৪ নভেম্বর ছিল প্রথম আলোর ২৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তা সম্পাদক ও সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও রাফসান গালিব
প্রথম আলো: এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সংবাদপত্র তথা সংবাদমাধ্যমের চ্যালেঞ্জগুলো কী?
দেওয়ান হানিফ মাহমুদ: ব্রিটিশ আমল থেকেই আমাদের সাংবাদিকতার একটা গৌরবের ইতিহাস আছে। পাকিস্তান আমলে এটি জাতিরাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষায় রূপ নেয়। আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় পর্যন্ত যে সাংবাদিকতা ছিল; এখনকার সাংবাদিকতা তা থেকে অনেকটা ভিন্ন। সারা বিশ্বেই সাংবাদিকতা এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। আমাদের এখানে মুদ্রিত পত্রিকা, টেলিভিশন ও অনলাইন পোর্টাল সংখ্যায় অনেক বেড়েছে। এত সংবাদমাধ্যম পৃথিবীর আর কোনো দেশে আছে কি না সন্দেহ। কিন্তু সাংবাদিকতার মূল কাজ যে ক্ষমতাবানদের প্রশ্ন করা, সেই ক্ষমতা মোটেই বাড়েনি। খুবই কমসংখ্যক সংবাদমাধ্যম সঠিক তথ্য তুলে ধরতে পারছে। সাংবাদিকতায় বলিষ্ঠ নেতৃত্বের ঘাটতি রয়েছে। একজন দক্ষ ও সাহসী সম্পাদকই সংবাদপত্রকে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে এগিয়ে নিয়ে যান এবং সাংবাদিকতার অঙ্গীকার পূরণে ভূমিকা রাখেন।
প্রথম আলো: নব্বইয়ের আগের ও পরের সাংবাদিকতায় মৌলিক কোন পার্থক্যের কথা বলবেন।
দেওয়ান হানিফ মাহমুদ: একসময় সংবাদমাধ্যমকে দেখা হতো সামাজিক পণ্য বা সোশ্যাল গুডস হিসেবে। পত্রিকাগুলোর আয়ের মূল উত্স ছিল সরকারি বিজ্ঞাপন। নব্বইয়ের পর বেসরকারি খাত থেকে আয় করে যে সফল গণমাধ্যম করা যায়, তার একাধিক উদাহরণ আছে। ২০০০ সালের পর থেকে বেসরকারি খাতের দ্রুত বিকাশ ঘটেছে। যেসব সংবাদমাধ্যম ভালো সাংবাদিকতা করে, ব্যবসায়িক মহলে তাদের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। ভালো সাংবাদিকতা ও ভালো ব্যবসা একে অপরের পরিপূরক। যেসব সংবাদমাধ্যম সরকারি বিজ্ঞাপন বা বিশেষ ব্যবসায়ী গ্রুপের বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীল, তাদের পক্ষে ভালো সাংবাদিকতা করা সম্ভব নয়। গণমাধ্যমে বা সংবাদপত্রে স্বাধীনতা ভোগ করতে চাইলে তার আর্থিক স্বাধীনতাও থাকতে হবে। আমি বলব, এটাই বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রথম আলো: কিন্তু পত্রিকা বা বেসরকারি টেলিভিশনের সংখ্যা বৃদ্ধিকেই সরকার সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বলে দাবি করছে?
দেওয়ান হানিফ মাহমুদ: স্বাধীনতার বিষয়টি আপেক্ষিক। সংবাদমাধ্যম তথ্যটি ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারছে কি না সেটাই আসল কথা। আমি যদি সকালে ব্যাংকক পোস্ট বা সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট পড়ি, সেখানে দেখি, কর্তৃত্ববাদী শাসনের মধ্যেও তারা জোরালোভাবে প্রশ্নটা করতে পারছে। আমি মনে করি, স্বাধীনতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো আমরা সাংবাদিকতা সঠিকভাবে করতে পারছি কি না বা করতে চাইছি কি না। উন্নত দেশগুলোতেও সাংবাদিকদের ওপর রাষ্ট্র ও সরকারের চাপ আছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেক সাংবাদিককে হোয়াইট হাউস থেকে বের করে দিয়েছিলেন। সাংবাদিকেরা আদালতে গিয়ে তঁাদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমাদের পূর্বসূরিরা কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। সাংবাদিকতার স্বাধীনতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো সাংবাদিকতাটা ঠিকমতো হচ্ছে কি না।
প্রথম আলো: তার মানে আপনি বলতে চাইছেন স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের মূল বাধাটা বাইরের নয়, ভেতরেই?
দেওয়ান হানিফ মাহমুদ: আমি বলব, নব্বইয়ের পর যেসব সংবাদমাধ্যম এসেছে, আগের সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে তাদের চিন্তাচেতনার বড় পার্থক্য আছে। আগে যে উদ্দেশ্যে পত্রিকা বা সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করা হতো, এখনকার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি এখানে সাহসের চেয়ে সক্ষমতার বিষয়টি সামনে আনতে চাইছি। আর সেটি কেবল সংবাদমাধ্যম নয়, শিক্ষার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে কিন্তু তারা দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারছে না। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় হলো ব্যাক টু বেসিক—সাংবাদিকতাটা করা। আমার মনোজগতে সাংবাদিকতার জায়গায় অন্য কিছু থাকলে সাংবাদিকতা এগোবে না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নানা আইনি বাধা আছে। তার চেয়েও আমি মনে করি আমাদের মনোজাগতিক বাধাটা আরও বড়। অনেক ক্ষেত্রে আমরা সেলফ সেন্সরশিপ করি। আইনি বাধা তো অতীতেও ছিল। আমি বলব, সংখ্যায় বাড়লেও আমরা অনেকেই সাংবাদিকতাকে মনেপ্রাণে ধারণ করছি না। ফলে সংখ্যায় বাড়লেও গুণমানে বাড়েনি। পেশার প্রতি আমাদের অঙ্গীকারে ঘাটতি আছে।
প্রথম আলো: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ছাড়াও সরকার আরও অনেকগুলো আইন করার উদ্যোগ নিয়েছে, সম্পাদক পরিষদ কী করছে?
দেওয়ান হানিফ মাহমুদ: সম্পাদক পরিষদ প্রতিটি বিষয়েই প্রতিবাদ করছে। সরকার সংবাদমাধ্যম–সংশ্লিষ্ট যতগুলো আইন করেছে বা করার উদ্যোগ নিয়েছে, অন্য কোনো বিষয়ে এত আইন করেনি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সম্পাদক পরিষদের পক্ষ থেকে আমরা যেসব উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলাম, পরবর্তীকালে সেটি সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। আইনমন্ত্রী কথা দেওয়ার পরও আইনের অপব্যবহার বন্ধ হয়নি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনেক ধারা জামিনযোগ্য নয়। এটা নিবর্তনমূলক আইন। ধরে নিলাম একজন সাংবাদিক তাঁর পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রাষ্ট্রের আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এমন কিছু ঘটেছে। তাই বলে তিনি জামিন পাবেন না কেন? আমাদের সংবিধানের সৌন্দর্য হলো নাগরিকের মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দ্বারা সেই অধিকার খর্ব করা হয়েছে।
প্রথম আলো: সম্পাদক হিসেবে আপনি কতটা স্বাধীনতা ভোগ করছেন? যা ভাবেন তা লিখতে ও বলতে পারছেন কি?
দেওয়ান হানিফ মাহমুদ: তথ্যের সঠিকতা নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশে এখনো সাহসী সাংবাদিকতার সুযোগ আছে। সঠিক তথ্য দিয়েই যেকোনো বাধা মোকাবিলা করা যায়। আবার যদি বলেন, শতভাগ স্বাধীনতা ভোগ করছি, তা–ও না।
প্রথম আলো: সম্পাদক পরিষদ কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে?
দেওয়ান হানিফ মাহমুদ: সম্পাদক পরিষদের যাত্রা শুরু ২০১৩ সালে, যখন সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আমরা মনে করেছি, এটি সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার জন্য বড় হুমকি হবে। আমাদের সাফল্য হলো তখন সংগঠন হিসেবে আমরা যা বলেছি, এখন দেশের ভেতরে সবাই সে কথা বলছে। দেশের বাইরেও এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। সরকারের মন্ত্রীরাও এর দুর্বলতা ও ত্রুটির কথা স্বীকার করছেন।
প্রথম আলো: মুদ্রিত পত্রিকার ভবিষ্যৎ কী? বাংলাদেশসহ সব দেশেই মুদ্রিত পত্রিকার প্রচারসংখ্যা কমে গেছে।
দেওয়ান হানিফ মাহমুদ: ২০ বছর আগে আমরা গণমাধ্যম বলতে সংবাদপত্রকেই বুঝতাম। এখন ডিজিটাল মাধ্যমের যুগ। আমরা যারা মুদ্রিত সংবাদমাধ্যমে কাজ করি, এই বাস্তবতা স্বীকার করে নিতে হবে। খবরের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমেনি। তরুণেরা ডিজিটাল মাধ্যমের দিকে ঝুঁকছেন। ফলে মূলধারার সংবাদমাধ্যমকে অনলাইন, অডিও ভিডিওকে অগ্রাধিকার দিতে হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একটি বৈশ্বিক বাস্তবতা এবং এটি মূলধারার সংবাদমাধ্যমকে ঝাঁকুনি দিয়েছে। ফলে আমাদের নিজেদের অনেক বেশি সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। মতপ্রকাশের পরিধি যেমন বেড়েছে, তেমনি নজরদারির আওতাও বেড়েছে। এসবের মধ্যেই সংবাদমাধ্যমকে টিকে থাকতে হবে এবং পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে।
প্রথম আলো: প্রথম আলোর দুই যুগ পূর্তি গেল ৪ নভেম্বর। এর সফলতা-ব্যর্থতা কীভাবে দেখছেন।
দেওয়ান হানিফ মাহমুদ: প্রথম আলোর শক্তির জায়গাটা যেমন বেশি, তেমনি চ্যালেঞ্জও বেশি। প্রথম আলো বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় একটি বড় পরিবর্তন এনেছে। একসময় রাজনীতি করতে গিয়ে তরুণেরা সাংবাদিকতায় আসতেন সরকারি বা ব্যাংকে চাকরি করবেন না বলে। পেশাগত প্রতিযোগিতার সুযোগ তৈরির মধ্য দিয়ে প্রথম আলো সাংবাদিকতায় একটি নতুন চেহারা দিয়ে যাত্রা শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া বিভিন্ন বিভাগের চৌকস ছেলেমেয়েরা সাংবাদিকতায় সম্পৃক্ত হতে থাকেন। প্রথম আলোর অন্যতম মূল শক্তি এর সম্পাদক মতিউর রহমান। স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে তাঁর মতো শক্তিশালী সম্পাদক আমরা আর পাইনি। মতিউর রহমানের বড় অবদান হচ্ছে অনেক দক্ষ ও মেধাবী তরুণকে সাংবাদিকতায় আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন। আমি প্রথম আলোতে কাজ না করে অন্য কোনো সংবাদমাধ্যমে কাজ করলে হয়তো আজ যে অবস্থায় আছি, সেখানে আসতে পারতাম না। সাংবাদিকতার সূক্ষ্ম বিষয়গুলো শেখার সুযোগ পেতাম না। প্রথম আলোর চ্যালেঞ্জ যদি বলেন, যে অঙ্গীকার নিয়ে যাত্রা তারা শুরু করেছে, সেটাকে ধরে রাখা। আমাদের এ অঞ্চলে কোনো পত্রিকা শতবর্ষ পূরণ করেনি। দুই যুগ বয়সী প্রথম আলোকে শতবর্ষী পত্রিকা হওয়ার সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। প্রথম আলো যে সম্ভাবনা ও শক্তি তৈরি করেছে, সেটি ধরে রাখা এবং এগিয়ে নেওয়াই হবে তাদের বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
দেওয়ান হানিফ মাহমুদ: আপনাদেরও ধন্যবাদ।