জেড আই (জহিরুল ইসলাম) খান পান্না। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি ও ব্লাস্টের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। এসব সংগঠনের পক্ষে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে তিনি আইনি লড়াই করেছেন, এখনো করছেন। বিএনপির সমাবেশ কর্মসূচিকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ অভিযান, দলটির নেতা–কর্মীদের গায়েবি মামলায় গ্রেপ্তার, তাঁদের প্রতি সংবিধান ও আইন পরিপন্থী আচরণ এবং এ সংক্রান্ত আদালতের নির্দেশনা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন এই আইনজীবী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: মনজুরুল ইসলাম।
গত মঙ্গলবার গাজীপুরে ‘গায়েবি’ মামলার কারাবন্দী বিএনপি নেতা আলী আজম মায়ের জানাজায় অংশ নিতে প্যারোলে মুক্তি পান। তাঁকে হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় জানাজায় অংশ নিতে দেখা যায়। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ঘটনা নিয়ে নানা রকম আলোচনা হচ্ছে। আইনের দৃষ্টিতে এর ব্যাখ্যা কী?
জেড আই খান পান্না: এই ঘটনা খুবই অমানবিক। একই সঙ্গে আমাদের সংবিধান, আইন ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরিপন্থী। হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় জানাজায় অংশ নিতে বাধ্য করার ঘটনায় স্পষ্টতই ওই ব্যক্তির মানবাধিকারেরও চরম লঙ্ঘন হয়েছে। আইন অনুযায়ী, যেকোনো আসামি বা অভিযুক্ত, এমনকি দণ্ডপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তির সঙ্গেও এমন আচরণ করার কোনো সুযোগ নেই।
তিনি (আলী আজম) কোন রাজনৈতিক দলের কর্মী বা নেতা, কোন মামলার আসামি—এসব এখানে বিবেচ্য বিষয় নয়। এর আগে তাঁর চেয়ে অনেক গুরুতর অভিযোগে আটক এবং দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির ক্ষেত্রে হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি না পরানোর অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। তাহলে তাঁর ক্ষেত্রে কেন এ রকম হবে? প্রয়োজন হলে সেখানে আরও বেশিসংখ্যক পুলিশ পাঠানো যেত। কিন্তু সেটা না করে এভাবে হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি পরানো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
জানাজার সময় আলী আজমের হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি খুলে দেওয়ার জন্য তাঁর স্বজন ও এলাকাবাসীরা অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাঁদের সেই কথায় পাত্তা দেয়নি। এ ঘটনাকে কীভাবে দেখছেন?
জেড আই খান পান্না: শুধু পুলিশ নয়, কারা কর্তৃপক্ষসহ এ ঘটনার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁরা সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন, আইন ভঙ্গ করেছেন। একই সঙ্গে তাঁরা এ রকম একটি অমানবিক ঘটনার মাধ্যমে মানবাধিকারেরও লঙ্ঘন করেছেন। এ জন্য এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেকের শাস্তি হওয়া উচিত। যদি তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এ রকম ঘটনা আরও ঘটার আশঙ্কা থাকবে। আজ হয়তো বিএনপির এক কর্মী বা নেতার ক্ষেত্রে এ রকম ঘটনা ঘটেছে, ভবিষ্যতে অন্য দল বা সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও একই রকম হতে পারে। তাই এ ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে এর আগেও বিভিন্ন সময় অমানবিক আচরণের অভিযোগ উঠেছে। এর কারণ কী মনে করেন?
জেড আই খান পান্না: আমাদের বিচার বিভাগ, ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা, পুলিশ, কারাগার—সবকিছুই তৈরি হয়েছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে। আমরা স্বাধীনতা লাভ করলেও এগুলোর তেমন কোনো সংস্কার হয়নি। ঔপনিবেশিক আমলের আইনগুলো দ্বারাই প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো চলছে। এ কারণে আইন-কানুন, পুলিশ, বিচারব্যবস্থায় এখনো ঔপনিবেশিক ধারণাগুলোই কাজ করে।
ঔপনিবেশিক আমলে ওই সব প্রতিষ্ঠান ও আইন তৈরিই করা হয়েছিল মানুষকে শাসন-শোষণ, দমন-পীড়ন করার জন্য। পুলিশের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো সেই ধারায় চলছে। নাগরিকের অধিকার, মানবাধিকার—এসব নিয়ে তাদের খুব বেশি বোঝাপড়া আছে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া বিভিন্ন আমলেই পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। সবকিছু মিলে জবাবদিহির ক্ষেত্রে বিশাল এক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। জবাবদিহি ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করা যায় না।