মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান

বিশেষ সাক্ষাৎকার : মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান

অর্থনীতির লাইনচ্যুত ট্রেনটাকে আমরা লাইনে তুলতে পেরেছি

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ; সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং রেলপথ—অবকাঠামো খাতের তিন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। সরকারের ১০০ দিনের অর্জন ও ব্যর্থতা এবং বিদু্যৎ, জ্বালানি, সড়ক, রেলের সংস্কার ও উদ্যোগ নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনোজ দে 

প্রশ্ন

ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার ১০০ দিন পার হলো। সব প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়েছে, এমন এক বাস্তবতায় আপনারা দায়িত্ব নিয়েছেন, আপনাদের সামনে চ্যালেঞ্জটা বিশাল। মোটাদাগে সরকারের অর্জনকে কীভাবে দেখছেন? 

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: বাংলাদেশটা শুধু লাইনচ্যুত হয়ে গিয়েছিল তা নয়, অন্যদিকেও চলে গিয়েছিল। আমাদের দায়িত্বটা বাংলাদেশকে লাইনে তোলা। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের ক্ষেত্রে বিরাট একটা সমস্যা ছিল। এখন সেটা স্থিতিশীল অবস্থায় এসেছে। আগের সরকার অনেক বেশি টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছেড়েছে। একদিকে পণ্যের পরিমাণ কম, অন্যদিকে বাজারে অনেক বেশি টাকা। ফলে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। আমরা এসে টাকা ছাপানোটা বন্ধ করেছি। এটা সরকারের আরেকটি বড় অর্জন।

হাসিনা সরকার বিরাট একটা দেনার বোঝা দেশের ঘাড়ে রেখে গেছে। জ্বালানি তেল, এলএনজি, দেশ ও বিদেশ থেকে বিদ্যুৎ কেনার বিশাল দেনা। এই দেনাটা ডলারেও আছে, টাকাতেও আছে। ধীরে ধীরে আমরা এই দেনা পরিশোধ করছি। দেনা যখন অনেক বেশি বকেয়া হয়ে যায়, তখন যাঁরা সেবা প্রদান করেন, তাঁরা তো অস্থির হয়ে যান। আমরা সেই দেনাগুলো ধীরে ধীরে পরিশোধ করছি। অনেক ক্ষেত্রে আমরা সফলও হয়েছি। যেমন বিপিসির দেনা আমরা পুরোপুরি শোধ করেছি।

ডলারের দেনাটাও আমরা অনেকখানি কমিয়ে আনতে পেরেছি। আমরা যখন দায়িত্ব নিই, তখন ডলারে দেনা ছিল প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার। এখন সেটা কমিয়ে দেড় বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি নিয়ে এসেছি। আমাদের সব দেনা শেষ পর্যন্ত টাকার দেনা। কারণ, ডলারও কিন্তু টাকা দিয়ে কিনতে হয়। ফলে দেনা মেটাতে হলে প্রথমে টাকার সংস্থান করতে হবে, ডলারের সংস্থান করতে হবে। এখন বাণিজ্যিক ব্যাংকে রেমিট্যান্স বাড়ছে। এর ফলে সেখান থেকে ডলার পাওয়া যাচ্ছে। রিজার্ভ ভেঙে ডলারের জোগান দিতে হচ্ছে না। আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর সরকারের অনেক অপচয় বন্ধ হয়েছে। সেই টাকা দিয়ে আমরা দেনা পরিশোধ করছি।

আমরা সংকোচনমূলক একটা মুদ্রানীতি নিয়েছি। এ ধরনের মুদ্রানীতি মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনে কিন্তু তার জন্য একটা সময় লাগে। সার্বিকভাবে আমরা মনে করি, অর্থনীতি একটা শকের মধ্যে ছিল, সেই শকটা আমরা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। অর্থনীতির লাইনচ্যুত ট্রেনটাকে আমরা লাইনে তুলতে পেরেছি। 

প্রশ্ন

১০০ দিন মানে, আমরা ধরে নিতে পারি সরকারের হানিমুনকালটা শেষ হয়েছে। বাজারে জিনিসপত্রের দাম, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি—এসব নিয়ে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ বাড়ছে। মানুষ তো চায় দৃশ্যমান পরিবর্তন। এই ব্যর্থতার ব্যাপারে কী বলবেন? 

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে না পারা। হাজারের বেশি ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়েছে, ৩০ হাজারের বেশি মানুষকে আহত করা হয়েছে। সেটা তো মূলত পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী করেছে। ফলে নৈতিকভাবে তারা খুব ভেঙে পড়েছে। তাদের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করছে। পুলিশের মনোবল ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মর্যাদার পুলিশের সাবেক আইজি খোদাবকশ চৌধুরীকে নিয়েছি। আমরা আশা করছি, তিনি পুলিশকে পুনর্গঠন করতে সক্ষম হবেন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য আমাদের আরও অনেক কাজ করতে হবে। 

আমাদের দ্বিতীয় বড় ব্যর্থতা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারা। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমরা সারের সরবরাহ যাতে অব্যাহত থাকে, সেই উদ্যোগ নিয়েছি। সামনের সেচ মৌসুমের জন্য জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চিত করছি। খাদ্যের সরবরাহ যাতে বাড়ে, সে জন্য আমদানির পদক্ষেপ নিয়েছি। আমরা আশা করছি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। 

সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশাটা অনেক বেশি। আমাদের কাছে তো জাদুর চেরাগ নেই যে রাতারাতি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আমরা যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছি, সেগুলো ধীরে ধীরে কাজ করতে শুরু করেছে। কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটা ফল বয়ে নিয়ে আসে না। একটু ধৈর্য ধরতে হবে। বর্তমান মূল্যস্ফীতিটা টাকা ছাপানোর কারণে হচ্ছে না। সেটা হচ্ছে সরবরাহ ঘাটতির কারণে। আগস্ট, সেপ্টেম্বর মাসে পরপর দুটি বড় বন্যা হয়েছে। ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালীর মতো যেসব জায়গায় বন্যা হয় না, সেখানেও বন্যা হয়েছে। এ জায়গাগুলো সবজি উৎপাদনের জায়গা। ফলে একটা সরবরাহ-ঘাটতি তৈরি হয়েছে। 

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান
প্রশ্ন

সরকারের মধ্যে সমন্বয় কতটা, সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। অগ্রাধিকারের জায়গা কোনটা হওয়া দরকার, তা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন। নতুন উপদেষ্টা যুক্ত এবং দায়িত্ব রদবদল হলো। একটা বড় লক্ষ্য সামনে রেখে কতটা টিম হয়ে উঠতে পারলেন উপদেষ্টারা। 

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: ৮ আগস্ট প্রথম অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে উপদেষ্টারা প্রথম শপথ নিলেন। এরপর ১৬ আগস্ট আমরা আরও চারজন যুক্ত হলাম। ১১ নভেম্বর আরও কয়েকজন যুক্ত হলেন। প্রথম দুই ব্যাচে যাঁরা উপদেষ্টা পরিষদে যোগ দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে একটা সমন্বয় গড়ে উঠছে। নতুন যাঁরা এসেছেন, তাঁদের আরও সময় লাগবে। উপদেষ্টা পরিষদে বিভিন্নজন বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছেন। আমরা কয়েকজন সরকারে কাজ করে এসেছি, কয়েকজন এনজিওতে কাজ করে এসেছেন, কয়েকজন ছাত্র উপদেষ্টা আছেন। আমরা এখন পরস্পরকে বোঝার চেষ্টা করছি। ফলে ধীরে ধীরে আমাদের সমন্বয়টা গড়ে উঠছে। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। 

প্রশ্ন

অনেকে মনে করেন, শেখ হাসিনা সরকারের জ্বালানির ভুল নীতি আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট ও স্থবিরতার জন্য প্রধানভাবে দায়ী। একদিকে চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, দায়মুক্তি আইন, অন্যদিকে আমদানিনির্ভরতা ও ভারতনির্ভরতা। আপনি দায়িত্ব নেওয়ার পর জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত যে উদ্যোগগুলো নিয়েছে, সেটা কি সংকট উত্তরণে যথেষ্ট? 

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: বিগত কয়েক বছর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দুর্নীতির মহোৎসব হয়েছে। এর ভিত্তিটা ছিল ২০১০ সালের বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনটা। আইনে যেমন দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, আবার এটা ছিল প্রতিযোগিতাবিরোধী আইন। জরুরি আইন হিসেবে পাস হলেও ২০২৬ সাল পর্যন্ত আইনটা বলবৎ ছিল। আমরা এসে আইনটা বাতিল করেছি। আমরা বলেছি, এখন থেকে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত নীতিমালা আমরা অনুসরণ করব। প্রতিযোগিতা ছাড়া কোনো কাজ কেউ পাবে না। 

প্রতিযোগিতা না থাকার কারণে সবকিছুই অনেক বেশি দামে কেনা হয়েছিল। সেটা সামাল দেওয়ার জন্য হাসিনা সরকার জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম ইচ্ছা করলেই বাড়ানোর ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছিল। একই বছরে সাত-আটবারও বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছে। আমরা এসে বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম নির্ধারণের ক্ষমতা বিইআরসির কাছে নিয়ে গেছি। 

বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের যেসব কোম্পানি রয়েছে, সেগুলোর চেয়ারম্যান হতেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবেরা। আমরা এসে বলেছি, এটা হতে পারে না। কারণ, এখানে স্বার্থের দ্বন্দ্ব রয়েছে। আমরা এমনকি কোম্পানির চেয়ারম্যান পদে টেকনোক্র্যাট ব্যক্তিদেরও বসিয়েছি। কোম্পানির বোর্ডে রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে সরে এসে দক্ষ লোকদের অন্তর্ভুক্ত করেছি। এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ-জ্বালানিতে দুর্নীতির যে কাঠামো ছিল, সেটা আমরা পুরোপুরি ভেঙে দিয়েছি। বলা চলে পুনর্গঠনের মাধ্যমে আমরা একটা নতুন যাত্রা শুরু করেছি। 

তবে এখানে ফল আসতে একটু সময় লাগবে। তার কারণ হলো, আমরা উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা পদ্ধতিতে কাজ করলেও এখনো লোকের মধ্যে ধারণা রয়ে গেছে সরকারের লোকদের সঙ্গে বন্দোবস্তে না এলে তারা প্রকল্প পাবে না। আমরা খুব স্পষ্ট করে বলতে চাই, সরকারের সঙ্গে ব্যবসা করতে হলে কোনো উপদেষ্টাকে চিনতে হবে না, কোনো সচিবকে ধরতে হবে না। কারও সঙ্গে কোনো লেনদেনের প্রয়োজন নেই। শুধু কাজ করার মতো সক্ষমতা থাকলেই হবে। 

প্রশ্ন

আমরা দেখছি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যেখানে যখন যে সমস্যা তৈরি হচ্ছে, সেখানে সেটা সমাধান করা হচ্ছে বা সমাধানের চেষ্টা চলছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সংস্কারের কিংবা নীতি পরিবর্তনের কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ তো দেখছি না। 

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: আমরা যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছি, এগুলোই কিন্তু মৌলিক সংস্কার। বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বেশি দামে জিনিস কেনা হয়েছে, তার কারণ কী? প্রতিযোগিতার অভাব। এ খাতে প্রতিযোগিতা থাকলে এটা হতে পারত না। রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। যেমন রূপসায় ৮ হাজার কোটি টাকায় ৮৮০ মেগাওয়াটের একটা বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয়েছে, অথচ গ্যাসের সরবরাহ নেই। 

হাসিনা সরকার জনবিচ্ছিন্ন সরকারে পরিণত হয়েছিল। সেটা শুধু ভোটের বিবেচনা থেকে বলছি না, তাদের কাছে মানুষ কোনো ব্যাপার ছিল না। সরকার ছিল কয়েকজন রাজনীতিবিদের, তাদের আত্মীয়স্বজনের, তাদের বন্ধুবান্ধবের এবং কতগুলো ব্যবসায়ী ও আমলার। আমরা চাইছি সরকারটাকে মানুষের কাছে ফিরিয়ে দিতে। সরকার এমন একটা বদ্ধ ঘরের মতো হয়ে গিয়েছিল, যেখানে কোনো বাতাস ঢুকতে পারত না। আমরা সরকারের জানালা-দরজাগুলো খুলে দেওয়ার চেষ্টা করছি। 

মেট্রোরেলের স্টেশনের কথা ধরুন। বলা হয়েছিল, চালু করতে ৩৫০ কোটি টাকা লাগবে, এক বছর সময় লাগবে। কিন্তু আমরা সেটা ২ মাস ১৭ দিনে চালু করেছি। আমাদের খরচ হয়েছে এক কোটি টাকার কিছু বেশি। এটা কীভাবে করলাম? আমরা একজন অস্ট্রেলিয়ান-বাংলাদেশিকে খুঁজে বের করলাম, যিনি দুবাইয়ে, ভারতে মেট্রোতে কাজ করেছেন। আমরা তাঁর সহযোগিতা নিয়ে কাজটা করেছি। আমরা সরকারকে মানুষের কাছে নিয়ে যাচ্ছি। আপনারা জেনে বিস্মিত হবেন যে রেলের উন্নয়নের জন্য আমরা এখন রাজউক মডেল কলেজের একাদশ শ্রেণির একজন ছাত্রের সহযোগিতা নিচ্ছি। 

আমাদের সঙ্গে অন্য সরকারের একটা বড় পার্থক্যের জায়গা আছে। অন্য সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। ক্ষমতা গ্রহণ করতে গেলে যেকোনো দেশের ক্ষেত্রেই একটা কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর ওপর নির্ভর করতে হয়। আমরা ক্ষমতা নয়, দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। ক্ষমতা মানুষকে দাম্ভিক করে। কিন্তু দায়িত্ব মানুষকে বিনয়ী করে। কায়েমি স্বার্থের প্রতি আমাদের সরকারের কোনো দায়বোধ নেই। আমাদের দায়বোধ শহীদদের প্রতি, আহতদের প্রতি, আন্দোলন যাঁরা করেছেন তাঁদের প্রতি। ফলে তাঁরা কী চান, সেটাই আমাদের সবচেয়ে বড় উপলব্ধির বিষয়।

আরেকটা পার্থক্য হচ্ছে, আমরা সরকারটাকে একটা আমানত হিসেবে নিয়েছি। ফলে কোন কাজে মানুষ লাভবান হবে, সেটাই আমাদের প্রধান বিবেচনা। 

প্রশ্ন

লোডশেডিং করতে হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা চাহিদামতো গ্যাস-বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। শীত মৌসুম শুরু হচ্ছে। এ সময়ে চাহিদা কম থাকে। গ্রীষ্মে চাহিদাটা অনেকটা বাড়ে। ফলে আগামী বছরে বিদ্যুতের উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা, গ্যাসের জোগান বাড়ানোর বিশেষ কোনো পরিকল্পনা কি নিয়েছেন? 

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: আমাদের সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন না হওয়ার কারণে খুব বেশি লোডশেডিং হয়নি। লোডশেডিংয়ের এখনকার বড় কারণটা হলো সঞ্চালন লাইনের ত্রুটি। আমরা এখন এই ত্রুটিগুলো সারানোর চেষ্টা করছি। আমাদের জ্বালানি খাতের মূল সমস্যাটা হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক উৎসের জোগান। বর্তমানে আমাদের গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ৪০০ কোটি ঘনফুটের মতো। কিন্তু আমরা আমদানি ও দেশীয় উৎপাদন মিলিয়ে ৩০০ কোটি ঘনফুট দিতে পারছি। এর ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকলেও আমরা গ্যাস দিতে পারছি না। শিল্পকারখানায়ও গ্যাসের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। গ্যাসের জন্য টাকা ও ডলারের সংস্থান দরকার। আমরা চেষ্টা করছি গ্যাসের আমদানি বাড়াতে। 

আমরা দেশীয় উৎস থেকে গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর দীর্ঘমেয়াদি কিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। নির্দিষ্ট করে ভোলাকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। সেখানে কূপ খনন বাড়ানো হচ্ছে। ভোলার গ্যাস আনার জন্য পাইপলাইন তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি। ভোলায় একটা ব্রিজ করা যায় কি না, সেটাও আমরা চিন্তাভাবনা করছি। সিলেট, নোয়াখালীতে আমরা কূপ খনন বাড়াচ্ছি। এখানে বাপেক্সও কাজ করবে। প্রাইভেট সেক্টরকেও কূপ খননের কাজ দেব। কিন্তু সেটা বাপেক্সের আওতায় করতে হবে। আমরা যদি বড় আকারের গ্যাসের মজুত পাই, তাহলে আমাদের এলএনজি আমদানি অনেকটাই কমে আসবে। 

আমরা কিছু স্বল্পমেয়াদি, কিছু মধ্যমেয়াদি ও কিছু দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিয়ে জ্বালানি পরিস্থিতি উন্নতি করার চেষ্টা করছি। আমরা আশা করি, গ্রীষ্ম মৌসুমে, সেচের মৌসুমে বড় ধরনের ঘাটতি হবে না।

প্রশ্ন

হাসিনা সরকার অবকাঠামোগত উন্নয়নকে রাজনৈতিক প্রচারের মূল উপজীব্য বানিয়ে তুলেছিল। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল, পদ্মা সেতুর রেল প্রকল্প এককথায় শ্বেতহস্তী প্রকল্প। প্রকল্পগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে আরও কিছুটা টেকসই করা কীভাবে সম্ভব হবে? 

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: কর্ণফুলী টানেলের সমস্যাটি কী? মাতারবাড়ীতে একটা গভীর সমুদ্রবন্দর হওয়ার কথা ছিল। সেটার সড়ক-সংযোগ হিসেবে টানেলটি করা হয়েছে। কিন্তু মাতারবাড়ীতে সমুদ্রবন্দর তো হয়নি। কিন্তু টানেলে তো বিরাট ঋণের দায় রয়েছে। টানেল দিয়ে গাড়ি চলাচল কীভাবে বাড়ানো যায়, সেই চিন্তা এখন আমরা করছি। পদ্মা সেতুতে রেলসেতু প্রকল্প যখন নেওয়া হয়, তখন বলা হয়েছিল বছরে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা রাজস্ব আসবে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর দেখি, ছয় মাসে রাজস্ব এসেছে ৩৭ কোটি টাকা। একটা স্কুলের বালককে বলা হলেও সে এই প্রকল্পের কথা চিন্তা করবে না। এখন প্রকল্প তো হয়ে গেছে। আমরা চেষ্টা করছি, কীভাবে এই প্রকল্পগুলো থেকে রাজস্ব বাড়ানো যায়। 

প্রশ্ন

সড়কে নৈরাজ্য ও মৃত্যুর মিছিল কমেনি। নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল সড়কব্যবস্থা মানুষের বহুদিনের প্রত্যাশা। এ নিয়ে আপনারা কী উদ্যোগ নিয়েছেন? 

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো বের করে সমাধানের চেষ্টা করছি। আমরা দুর্ঘটনার কারণগুলো বের করে রোড সেফটি নামের একটি প্রকল্প নিয়েছি। আমাদের সড়কে যানজটের বড় কারণ এখানে ছোট গাড়ি বেশি। আমরা বাসরুট ফ্র্যাঞ্চাইজি চালু করার উদ্যোগ নিয়েছি। মানুষ যাতে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পারাপার হয়, সেটা নিশ্চিতে কাজ করছি। সম্প্রতি বাড্ডায় রাস্তা পার হতে গিয়ে একজন তরুণী মারা গেলেন। তাঁর বোন আহত হলো। দুর্ঘটনার খবরের পর আমি ঘটনাস্থলে গিয়েছি। চালকের লাইসেন্স বাতিল করেছি। যদিও জীবনের মূল্য হয় না, তারপরও আমরা আমাদের ব্যর্থতা, আমাদের অপরাধবোধের স্বীকৃতি হিসাবে পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছি। আগের কোনো সরকার এই ব্যর্থতার দায় স্বীকার করেনি।

প্রশ্ন

রেলকে একই সঙ্গে গণপরিবহন ও লাভজনক করার কোনো উপায় কি দেখছেন?

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: রেলে অপচয় এত বেশি হয়েছে যে শিগগিরই এ খাতকে লাভজনক করার উপায় নেই। আমরা চেষ্টা করছি মানুষকে কতটা স্বস্তি দেওয়া যায়। অনলাইনে টিকিট পাওয়ার ক্ষেত্রে অ্যাপে যে সমস্যাগুলো ছিল, সেটা আমরা ঠিক করেছি। আগে কোনো ব্যক্তি তঁার ক্ষমতাবলে টিকিট সংরক্ষণ করতে পারতেন। এখন সেটা পারেন না। যদিও আমাদের চাহিদার তুলনায় জোগান কম, এরপরও এখন মানুষ টিকিট পান। এ ছাড়া আমরা কিছু কমিউটার ট্রেন চালু করেছি। তবে আমাদের ট্রেনের লোকোমোটিভ-সংকট আছে। ফলে আমরা রেলরুট র‍্যাশনালাইজেশনের উদ্যোগ নিয়েছি। যেখানে যাত্রী বেশি, সেখানে ট্রেনের সংখ্যা বাড়বে। যেখানে যাত্রী কম, সেখানে ট্রেনের সংখ্যা কমিয়ে আনবে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: আপনাকেও ধন্যবাদ।