে না, সেটাকে সমর্থন করি না।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: বাজেটে আইএমএফের ঋণ বা শর্তের বিষয়টি কতটা প্রতিফলন হলো?

সেলিম রায়হান: কিছু কিছু আছে, কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্পষ্ট নয়। আইএমএফের শর্ত যেমন তিন মাস পরপর জিডিপির হালনাগাদ হিসাব প্রকাশ, সুদের হার কিংবা বিনিময় হার সমন্বয়—এ বিষয়গুলোর আলোচনা বাজেটের বাইরে শোনা গেলেও বাজেটে তেমনভাবে এগুলোর আলোচনা নেই। আমি মনে করি, আইএমএফের শর্তগুলো যেভাবে এসেছে, সেটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। আমাদের অর্থনীতির এমন একটা পর্যায়ে এসে আমরা কেন বাধ্য হচ্ছি আইএমএফের শর্ত শুনতে? সংস্কারের বিষয়গুলো অনেক দিন ধরেই দরকার ছিল। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা সমাধান করার জন্য আইএমএফ একটা প্রেসক্রিপশন হিসেবে কাজ করছে। সে ক্ষেত্রে সংস্কার কতটা গোছালোভাবে হবে, সেটা নিয়ে সংশয় আছে। সংস্কারগুলো কীভাবে করছে সরকার, বাজেটে সে বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা দেখা যায়নি।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধে কৃষিই আমাদের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রেখেছে। কিন্তু এবারের বাজেটে কৃষির প্রতি কি যথেষ্ট মনোযোগ দেওয়া হয়েছে?

সেলিম রায়হান: কৃষির ওপর মোটামুটি নজর প্রতিটি বাজেটে থাকে। করোনাকালে বিশেষ সহায়তা প্যাকেজ ছিল। এবারের বাজেটেও সহায়তা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার আছে। এটাকে ইতিবাচক বলতে হবে। কিন্তু কৃষি খাতে যে ব্যাপক উন্নয়ন ও যান্ত্রিকীকরণ দরকার, সে বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা দেখছি না। কৃষি খাতের আধুনিকায়নের জন্য যে গবেষণা ও মাঠপর্যায়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিতে যে সহায়তা আমরা আশা করেছিলাম, সেটি এই বাজেটে নেই।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: আপনি অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে দারিদ্র্য পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা করেন। দারিদ্র্য বিমোচনে যে ধরনের কর্মসূচি থাকা দরকার, তা কি এবারের বাজেটে আছে বলে মনে করেন?

সেলিম রায়হান: দারিদ্র্য নিয়ে আমরা যাঁরা গবেষণা করছি, তাঁদের সঙ্গে সরকারের নীতিনির্ধারকদের ধারণাগত পার্থক্য আছে। এ কারণে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ব্যাপক প্রসার দেখা যায় না। এবার যেটা বাড়ানো হয়েছে, সেটা অপর্যাপ্ত। নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, দরিদ্র ও অতিদরিদ্রের সংখ্যা ব্যাপক হারে কমে গেছে। কিন্তু আমাদের গবেষণায় এসেছে, বিরাটসংখ্যক জনগোষ্ঠী খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এমনকি নতুন করেও অনেকে দরিদ্র হচ্ছে। আমাদের আশা ছিল, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে বড় ধরনের রূপান্তর ঘটবে। দারিদ্র্যহার নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সরকারি হিসাবেই দেখা যায় ১৭ কোটি মানুষের তিন-চার কোটি লোক দরিদ্র। দুই কোটি লোক অতিদরিদ্র, যা নেপাল ও শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যার সমান। এই দারিদ্র্য অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে যে মহা কর্মযজ্ঞ প্রয়োজন, সেটা বাজেটে অনুপস্থিত বলেই ধারণা করি।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

সেলিম রায়হান: আপনাদেরও ধন্যবাদ।