আনু মুহাম্মদ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও সর্বজনকথা পত্রিকার সম্পাদক। নাগরিকদের অধিকার রক্ষায় গঠিত গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য। কথা বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন উপলক্ষে এর সাফল্য-ব্যর্থতা এবং ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান–পরবর্তী জন–আকাঙ্ক্ষা নিয়ে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও সারফুদ্দিন আহমেদ
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১০০ দিন পূরণ হলো। সব দিক থেকে তাদের কাজকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন।
আনু মুহাম্মদ: নব্বইয়ের গণ–অভ্যুত্থানের সময় একটি পরিকল্পনা ছিল। তিন জোটের রূপরেখা ছিল। আমরা কোথায় যাচ্ছি, তা পরিষ্কারভাবে জানা ছিল। কিন্তু এবারের গণ-অভ্যুত্থানের সময় সরকার পতনের পর কী হবে, তার কোনো পরিষ্কার চিত্র ছিল না। তবে সমাজের মধ্যে একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সে আকাঙ্ক্ষার মূল কথাটা হচ্ছে, আমরা বিগত সরকারগুলোর মতো সরকার আর চাই না। এই আকাঙ্ক্ষাগুলো সারসংক্ষেপ করে একটি বাক্য জনপ্রিয় হয়েছে। সেটি হলো, ‘বৈষম্যহীন বাংলাদেশ চাই।’ বৈষম্যহীন বাংলাদেশ চাই এবং আগের মতো সরকার চাই না—এই পরিপ্রেক্ষিতকে বিচার করে অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ নির্ধারণ করার প্রয়োজন ছিল।
আমরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক থেকে গত ৪ আগস্ট, শেখ হাসিনার পতনের আগের দিন একটি অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা দিয়েছিলাম। সেখানে আমরা বলেছিলাম, হাসিনার সরকারের আর কোনো কার্যকারিতা নেই। কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। এখন একটি অন্তর্বর্তী সরকার আসতে হবে। গণতান্ত্রিক একটি রূপান্তর আনতে হবে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য কী কী করণীয়, সেখানে আমরা ব্যাখ্যা করেছিলাম। তারপর আমরা গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি থেকে ১৩ দফা দিয়েছি। অন্যদিকে সরকারের দিক থেকেও অনেক প্রতিশ্রুতি ছিল। গত তিন মাসে সরকার কিছু কাজ করেছে, যা করা উচিত ছিল। যেমন বেশ কিছু বিষয়ে কমিশন হয়েছে।
এই সরকারে থাকা লোকজনের মুখে যদি আমরা আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের ভাষায় কথা শুনি, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের মতো তারা যদি যেকোনো জায়গায় সাধারণ মানুষের ওপর আক্রমণ করে, তাদের যদি আমরা বিভিন্ন জায়গায় ভাঙচুর করতে দেখি, ‘বন্ধ করে দেব’, ‘উঠিয়ে দেব’, ‘করতে দেব না’—এ ধরনের ভাষা শুনি, তাহলে তা দুঃখজনক
কিন্তু এ সময়ে সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা কীভাবে নিরূপণ করবেন?
আনু মুহাম্মদ: আমরা জানি, আগের সরকারের মধ্যে লুটপাট ও সম্পদ পাচারের বড় প্রবণতা ছিল। ভয়ংকরভাবে ছিল। অভূতপূর্ব মাত্রায় লুটপাট হয়েছে। সেটি খতিয়ে দেখতে একটা কমিশন হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে কমিশন হয়েছে। সংবিধান নিয়ে কমিশন হয়েছে। জ্বালানি-বিদ্যুৎ খাতে কী ধরনের অনিয়ম হয়েছে, তা দেখতে কমিশন হয়েছে। এসব কমিশন গঠন একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তারপর এই সরকার দায়মুক্তি আইন স্থগিত করেছে। সেটিও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এরপর সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল করার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছে। এগুলো ইতিবাচক কাজ বলে আমি মনে করছি। আবার এ সময়ে কিছু ক্ষেত্রে অনেকটা ১৯৭২ সালের মতো, কিংবা ১৯৯১ সালের মতো একধরনের আশাভঙ্গের মতো ব্যাপার ঘটেছে।
সরকারের ব্যর্থতার মধ্যে একটা হচ্ছে, এখন পর্যন্ত যারা জীবন দিল এবং যারা জখম হয়ে হাসপাতালে পড়ে আছে, তাদের তালিকা এই তিন মাসেও চূড়ান্ত হয়নি। বিভিন্নভাবে, বিচ্ছিন্নভাবে কিছু টাকাপয়সা দেওয়া হচ্ছে। আসলে তো এ বিষয়ে রাষ্ট্রকে দায়দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ, এই গণ-অভ্যুত্থানে যারা নিহত হয়েছে, তাদের একটা বড় অংশ হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষ। খেটে খাওয়া মানুষ। তাদের মধ্যে শিশু আছে। আবার শিক্ষার্থী পরিচয়ে যারা মারা গেছে, তাদের মধ্যেও অনেকে আছে, যারা শ্রমজীবী পরিবারের সন্তান। এর ফলে তাদের মৃত্যুকে শুধু তাদের মৃত্যু হিসেবে দেখল হবে না। এসব পরিবার ভয়ংকর বিপদের মধ্যে পড়েছে। অনেক পরিবার অস্তিত্বের সংকটে পড়ে গেছে। যারা আহত হয়েছে, অর্থাৎ যারা চোখ হারিয়েছে, হাত হারিয়েছে, পা হারিয়েছে, তাদের অনেকে এখনো হাসপাতালে পড়ে আছে। তাদের চিকিৎসার পয়সা নেই। অনেকে চিকিৎসা ছাড়াই বাড়িতে গেছে।
এটা তো সরকারের প্রথম দায়িত্ব ছিল—এদের তালিকা করা এবং এদের দায়িত্ব নেওয়া। এদের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য টাকাপয়সা নেই—এটা তো হতে পারে না। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়াও দুঃখজনক।
ইতিমধ্যে দুই দফা উপদেষ্টা পরিষদের কলেবর বাড়ানো হলো। উপদেষ্টা পরিষদের কাঠামো বাড়ানোটা সরকার পরিচালনায় গতি আনবে বলে মনে করেন কি? উপদেষ্টাদের দক্ষতা-যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে?
আনু মুহাম্মদ: দেখুন, যোগ্যতার পরীক্ষা হয় কাজের মধ্য দিয়ে। কাজের ফলাফলের মধ্য দিয়ে। এই ফলাফলের ক্ষেত্রে যদি দু–একটা উদাহরণ দিই: এই যে যেমন একটা উদাহরণ দিলাম। আহত-নিহত ব্যক্তিদের তালিকা তারা এখনো করতে পারেনি। আমি মনে করি, যদি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে সব জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে চিঠি দিয়ে বলা হতো এদের তালিকা করে পাঠাও, তাহলেই কিন্তু ব্যাপারটা সহজ হয়ে যেত। এটা একটা মন্ত্রণালয়ের কাজ।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাও আমরা খুব একটা দৃশ্যমান দেখছি না। এই যে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে, তারা কী ধরনের তৎপরতা চালাচ্ছে, তা বোঝা যাচ্ছে না। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। এই দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা তো উপদেষ্টাদের একটা বড় কাজ। এটা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেন আর সামগ্রিকভাবে অন্তর্বর্তী সরকার বলেন, তাদের বড় কাজ ছিল জিনিসপত্রের দাম কমানো। সেটার ব্যাপারে কোনো তৎপরতা দৃশ্যমান নয়।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুটি দিক আছে। একটা হলো নিয়মিত ঘটে থাকে এমন ঘটনা: যেমন চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি; এগুলো কিন্তু বেড়েছে। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে টার্গেট করে আক্রমণ। যেমন সংখ্যালঘু—সেটা মাজার হতে পারে, হিন্দু সম্প্রদায় হতে পারে, আহমদিয়া বা অন্যান্য গোষ্ঠীর ওপর হামলার ব্যাপার হতে পারে। এসব সম্প্রদায়ের ওপর টার্গেটেড আক্রমণ হয়েছে। এগুলোর পেছনে মতাদর্শিক ব্যাপার আছে। অর্থাৎ এর মধ্যে বৈষম্যবাদী রাজনীতির প্রকাশ আছে। এগুলোর ব্যাপারে সরকারের আরও সক্রিয় ও শক্ত হওয়ার কথা ছিল। যেহেতু একটা সরকার গঠিত হয়েছে এবং উপদেষ্টারা নির্দিষ্ট দায়দায়িত্ব নিয়েছেন। ফলে তাঁদের প্রত্যেকেরই সুনির্দিষ্ট কাজ করতে হবে।
গত সরকারের সময় রাষ্ট্রের পাটকলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হলো। সেই বন্ধ করে দেওয়ার যে সুফলভোগী, অর্থাৎ পাটকলের জমি দখল করা বা পাটকলগুলোকে হাতের মুঠোয় আনার জন্য যাঁরা তৎপরতা চালিয়েছেন, তাঁদের একজন বিগত সরকারের সময় পাটমন্ত্রী ছিলেন। এবারও দেখতে পাচ্ছি, এই রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বেসরকারীকরণ করার কিংবা বন্ধ করে দেওয়া যে সুফলভোগী, সেই গ্রুপের একজন ব্যক্তিকে পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এটা তো সরাসরি স্বার্থের দ্বন্দ্বের বিষয়। এটা কোনোভাবে হতে পারে না, যেখানে আমাদের এই সরকারের কাছে প্রত্যাশা হচ্ছে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল, রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকল সেগুলোর ব্যাপারে আগের সরকার জমি দখলের জন্য যেভাবে বন্ধ করে দিচ্ছিল, সেটা থেকে এই সরকার সরে আসবে এবং পাটকল, চিনিকল নতুনভাবে নবায়ন করে চালু করবে। সেখানে যাঁরা এই বন্ধ করার সুফলভোগী, তাঁদেরই এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া তো ঠিক হলো না।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে সরকার যেসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তা কীভাবে নিচ্ছে এবং কোন যুক্তিতে নিচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে না। আমরা দেখলাম, শিক্ষাক্ষেত্রে একটি কমিটি এমন সব লোকের কথার পর বাতিল করে দেওয়া হলো, যাদের কথার গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে আমার মনে হয় না। এটি সরকারের দুর্বলতাকে সামনে আনে।
বন্ধ চিনিকল চালু করার একটা উদ্যোগ কিন্তু নেওয়া হয়েছে।
আনু মুহাম্মদ: হ্যাঁ, চিনিকল চালু করার জন্য একটা টাস্কফোর্স হয়েছে। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকও আছেন। তবে পাটকল নিয়ে কোনো কাজ এখন পর্যন্ত হয়নি। সেই পাট মন্ত্রণালয়ে যাঁকে উপদেষ্টা করা হয়েছে, তিনি তো সরাসরি পাটকল বন্ধ করার পক্ষের মানুষ। তাঁর বিরুদ্ধে মামলাও আছে বলে আমি শুনেছি।
আপনি একটি সেমিনারে বলেছেন, শেখ হাসিনার পতন হলেও ফ্যাসিবাদের অবসান হয়নি। বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন কি?
আনু মুহাম্মদ: ফ্যাসিবাদের তো বিভিন্ন অর্থনৈতিক ভিত্তি আছে। এর নানা রাজনৈতিক–সাংস্কৃতিক দিক আছে। এখন এই সরকারে থাকা লোকজনের মুখে যদি আমরা আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের ভাষায় কথা শুনি, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের মতো তারা যদি যেকোনো জায়গায় সাধারণ মানুষের ওপর আক্রমণ করে, তাদের যদি আমরা বিভিন্ন জায়গায় ভাঙচুর করতে দেখি, ‘বন্ধ করে দেব’, ‘উঠিয়ে দেব’, ‘করতে দেব না’—এ ধরনের ভাষা শুনি, তাহলে তা দুঃখজনক। কারণ, এগুলোকে তো আমরা আওয়ামী লীগের ভাষা হিসেবে জানি। অতীতের মতো তারা কিছু করবে না—এই প্রত্যাশা নিয়েই তো বাংলাদেশের মানুষ পরিবর্তনটা এনেছে। সেখানে এ ধরনের কথাবার্তা অগ্রহণযোগ্য।
সাবেক সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে সরকার আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে, এ নিয়ে কারও প্রশ্ন নেই। কিন্তু গয়রহ মামলা নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে।
আনু মুহাম্মদ: আমি মনে করি, আওয়ামী লীগ যেভাবে মানুষের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে কোণঠাসা হয়েছে, তাতে তার এমনিতেই উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। এখন আইনগত প্রক্রিয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তবে পাইকারিভাবে মামলা দেওয়া একটা সমস্যা। এটিকে আমি দক্ষতার অভাব বলব। যেভাবে মামলা করা হচ্ছে, তাতে এই মামলাগুলো টিকবে না। আইনজীবীরা হয়তো এ ক্ষেত্রে ভালো বলতে পারবেন।
এর আগে আওয়ামী লীগের সময় আমরা এ ধরনের পাইকারি মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার–বাণিজ্য হতে দেখেছি। চাঁদাবাজি করা ইত্যাদি প্রবণতা দেখেছি। সেই মেশিনটা তো এখন আর চালু থাকার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে মেশিনটা চালু আছে।
প্রধান অপরাধী যারা, তাদের বিষয়ে তো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। ব্যাংক লুট করে নিয়ে গেছে, নদী–নালা, খাল–বিল সব শেষ করে দিয়ে গেছে। বন উজাড় করে ফেলেছে। সেই সুনির্দিষ্ট অপরাধে তাদের অনেক বেশি শাস্তি হওয়ার কথা। সে বিষয়ে মামলা না হয়ে পাইকারি মামলা দেওয়া হচ্ছে।
অভিযোগ আছে, বিএনপি এখন তার ক্ষমতা চর্চা করা শুরু করেছে। বড় বড় পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে তারা সুপারিশ করছে এবং সেসব সুপারিশ সরকার গ্রহণও করছে। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
আনু মুহাম্মদ: এটি ঠিক যে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের বিষয়ে এই সরকারের কর্মকাণ্ড কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ। এটি মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করছে। কিছু ক্ষেত্রে যোগ্য লোককে বাদ দিয়ে অযোগ্য লোককে বসানো হচ্ছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বলতে পারি, এমনও হয়েছে, যাঁর কোনো যোগ্যতা নেই এবং যাঁর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটে শাস্তিমূলক পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত হয়েছিল, এ রকম ব্যক্তি হয় বিএনপি, নয়তো জামায়াতের প্রভাবে নিয়োগ পাচ্ছেন। কিন্তু এর দায় তো সরকারকেই নিতে হবে। আরেকটি বিষয় হলো ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির পুরোনো রেষারেষি এখন রাজনৈতিক চেহারায় ফিরে আসছে।
আগে কাউকে কোণঠাসা করতে হলে বলা হতো অমুকের দাদা–নানা বিএনপি–জামায়াত করে। তাকে ট্যাগ দেওয়া হতো। এখন আবার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই কাউকে কাউকে ফ্যাসিবাদের দোসর ট্যাগ দিয়ে কোণঠাসা করা হচ্ছে। অনেক জায়গায় শিক্ষকদের, ডাক্তারদের ফ্যাসিবাদের দোসর বলে হেনস্তা করা হচ্ছে। চট করে এসব লেবেল লাগানো তো অসহিষ্ণুতার লক্ষণ, যেটা অতীতে আমরা আওয়ামী লীগের মধ্যে দেখেছি, এখন সেটা দেখতে চাই না।
একটা প্রতিষ্ঠানের কেউ যদি অপরাধ করেন, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী তাঁর সাজা হতে হবে। কিন্তু চট করে দলবলসহ এসে কাউকে ফ্যাসিবাদের দোসর বলে পদত্যাগ করাবে বা হেনস্তা করবে, তা মেনে নেওয়া যায় না।
সর্বশেষ দফার উপদেষ্টা নিয়োগের বিরোধিতা করে ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলেছেন, তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়াই তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের এ নিয়োগ মানেন না এবং দুজনকে অপসারণের দাবিও তুলেছেন। সরকারের সঙ্গে ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে বলে মনে করেন?
আনু মুহাম্মদ: ছাত্রনেতৃত্বের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব বা নৈকট্য বাইরে থেকে আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। কারণ, আমরা দেখতে পাচ্ছি, ছাত্রনেতৃত্বের মধ্য থেকে অন্তত তিনজন উপদেষ্টা পরিষদে আছেন। সে কারণে এসব সিদ্ধান্তের কথা তাঁদের জানার কথা। কারণ, সব সিদ্ধান্ত তো ক্যাবিনেটের মাধ্যমেই হয়। এখন যদি দেখা যায় ছাত্রনেতৃত্বের একাংশ সিদ্ধান্ত নেবে এবং আরেক অংশ বিরোধিতা করবে, সেটি তো বড় সমস্যার বিষয়।
দেখা যাচ্ছে, জাতীয় পার্টির অফিসে হামলার সময় ছাত্রদের একাংশ এর পক্ষে আহ্বান জানাচ্ছে, আরেক অংশ বলছে এসব ব্যক্তি পর্যায়ের হামলা, এর সঙ্গে ছাত্রনেতাদের সম্পৃক্ততা নেই। গণ-অভ্যুত্থানে শেষ পর্যন্ত যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেই ছাত্রনেতাদের এখন অনেক বড় দায়িত্ব। সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করা এবং নিজেদের মধ্যে মিলমিশ করে থাকাটা তাঁদের জন্য খুব দরকার।
এ সরকার কত দিন থাকবে, তার সুনির্দিষ্ট ল্যান্ডমার্ক যেহেতু নেই, সেহেতু জনগণ একটা অনিশ্চয়তায় আছে। নির্বাচন কবে নাগাদ হবে, তা সরকারের এখন পরিষ্কার করা উচিত বলে আপনি মনে করেন কি না।
আনু মুহাম্মদ: আমি মনে করি, নির্বাচন কবে হবে, তা সুনির্দিষ্ট করা না হলে সমাজের মধ্যে অনাস্থা, অস্থিরতা বাড়তে পারে। যেহেতু সমাজে অস্থিরতা আছে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ইত্যাদি নিয়ে অসন্তোষ আছে। শ্রমিক এলাকায় বকেয়া মজুরি নিয়ে এখনো বিক্ষোভ হতে দেখা যাচ্ছে। সরকার শ্রমিকদের সঙ্গে ১৮ দফা চুক্তি করেছিল। তাতে পরিষ্কারভাবে লেখা আছে, ১০ অক্টোবরের মধ্যে সব বকেয়া মজুরি পরিশোধ করা হবে। কিন্তু তা হয়নি। আজ নভেম্বরেও বকেয়া মজুরির দাবিতে আন্দোলন হচ্ছে।
এতে নানা রকম অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। সে কারণে সরকার যদি সুনির্দিষ্ট পথনকশা তৈরি না করে, তাহলে অস্থিরতা কমবে না।
সরকার তো বলেছে, তারা আগে সংস্কার আনবে, এরপর নির্বাচন হবে।
আনু মুহাম্মদ: সরকার তো সব সংস্কার করতে পারবে না। সংস্কারের ভিত্তি তৈরি করতে পারবে। ভিত্তি তৈরি করার জন্য তাকে কিছু সুনির্দিষ্ট কাজ করতে হবে। সেটি তার দায়িত্বও বটে। কিন্তু তাকে তো আরেকটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। এ কারণে সরকারকে পরিষ্কার একটি পথনকশা করতে হবে। নির্বাচন যাতে টাকার খেলা না হয়, পেশিশক্তি, সাম্প্রদায়িকতা, আঞ্চলিকতার প্রভাবমুক্ত হয়—সেটা নিশ্চিত করা এ সরকারের দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে সময় লাগবে। সেই সময়টা তো অনির্দিষ্ট হবে না। আর যদি সরকারের সুনির্দিষ্ট টার্গেট না থাকে, তাহলে লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না। কিন্তু তাদের যদি নির্দিষ্ট তারিখ ঠিক করা থাকে, তাহলে কাজগুলো গোছানো সহজ হয়। সেই তারিখ প্রয়োজনে পেছাতেও পারে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট তারিখ ঠিক করা জরুরি।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
আনু মুহাম্মদ: আপনাদেরও ধন্যবাদ।