হাসিনা সরকারের নীতি পাহাড়ে এখনো বহাল আছে

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতি, আঞ্চলিক রাজনীতি, পাহাড়ের নিরাপত্তা—এসব বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) সংগঠক মাইকেল চাকমা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা

প্রশ্ন

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে, সে ব্যাপারে পাহাড়িদের অবস্থান কী? 

মাইকেল চাকমা: সারা দেশের জনগণের মতো পাহাড়িদের মধ্যে প্রথম দিকে কিছু আশাবাদ সৃষ্টি করলেও এখন তারা সতর্কতার সঙ্গে সরকারের পদক্ষেপগুলো বিচার করছে। আগস্ট অভ্যুত্থানের পর সমতলে যে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে, পাহাড়ে তার হাওয়া পৌঁছেনি। এখানে আগের মতোই নিপীড়নমূলক পরিস্থিতি জারি রয়েছে। তা ছাড়া উগ্র সাম্প্রদায়িকতা আবার নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। সম্প্রতি খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড়িবিরোধী দাঙ্গা তার প্রমাণ। মোটকথা, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে আগের সরকারি নীতির কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের নীতি পাহাড়ে এখনো বহাল রয়েছে। 

প্রশ্ন

পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক সহিংসতাকে কীভাবে দেখেন? এর পেছনে বিশেষ কোনো কারণ আছে কি? 

মাইকেল চাকমা: দশকের পর দশক ধরে অলিখিত সামরিক শাসন থাকার কারণে পাহাড়ে একটি কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে। তারা পাহাড়ে এই অবস্থা বজায় রাখতে চায়, কারণ এতে তাদের স্বার্থ আছে। কিন্তু ৫ আগস্টের পর পাহাড়ের ছাত্ররা বুঝতে পেরেছে যে তাদের পক্ষেও কিছু করা সম্ভব, তারা পাহাড়ে পরিবর্তন চায়। তাই তারা ‘সংঘাত ও বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলনের’ ব্যানারে সংগঠিত হচ্ছে। সমতলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গ্রাফিতি এঁকেছে। এতে বাধা দেওয়া হলে তারা আরও বেশি বড় সমাবেশ করেছে। তাদের এই সচেতনতা এবং ঐক্য ও পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা দেখে কায়েমি স্বার্থবাদী মহলটি শঙ্কিত হয়ে পড়েছে। তাই তারা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নস্যাৎ করতে সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলোকে মাঠে নামিয়ে দিয়েছে। পাহাড়ের সাম্প্রতিক সহিংসতার পেছনের মূল কারণ হলো এটাই। 

পাহাড়ে এ ধরনের পরিস্থিতি ১৯৯০-এর দশকে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের পরও দেখা গিয়েছিল। তখন সদ্য গঠিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ছাত্র-গণ-আন্দোলন রোধ করতে একইভাবে উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলোকে ব্যবহার করে দাঙ্গা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। 

প্রশ্ন

দেখা যাচ্ছে, পাহাড়ি-বাঙালি বিরোধের পাশাপাশি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যেও বিরোধ রয়েছে। এই সমস্যা দূর করা যাচ্ছে না কেন? আপনারা কেন ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারছেন না? 

মাইকেল চাকমা: পাহাড়িদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলার পেছনে মূলত তিনটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর পাহাড়িদের একটি অংশ আন্দোলন থেকে সরে যায়। তারা সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে ব্যক্তিগত আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, অনেক দলের গঠন ও বিকাশ ইউপিডিএফের মতো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হয়নি। ফলে তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মানসিকতা ও ভিন্নমত সহ্য করার সংস্কৃতি নেই। ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটা বড় ধরনের বাধা। তৃতীয়ত, শুরুতে যে স্বার্থান্বেষী মহলের কথা বলেছি, সেই মহলটি চায় পাহাড়িদের মধ্যে কোনো ঐক্য গড়ে না উঠুক। সব সময় অনৈক্য, হানাহানি ও সংঘাত থাকলে পাহাড়ে সব সময় তাদের কায়েমি স্বার্থ বজায় থাকে। 

প্রশ্ন

বিভিন্ন সংস্কারের মধ্য দিয়ে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে সরকার। এর সুফল পাহাড়ি জনগোষ্ঠী কীভাবে পেতে পারে?

মাইকেল চাকমা: সরকার বেশ কিছু বিষয়ে সংস্কারকাজ শুরু করেছে। এটা ভালো দিক। অন্তর্বর্তী সরকারকে আমরা স্বাগত জানিয়েছি এবং যৌক্তিক কর্মসূচিতে সমর্থন দেওয়ার কথা বলেছি। কিন্তু এই সংস্কার কর্মসূচিতে সরকার পাহাড়িদের অন্তর্ভুক্ত করছে না। যে সংস্কার হবে, তাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষারও প্রতিফলন থাকতে হবে, তা না হলে সেটা একপক্ষীয় ও অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমরা বিশেষত চাই সংবিধান সংস্কার কমিশনে পাহাড়িদের মধ্য থেকে একজন যোগ্য ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। সংবিধানে যদি আমাদের অস্তিত্বই স্বীকার করা না হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ রাজনৈতিক ও নৃতাত্ত্বিক স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিষয়টির উল্লেখ না থাকে, তাহলে আমাদের আগের মতোই অধিকারবঞ্চিত করে রাখা হবে।

আমরা চাই নতুন বাংলাদেশ হবে এমন একটি রাষ্ট্র, যেখানে কোনো একটি জাতি, যে যত সংখ্যাগরিষ্ঠই হোক, অন্য জাতিগুলোর ওপর আধিপত্য কায়েম করতে পারবে না, যে রাষ্ট্রে সব জাতিসত্তার সমানভাবে বিকাশ লাভের সুযোগ থাকবে। 

প্রশ্ন

এই সরকারে কাছে আপনাদের চাওয়া কী? 

মাইকেল চাকমা: অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে পাহাড়িদের চাওয়া অনেক। সহজে যে কাজগুলো সরকার করতে পারে, সেগুলো হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করা; পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের ভুল নীতিগুলো পরিত্যাগ করা; জনগণের অধিকার হরণের হাতিয়ার হিসেবে বিভিন্ন বাহিনীকে ব্যবহার করা থেকে সরে আসা; পাহাড়ে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড, কল্পনা চাকমা অপহরণসহ যত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর তদন্ত ও বিচার করা; অনেক দুর্বলতা ও অসম্পূর্ণ থাকা সত্ত্বেও ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগের সম্পাদিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’র শর্তগুলো মেনে চলা; এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করে পাহাড়ি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা।