আজ ২৩ জুন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ইতিহাসের এই পরিক্রমায় নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে দলটি। আওয়ামী লীগের সফলতা-ব্যর্থতা এবং বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ ড. মাহ্বুব উল্লাহ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাফসান গালিব
৭৫ বছরে আওয়ামী লীগ। দীর্ঘ এ পরিক্রমায় আওয়ামী লীগের সফলতা ও ব্যর্থতার জায়গাটি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মাহ্বুব উল্লাহ: ৭৫ বছর ধরে এ দেশের রাজনীতিতে অবদান রাখার জন্য আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের শুভেচ্ছা। পাশাপাশি বলব, দলটির দীর্ঘ এই পরিক্রমা নিয়ে একটি নির্মোহ মূল্যায়ন হওয়া উচিত।
ক্ষমতায় থেকে এবং ক্ষমতার বাইরে থেকে আওয়ামী লীগের ভূমিকা কী ছিল? আওয়ামী লীগ যখন যাত্রা শুরু করে, তখন যেসব সামাজিক শ্রেণির স্বার্থ প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করেছে, সেই একই শ্রেণির স্বার্থ কি তারা প্রতিফলন করছে?
আওয়ামী লীগ নিজেকে স্বাধীনতার দল ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব কতটা সুরক্ষিত থেকেছে?
এসব প্রশ্নকে আমরা দলটির সফলতা ও ব্যর্থতা বা মূল্যায়নের মাপকাঠি হিসেবে দেখতে পারি।
মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমানের মতো ব্যক্তিত্বের প্রেরণা ও নেতৃত্বে গঠন হওয়া দলটি এখন গণমানুষের চেতনাকে কতটা ধারণ করে?
মাহ্বুব উল্লাহ: পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার পর ক্ষমতাসীন দল মুসলিম লীগ বলতে শুরু করে, পাকিস্তান একটি শিশুরাষ্ট্র, এর কোনো সমালোচনা সহ্য করা হবে না। যারা সমালোচনা করবে, তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে স্বীকার করে না।
এ রকম একটা দমবন্ধ পরিস্থিতিতে দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির স্বার্থে মাওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ গঠনের উদ্যোগ নেন।
তখন সেটির নাম দিয়েছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। আওয়ামী মানে হচ্ছে জনগণের। মুসলিম লীগের বিপরীতে জনগণের মুসলিম লীগ।
শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাকদের মতো অপেক্ষাকৃত তরুণদের দিয়ে মাওলানা ভাসানী দলটি গঠন করেন। ভাসানীর যে বয়স, তার সঙ্গে তারুণ্যের চমৎকার একটি মেলবন্ধন তৈরি হয়েছিল।
দলটি প্রথম দিকে কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তের কথা এবং গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের কথা বলত। ফলে ধীরে ধীরে জনগণও দলটির প্রতি সাড়া দেয়।
মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন দেশের ক্ষমতা নিল আওয়ামী লীগ। সে সময় দেশে যে সংকট ও সমস্যা তৈরি হয়েছিল, সেগুলোকে সরকার রাজনৈতিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করেনি। সহমত ও ঐকমত্যের পথে না গিয়ে আওয়ামী লীগ একলা চলার নীতি নিয়েছিল।
একপর্যায়ে দলটি একদলীয় শাসনব্যবস্থাকেই বেছে নিল। এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের কারণে পঁচাত্তরে অনেক দুঃখজনক ও বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটেছে, তা আমরা জানি। এমন ঘটনা চাইলে কিন্তু সেসময় এড়ানো যেত। তারপরে তো আওয়ামী লীগ অনেক বছর ক্ষমতার বাইরে ছিল।
তারপর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসে। এরপর ক্ষমতার নানা পালাবদলে ২০০৯ সাল থেকে তারা এখনো ক্ষমতায়। গত ১৫ বছরে অর্থনৈতিক সংকট, মূল্যস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ব্যাংক ব্যবস্থায় ধসসহ নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে দলটি জনগণ থেকে দূরে সরে গেছে। তৈরি হয়েছে একটি অলিগার্ক গোষ্ঠী।
অথচ সাধারণ মানুষ, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত, গরিব মেহনতি মানুষের স্বার্থে দলটির যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেখানে এখন অলিগার্ক গোষ্ঠীর স্বার্থই প্রাধান্য পাচ্ছে। সামাজিক ন্যায়বিচার বলতেও এখানে কিছু থাকল না।
আওয়ামী লীগ একটা নিয়মতান্ত্রিক দল। নির্বাচনকেই ক্ষমতা পরিবর্তনের মূলমন্ত্র মনে করে। কিন্তু গত তিনটি নির্বাচনকে ঘিরে বিষয়টি কীভাবে দেখেন?
মাহ্বুব উল্লাহ: যেভাবেই হোক, ক্ষমতায় থাকাকেই আওয়ামী লীগ মুখ্য হিসেবে দেখছে। ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে গিয়ে এ দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা বলে যা ছিল, সেটিকে বিনষ্ট করে ফেলেছে।
সত্তরের পরে এখানে যত নির্বাচন হয়েছে, প্রতিটিই কোনো না কোনোভাবে ত্রুটিপূর্ণ ছিল। এরপরও নির্বাচনী ব্যবস্থা বলে একটা কিছু ছিল। কিন্তু এখন যে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে, তাতে কোনো বাহাদুরি বা আনন্দ আছে বলে আমার মনে হয় না।
একসময় সংবিধান পরিবর্তন একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল, এখন সংবিধান পরিবর্তন ছাড়াই সেই শাসনব্যবস্থা চলছে।
এই ব্যবস্থা সম্ভব হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে বাদ দেওয়ার কারণে। এভাবে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার রাজনীতি কখনো সুখকর হয় না।
অনেকে সমালোচনা করেন, আওয়ামী লীগের রাষ্ট্র পরিচালনায় আমলাতান্ত্রিক নির্ভরতা তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক দল ও প্রশাসন মিলেমিশে গেছে। এ ব্যাপারে আপনার মত কী?
মাহ্বুব উল্লাহ: একটি দল যখন ক্ষমতায় থাকবে, সে তখন জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা শুনবে, সে অনুযায়ী দেশ চালাবে।
সাংগঠনিকভাবেও জনগণের স্বার্থকেই গুরুত্ব দেবে। এখন তা না করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে রাষ্ট্রযন্ত্রের যাদের তুষ্ট করা বা রাখার দরকার, তা করা হচ্ছে। সেখানে আমলাতন্ত্র ও অলিগার্ক গোষ্ঠীর মধ্যে একটি জোট তৈরি হয়েছে।
আওয়ামী লীগ এখন সেই জোটনির্ভর হয়ে গেছে। এর থেকে বেরিয়ে আসতে তার জন্য সহজ হবে না।
বিরোধী দলে থাকলে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে যতটা শক্তিশালী ও কার্যকর, ক্ষমতায় থাকলে ততটা নয়। আপনি কী মনে করেন?
মাহ্বুব উল্লাহ: এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় কুর্ট মোরাক ইয়ানসেন নামের একজন ড্যানিশ গবেষক আমাকে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকলে সুন্দর আর ক্ষমতায় গেলে অসুন্দর।
১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তাদের যে আন্দোলন ও সংগ্রাম, তা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। যদিও সে সময় তাদের আন্দোলনের কিছু ব্যাপার গণতান্ত্রিক আচরণ বা ব্যাকরণের মধ্যে পড়ে না।
তবে আওয়ামী লীগের সৌভাগ্য হচ্ছে, এখন বিরোধী দলের ওপর যে রকম দমন–নিপীড়ন চলছে, তাকে সেই মাত্রায় দমন-নিপীড়ন সহ্য করতে হয়নি। তারাও দমন–নিপীড়ন সহ্য করেছে। তবে এখন তা সীমার বাইরে চলে গেছে।
অনেকটা বিরোধী রাজনীতিশূন্য পরিবেশ দেখছি আমরা। ফলে রাজনৈতিক বিরোধটা আওয়ামী লীগের ভেতরেই দেখছি। নিজ দলের ভেতরে আধিপত্য বিস্তারের জন্য লড়াই দেখছি।
মাহ্বুব উল্লাহ: বিরোধী রাজনীতিশূন্য কথা ঠিক নয়। বিরোধী রাজনীতি আছে, তবে নিষ্প্রভ। তাদের পক্ষে মাথা তুলে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
এখন যারা ক্ষমতায় আছে, তারা মনে করছে দেশে বিরোধী রাজনীতি বলতে কিছু নেই, তাদের চ্যালেঞ্জ করার মতো শক্তি নেই; তখন তারা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বা বিরোধে লিপ্ত হচ্ছে। খুনখারাবির মতো ঘটনা ঘটছে।
একটি দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে যদি কোনো চ্যালেঞ্জ না থাকে বা চ্যালেঞ্জ অনুভূত না হয়, সেখানে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। যেভাবে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধীদের দমন করছে, সেটি বুমেরাং হয়ে তার নিজের মধ্যে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তা তাদের কমজোরি করে ফেলছে।
এ জন্যই তা আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
মাহ্বুব উল্লাহ: আপনাকেও ধন্যবাদ।