শান্তির লক্ষ্যে তাকাতে হবে ভবিষ্যতের দিকে

কাজুমি মাৎসুই জাপানের হিরোশিমার মেয়র। তাঁর মা–বাবা দুজনই হিরোশিমায় আণবিক বোমা হামলার ভুক্তভোগী, জাপানে যাঁদের বলা হয় হিবাকুশা। কিওতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে ঢুকেছিলেন সরকারি চাকরিতে। পরে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ২০১১, ২০১৫, ২০১৯ এবং চলতি বছর—টানা চারবার হিরোশিমার মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। হিরোশিমায় আণবিক বোমা হামলা বার্ষিকীর কিছুদিন আগে প্রথম আলোর জাপান প্রতিনিধি মনজুরুল হক তাঁর একান্ত সাক্ষাৎকার নেন।

কাজুমি মাৎসুই
প্রশ্ন

আপনি বিশ্বজুড়ে শান্তির পক্ষে প্রচার চালানো মেয়রদের সংগঠন ‘মেয়রস ফর পিস’–এর সভাপতি। আমরা দেখছি, বিশ্ব পরিস্থিতি এখন শান্তির বিপক্ষে। এমন পরিস্থিতিতে আপনি বিশ্বের কাছে কোন বার্তা পৌঁছে দিতে আগ্রহী?

কাজুমি মাৎসুই: বিভিন্ন দেশ শান্তির ধারণা নিয়ে যা ভাবছে শান্তির ধারণা তার থেকে ভিন্ন কিছু হয়ে থাকতে পারে। তা সত্ত্বেও কোনো দেশের অন্য আরেকটি দেশের ওপর হামলা চালানো উচিত নয়। সহিংসতার প্রয়োগও উচিত নয়। আপনার নিজের অবাধ ইচ্ছা ধ্বংসাত্মক পরিণতি বা মানুষের জীবনের ওপর হুমকি নিয়ে আসুক, তা কাম্য নয়। এ রকম কিছু যে হওয়া উচিত নয়, গবেষক ও শিক্ষাবিদদের ভাষ্য অনুযায়ী এটাই শান্তির সংজ্ঞা।

প্রশ্ন

শান্তির সংজ্ঞা আমরা তাহলে কীভাবে নির্ধারণ করব?

কাজুমি মাৎসুই: মানুষ কীভাবে তাদের অনুভূতি ও আবেগের প্রকাশ তুলে ধরে, আমি নিজে সেই আলোকে শান্তির সংজ্ঞা নির্ধারণ করে থাকি। কেননা, আমাদের জীবন তো স্বস্তির এক জীবন, অনেক অর্থেই তৃপ্তিদায়ক উপায়ে আপনি জীবন কাটাচ্ছেন। আমাদের জীবনে অনেক কিছুই জীবনে আছে। সেই সঙ্গে আছে উজ্জ্বল এক ভবিষ্যৎ। আমরা যদি সেভাবে ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে সক্ষম হই, তবে সেটিই হবে শান্তি। আমাদের এমন একটি পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া দরকার, যাতে মানুষ এবং নাগরিকেরা ইতিবাচক অনুভূতি ধারণ করতে পারবেন। সে রকম একটি ভিত্তি তৈরি করে দেওয়ার জন্য রাজনীতিবিদদের উচিত হবে দায়িত্বের সঙ্গে ভূমিকা পালন করা।

অন্য দিকে নাগরিকদের একে অন্যের বিরুদ্ধে লিপ্ত করে দেওয়া খুবই নেতিবাচক একটি প্রবণতা। সে রকম একটি অবস্থায় যুদ্ধে শিশুদের মৃত্যু হলে ভবিষ্যৎ কী হবে? আমাদের সেই পরিস্থিতিতে কী করতে হবে? আমি এমন একটি অবস্থান গ্রহণ করতে আগ্রহী যে তেমন কিছু হওয়া উচিত নয়। আমি বিশ্বের মেয়রদের সংগঠন মেয়রস ফর পিসের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছি। মেয়রদের দায়িত্ব নাগরিকদের জীবনের তদারক করা। আমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত, যাতে এর ব্যত্যয় না ঘটে। আমরা যেন সীমানা অতিক্রম করে না যাই। এটিই হচ্ছে শান্তির লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া। এই ব্রত নিয়ে আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মেয়ররা এই সংগঠনের আওতায় সমবেত হয়েছি।

পারমাণবিক বোমা িবস্ফোরণের পর হিরোশিমা
প্রশ্ন

আমার জানামতে বাংলাদেশের তিনটি শহরের মেয়র এই সংগঠনের সদস্য। আপনি এর সদস্য বাড়ানোর প্রয়োজন বোধ করছেন কি?

কাজুমি মাৎসুই: হ্যাঁ, আমাদের মোট সদস্য এখন আট হাজারের কিছু বেশি। আমরা দ্রুত এই সংখ্যা ১০ হাজারে উন্নীত করতে চাই। হ্যাঁ, বাংলাদেশের কয়েকটি শহরের মেয়রও এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন। আমি চাই, আপনাদের দেশের আরও বেশি শহরের মেয়ররা যেন শান্তির লক্ষ্য অর্জনে আমাদের প্রচেষ্টার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। আপনি ও আপনার সংবাদ মাধ্যম আমাদের সে লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করবেন, আমি সেই প্রত্যাশা করছি।

প্রশ্ন

অনেক অর্থেই বাংলাদেশ এখনো পেছনের দিকে অবস্থান করা একটি দেশ। আমি জানতে চাই, বিস্তৃত অর্থে শান্তির লক্ষ্য অর্জন করার জন্য বাংলাদেশের জনগণকে অনুপ্রাণিত করতে তাদের আপনি কী বলতে আগ্রহী?

কাজুমি মাৎসুই: ভারতের সঙ্গে আপনাদের বিস্তৃত সীমান্ত আছে। কখনো কখনো সেটি হয়তো উত্তেজনার কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে, প্রতিবেশী বহু দেশের মধ্যে যা হয়ে থাকে। এ ছাড়া আপনাদের ধর্মীয় উগ্রবাদের সঙ্গে যুক্ত কিছু সমস্যাও আছে। বর্তমান হচ্ছে অতীতের জমা হওয়া অজস্র ঘটনার সঞ্চিত এক ভান্ডার। অতীতে যাঁরা বসবাস করেছেন, আমি মনে করি, অতৃপ্তির জীবন তাঁদের ছিল না। ভবিষ্যতেও যাতে সেরকম কিছু হতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের অবশ্যই ভবিষ্যতের দিকে তাকানো দরকার; তবে অতীতকে অবজ্ঞা করে নয়। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সে রকম কিছুই প্রত্যাশা করবে। সীমান্তের ওপারের মানুষেরা সব সময় সঠিক না–ও হতে পারেন। তবু বন্ধুত্ব গড়ে নিতে হলে যা করা প্রয়োজন, সেটিই হওয়া উচিত মূল লক্ষ্য এবং প্রেক্ষাপট। অর্থাৎ শান্তির লক্ষ্য অর্জনের জন্য নিজের ঘরের চারপাশ থেকেই কাজ শুরু করতে হবে। আমাদের ভবিষ্যতের দিকে আলোকপাত করা উচিত। আমি মনে করি, সেটিকেই লক্ষ্য হিসেবে ধরে নেওয়া দরকার।

প্রশ্ন

হিরোশিমায় আণবিক বোমা হামলার ৭৮তম বার্ষিকী এগিয়ে আসছে। এ উপলক্ষে এই বিশৃঙ্খল সময়ে বিশ্বজুড়ে শান্তির লক্ষ্য অর্জনে আপনার ভাবনা কী?

কাজুমি মাৎসুই: আমি আগেও বহুবার বলেছি, প্রতীকী অর্থে ‘হিবাকুশা’ শব্দটি আমরা বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। এর প্রয়োজন এখনো শেষ হয়ে যায়নি। হিবাকুশারা সেই মানুষ, যাঁরা আণবিক বোমা হামলার শিকার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে যাঁরা বেঁচে আছেন, শান্তির লক্ষ্য অর্জনের জন্য, মানুষকে যেন সে রকম দুর্গতির মুখে আর পড়তে না হয়, সেটি নিশ্চিত করার জন্য, তাঁরা ভয়াবহ সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে চলেছেন। তাঁরা অহিংসার পথ অবলম্বন করছেন। মহাত্মা গান্ধী অহিংসার বাণী প্রচার করে গেছেন। অনেক ভাষণে আমি তাঁর উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছি। অহিংসার চেয়ে শক্তিশালী কোনো অস্ত্র সাধারণ মানুষের কাছে নেই। হিংসার পথে না গিয়ে শান্তির সংস্কৃতিই যে মানুষের অন্তর দিয়ে গ্রহণ করা উচিত, সে কথা আমি আরও বলিষ্ঠভাবে বলতে চাই।

প্রশ্ন

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, মেয়র মাৎসুই।

কাজুমি মাৎসুই: হিরোশিমা বার্ষিকীর প্রাক্কালে আমাদের শহরে এসে এই সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।