বিশেষ সাক্ষাৎকার : তাসনীম সিরাজ মাহবুব

নতুন দলেও কিছু পুরোনো প্রবণতা দেখা যাচ্ছে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসনীম সিরাজ মাহবুব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন শেষে তিন দশকের বেশি সময় ধরে শিক্ষকতায় নিয়োজিত আছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিস্থিতি, অভ্যুত্থান–পরবর্তী নারীর অবস্থা, নতুন দলের প্রতি প্রত্যাশা ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনজুরুল ইসলাম

প্রশ্ন

গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারের প্রতি মানুষের যে প্রত্যাশা ছিল, সাত মাস পর এসে সেই প্রত্যাশা কতটা পূরণ হয়েছে বলে মনে করেন?

তাসনীম সিরাজ মাহবুব: এককথায় বা সরাসরি এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। মোটাদাগে যদি বলি, একদম যাঁরা সাধারণ জনগণ, তাঁদের প্রত্যাশা ছিল এক রকম। তাঁরা কাজকর্ম করে যা-ই আয়-উপার্জন করেন, সেটা দিয়ে একটু শান্তিতে জীবন যাপন করতে চেয়েছিলেন। দ্রব্যমূল্য বা জিনিসপত্রের দাম নাগালের মধ্যে থাকবে, এটা হয়তো সব মানুষেরই চাওয়া ছিল। এই চাওয়াগুলোর কিছুটা পূরণ হয়েছে। আবার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই ও চাঁদাবাজির কারণে কিছুটা পূরণ হয়নি।

অন্যদিকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির কারও কারও কাছে বাক্‌স্বাধীনতা বা কথা বলার স্বাধীনতা ছিল একটা বড় বিষয়। এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু উন্নতি হয়েছে বলে আমার মনে হয়। বিগত সরকারের আমলে যাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে বিভিন্ন অপরাধ করেছিলেন, তাঁদের বিচারের একটা দাবি ছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেগুলো নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এগুলো শেষ পর্যন্ত কোন দিকে যায়, সেটা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

সবচেয়ে বড় যে বিষয় সেটা হলো, বিগত সরকার দেশটাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেই গতিমুখ থেকে দেশটাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর ওপর আমার এখনো আস্থা বা ভরসা আছে। অন্য শাসকদের মধ্যে ক্ষমতার পাশাপাশি যেমন অর্থবিত্তের লোভ দেখা গেছে, তাঁর মধ্যে সেই অর্থবিত্তের লোভ নেই বলেই আমার ধারণা। তবে তিনিও মানুষ, তাঁরও ভুল হতে পারে। ভুল হলে তা সংশোধন করে তিনি বাংলাদেশকে সঠিক পথে এগিয়ে নেবেন, একজন আশাবাদী মানুষ হিসেবে আমি সেটাই মনে করি।

প্রশ্ন

বিগত স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর অনেক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে রদবদল হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, সহ–উপাচার্যসহ প্রশাসনিক পদগুলোতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এই পরিবর্তনগুলোর ক্ষেত্রে কি কোনো রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করেছে? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার পরিবেশ এখন কেমন? 

তাসনীম সিরাজ মাহবুব: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে বেশির ভাগ নিয়োগ যে রাজনৈতিক বিবেচনায় হয়েছে, সেটা যেকোনো রাজনীতিসচেতন ব্যক্তিই বুঝতে পারবেন। আপাতদৃষ্টে এঁদের অনেককে নিরপেক্ষ মনে হতে পারে, কিন্তু অতীত কর্মকাণ্ড দেখলে এঁদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়। এঁদের মধ্যে কিছু ব্যক্তি সরাসরি যুক্ত ছিলেন। কারও আবার সরাসরি যুক্ততা না থাকলেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। আমার বিবেচনায়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে এক-দুটি ছাড়া বেশির ভাগই রাজনৈতিক বিবেচনায় হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের এ সিদ্ধান্ত আমাদের সত্যিই হতাশ করেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে কথা বলতে গেলে পাবলিক ও প্রাইভেট—দুই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই বলতে হবে। এবার ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ঢাকাভিত্তিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান ব্যাপক। তাদের অনেক শিক্ষার্থী শহীদ হয়েছেন, অনেকে আহত হয়েছেন। ৫ আগস্টের পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাঁদের পড়াশোনা বা একাডেমিক কাজে ফিরে গেছেন। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা দেখা গেছে। আমি যদি উদাহরণ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলি, এখানে একাডেমিক কাজের চেয়ে এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিজ বেশি হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আগে ছাত্রলীগের একক দখলদারি ছিল, এখন অন্য ছাত্রসংগঠনগুলো নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে।

এ ছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছাত্রদের কিছু গ্রুপ এখতিয়ারবহির্ভূত কিছু কাজ, যেমন ক্লাস-পরীক্ষার রুটিন, উপস্থিতি—এগুলো নিয়েও কথাবার্তা বলছে। এসব ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। সব মিলিয়ে বলব, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশের উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি হয়নি। এ বিষয়গুলো আমার কাছে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগের একটি নেতিবাচক ফলাফল বলে মনে হচ্ছে।

প্রশ্ন

কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভবন ও স্থাপনার নাম পরিবর্তন নিয়ে জনমনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাদ পড়েছে প্রখ্যাত রসায়নবিদ ও শিক্ষক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, পদার্থবিজ্ঞানী ও শিক্ষক সত্যেন্দ্রনাথ বসু, কবি জীবনানন্দ দাশ, পদার্থবিদ ও জীববিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর মতো মনীষীদের নাম। অন্যদিকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু হলের নাম এখন শাহ আজিজুর রহমান হল। এই পরিবর্তনগুলো কীভাবে দেখছেন?

তাসনীম সিরাজ মাহবুব: শেখ হাসিনা ও তাঁর আত্মীয়স্বজনের নামে যে ভবন, স্থাপনাগুলো ছিল, সেগুলোর নাম পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল বলে আমি মনে করি। এটাকে আমি ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি। কিন্তু যাঁদের নাম থাকা উচিত, যাঁরা নিজেদের কাজের জন্য বিখ্যাত, সেই সব বিজ্ঞানী, দার্শনিক, শিক্ষকদের নাম বাদ দেওয়া কি আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল? এগুলো খুবই নিন্দনীয় সিদ্ধান্ত হয়েছে। কারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আমরা তা জানতে চাই। আরেকটা বিষয় হলো, নাম বদলে বিতর্কিত লোকদের নাম দেওয়া, যেমন শাহ আজিজুর রহমান। ১৯৭১ সালে ওনার ভূমিকা আমরা জানি। এ ধরনের পরিবর্তনগুলো দেখে মনে হয়, যাঁরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাঁদের কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে।

প্রশ্ন

জুলাই–আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানে আমরা নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ দেখেছিলাম। অভ্যুত্থানের পরপর মনে হলো, নারীরা অনেকটাই ‘অদৃশ্য’ হয়ে গেছেন। এরপর সারা দেশে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন কিংবা নারীর নিপীড়নের খবরগুলো আসতে থাকল। অভ্যুত্থানের পরও নারীরা কেন এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন?

তাসনীম সিরাজ মাহবুব: নারীদের যা প্রাপ্য, তাঁরা সেটা পেয়েছেন, আমাদের দেশের ইতিহাসে এ রকম উদাহরণ নেই বললেই চলে। আমরা হয়তো একজন তারামন বিবি বা সিতারা বেগমের নাম জানি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ নারী বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছিলেন। তাঁদের সবাইকে কি আমরা প্রাপ্য সম্মান দিতে পেরেছি?

বাংলাদেশে ধর্ষণ ও নারী নিপীড়ন সব সময়ই ছিল। এটা হুট করে বেড়ে গেছে, তেমনটা বলা যাবে না। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, সামাজিক অস্থিরতা এবং রক্ষণশীল ধর্মীয় গ্রুপগুলোর কর্মকাণ্ডে নারীদের মধ্যে একধরনের ভীতি দেখা যাচ্ছে। গণ–অভ্যুত্থানের পরও এ রকম পরিবেশ তৈরি হওয়া একটা দুঃখজনক বিষয়। এবারের গণ–অভ্যুত্থানে নারী–পুরুষ সবাই অংশ নিয়েছিলেন। এ অভ্যুত্থান শুধু ছাত্রদের ছিল না, ছিল ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান। কিন্তু এখন রাজনৈতিক–সামাজিক পরিসরে নারী এবং সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ অনেকটাই সীমিত হয়ে পড়েছে।

প্রশ্ন

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন কর্মী যৌন হয়রানিমূলক আচরণ করেছিলেন। ফলে তাঁকে আটক করে শাহবাগ থানায় নেওয়া হয়েছিল। সেই সময় একদল লোক থানায় গিয়ে নানা রকম কাণ্ড ঘটান। পরবর্তী সময়ে সেই ব্যক্তি আদালত থেকে জামিন পান এবং তাঁকে একরকম সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে পুরো ঘটনাকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

তাসনীম সিরাজ মাহবুব: এ ঘটনায় জড়িত দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের—একজন শিক্ষার্থী, অপরজন কর্মচারী। মেয়েটা যেভাবে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে তার অভিযোগ তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা খুবই প্রশ্নবিদ্ধ। যে শিক্ষকেরা মেয়েটাকে আশ্বস্ত করতে পারতেন, সাহস দিতে পারতেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। 

আর শাহবাগ থানার ভেতরে যা ঘটেছে, সেটা খুবই নিন্দনীয়। কিছু কিছু গ্রুপ যে রকম আচরণ করছে, তাতে মনে হচ্ছে, তারা আইনের ঊর্ধ্বে চলে গেছে। তারা ধারাবাহিকভাবে এ রকম কাজ করে যাচ্ছে, কিন্তু সরকারের তরফ থেকে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে না। আমরা তাদের ‘মব’ বলে অভিহিত করছি; কিন্তু এ ধরনের মবেরও একটা আইডেন্টি (পরিচয়) রয়েছে। তাদের সেই পরিচয় উদ্‌ঘাটন করা এবং জরুরি ভিত্তিতে থামানো সরকারের এখন অন্যতম দায়িত্ব বলে আমি মনে করি।

প্রশ্ন

অন্তর্বর্তী সরকারের কোন বিষয়টি আপনার কাছে সবচেয়ে ইতিবাচক বলে মনে হয়েছে?

তাসনীম সিরাজ মাহবুব: এ ক্ষেত্রে আমি দেশের ইমেজ বা ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের কথা বলব। স্বৈরাচারী আমলে দেশের ইমেজ প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেই ইমেজ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। উনি সর্বজনগ্রাহ্য একজন ব্যক্তি। এ মুহূর্তে তাঁর কোনো বিকল্প নেই। ওনার কাছে আমাদের প্রত্যাশাও অনেক বেশি। কিন্তু উনি একা তো সবকিছু করতে পারবেন না। তাঁর সহকর্মীরা; অর্থাৎ অন্য উপদেষ্টারা ঠিকমতো কাজ করছেন কি না, সেটা বিবেচনায় রাখতে হবে। যাঁরা কাজ করছেন না কিংবা ব্যর্থ, তাঁদের সরিয়ে নতুন লোক নিয়োগ দিতে হবে।

প্রশ্ন

জুলাই–আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানে যেসব ছাত্র নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের একটা অংশ জাতীয় নাগরিক পার্টি নামে নতুন একটি দল গঠন করেছে। এই দল সম্পর্কে আপনার মূল্যয়ন কী?

তাসনীম সিরাজ মাহবুব: বাংলাদেশে কয়েক দশক ধরে আমরা দুটি দলের প্রাধান্য দেখেছি। পরিবারতন্ত্র, দুর্নীতি, জবাবদিহির অভাব—তাদের মধ্যে এ বিষয়গুলো আমরা লক্ষ করেছি। ফলে নতুন একটি দল, বিশেষভাবে তরুণদের দলকে আমি স্বাগত জানাই। তবে নতুন দলেও কিছু পুরোনো প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এর মধ্যে সরকারের আনুকূল্য পাওয়া এবং সম্পদশালীদের কাছ থেকে দলের জন্য টাকা নেওয়ার বিষয়ে যে কথাবার্তা উঠেছে, তাতে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। আমি আশা করি, এসব বিষয়ে তারা নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করবে।

প্রশ্ন

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

তাসনীম সিরাজ মাহবুব: আপনাকেও ধন্যবাদ